মৃণাল কানতি দাস

১৬ মার্চ, ২০১৭ ০১:০৫

হিজড়াগণ যখন সমস্যার সৃষ্টি করে

প্রতীকী ছবি

গত সপ্তাহে এক বিয়েতে বরযাত্রী হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাচ্ছিলাম। মৌলভীবাজারের চাঁদনীঘাট এলাকায় এসে দেখি প্রধান সড়কে বিশাল যানজট লাগিয়ে প্রতিটি বরের গাড়ি আটকাচ্ছেন একদল লাঠিয়াল হিজড়া। বিয়ে প্রতি তাদের দাবি চার হাজার টাকা। কথা বলতে বলতে তারা দেড় হাজারে রাজি হলেন। টাকা ভালো করে গুনে তারপর গাড়ি ছাড়লেন হিজড়াগণ। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার বললেন - আপনারা বুদ্ধিগুণে বেঁচে গেলেন, তিন/সাড়ে তিন হাজার টাকা না পেলে এরা গাড়ি ছাড়েনা।

শ্রীমঙ্গল পাড়ি দিয়ে সাঁতগাও এলাকায় এসে দেখি আরেক দল হিজড়া। এই দলের দাবি পাঁচ হাজার টাকা।  এবার বিষয়টা এমন দাঁড়ালো যে, তাদেরকে টাকা দিতে হবে অথবা তাদের উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে নিতে হবে। আমি এবং সেনাবাহিনীতে কর্মরত আমার এক বন্ধুর মধ্যস্থতায় এক হাজার টাকার রফাদফায় আমাদের গাড়ি ছাড়া পেল।

মৌলভীবাজার থেকে নাসিরনগর পর্যন্ত সর্বমোট ছয়বার হিজড়াগণ গাড়ি থামিয়ে চাঁদা (তাদের ভাষায় বকশিশ) দাবী করলেন। এভাবে রফাদফা করতে করতে আমাদের বরের খরচ হলো চার হাজার সাতশত টাকা।

গত বছরের ১১ই ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার দুপুর বেলা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন অক্ট্রয় মোড় এলাকায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স অ্যান্ড হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কামাল হোসেনের বাস ভবনে ঢোকে তাকে মারধর করে বাম হাত ভেঙে দিয়েছিলো কয়েকজন হিজড়া। এ সময় তারা ১০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেছিলো,এতো টাকা দিতে অসম্মতি জানানোর কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে তারা এই ঘটনা ঘটিয়ে চলে যায়।

এরকম হাজার ঘটনার সত্যতা আছে। কিছু হিজড়া তো আবার অস্ত্র নিয়েও ঘুরেন। গত বছর রাজধানীর উত্তরার রাজউক মার্কেটের পেছনের এলাকায় টাকা কালেকশনের সময় এক হিজড়ার গুলিতে সেঁজুতি নামের অপর এক হিজড়া আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়।

একটা সময় ছিল, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নেচে গেয়ে মানুষ যা দিত, তা নিয়েই খুশি থাকতেন হিজড়ারা। কিন্তু সম্প্রতি বছরগুলোতে এরা তাদের জীবিকা নির্বাহ করার পদ্ধতি বদলে ফেলেছেন। রাস্তাঘাট, বাসাবাড়ি, দোকানপাট যেখানে-সেখানে টাকার জন্য মানুষকে নাজেহাল করা তাদের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে এমনকি সিগন্যালে ট্রাফিক পুলিশ, টহল পুলিশ বা সার্জেন্টের সামনেই তারা এসব হয়রানি চালাচ্ছেন।

হিজড়াদের সংস্কৃতিতে আছে,তারা মানুষের বাসায় যাবেন, টাকা বা অন্যকিছু আবদার করবেন, মানুষ খুশি মনে যা দেবেন, তাই নিয়ে ফিরতে হবে। কিন্তু আজকাল নানা ধরনের ভয় দেখিয়ে টাকা নেওয়ার প্রবণতা প্রখর হয়ে উঠেছে হিজড়াদের মানসিকতায়। যেহেতু বেড়ে ওঠার উপর আচরণ নির্ভরশীল আর আজ যারা মানুষকে বিপদে ফেলে টাকা নেওয়ার পদ্ধতি মেনে বেড়ে উঠেছেন তারা একসময় ১০ হাজার টাকা ভাতা পেলেও রাস্তায় এ ধরনের হয়রানিমূলক আচরণ করা থেকে বিরত থাকবেন না। জনগণের পক্ষে এদের প্রতিরোধ করাও অসম্ভব। মানবতার দৃষ্টিতে তাকালে তাদেরকে কোন ভাবেই প্রতিরোধ করা যায়না। কিন্তু তাদের সহিংস আচরণকে প্রশ্রয় দেওয়াটাও এখন অনুচিত মনে হচ্ছে । এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য একমাত্র সরকারই পারেন ব্যবস্থা নিতে। সেক্ষেত্রে কাউন্সিলিং এর মধ্য দিয়ে সরকারকেই পূর্ণ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।

সরকার ২০১৫-১৬ অর্থবছরে হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচিতে ১৮ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিলেন। কিন্তু তার প্রভাব যথাযথ ভাবে দেখা যায়নি।

২০১৩ সালে হিজড়ার ‘লিঙ্গ পরিচয়কে’ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু হিজড়াদের নিয়ে কাজ করেন এমন সংগঠন বা সমিতির কাছে এমনকি রাষ্ট্রের কাছেও হিজড়াদের কোনও সঠিক পরিসংখ্যান নেই। সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি বলছে, সারাদেশে হিজড়ার সংখ্যা ১০ থেকে ১৫ হাজার। আর বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা সূত্রে জানা যায়, সারাদেশে হিজড়ার সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার।

ট্রাফিক পুলিশে হিজড়াদের নিয়োগ দেবার একটা ঘোষণা আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে এসেছিলো। বিগত বছরের ৩০ মার্চ রাজধানীর তেজগাঁও বেগুনবাড়ি এলাকায় ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে কুপিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যাওয়ার সময় লাবণ্য নামে এক ‘হিজড়া’ দুই ঘাতককে ধরে ফেলেন। এরপর বিষয়টি সারাদেশে ব্যাপক আলোচনা হয়। হিজড়া সদস্যের এই সাহসিকতা ভূয়সী প্রশংসা কুড়ায়। পরবর্তীতে সরকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ও হিজড়াদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে ট্রাফিক পুলিশ হিসেবে নিয়োগ দেবার কথা বললেও বাস্তবে তার কোন ছোঁয়াও লাগেনি।

আমাদের রাস্তাঘাটে চলাচলের ক্ষেত্রে নানা প্রকার সমস্যার সাথে হিজড়া সমস্যাটাও এখন ক্রমেই প্রকট আকার ধারণ করছে। ছিনতাইকারীরা পুলিশ তথা জনবলকে ভয় পায়,কিন্তু হিজড়াগণ কাউকে পরোয়া করেন না। এই বেপরোয়া দলকে সঠিকভাবে পুনর্বাসন করতে না পারলে অবৈধ পথে টাকা উপার্জন হিজড়াদের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়ে যাবে। তখন লাভের অঙ্ক দেখে দেশে হিজড়া সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকবে। তখন তা নিশ্চিতভাবে রাষ্ট্রের জন্য চরম অশুভ ডেকে আনবে এবং সেটা একেবারেই সম্মুখে।
অতএব সরকারের এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেবার এটাই যথার্থ সময়।

  • এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত