ডা. জাহিদুর রহমান

১৮ মার্চ, ২০১৭ ০০:৫১

করোনারি স্টেন্ট ও একজন বিরেন্দ্র সাংওয়ানের যুদ্ধজয়

করোনারি স্টেন্ট নিয়ে ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকারের একটা বিজ্ঞাপন চোখে পড়েছে। বিজ্ঞাপনের ছবি যাই হোক আসল নায়ক কিন্তু ছবির অন্যজন, ৩৬ বছরের তরুণ আইনজীবী বিরেন্দ্র সাংওয়ান। গোটা সিস্টেমের বিরুদ্ধে একা যুদ্ধ করে জেতা এই গোবেচারা মানুষটাই আজকে ভারতের জাতীয় বীর, একমাত্র তার হার না মানা নীতির কারণেই ভারতে আজকে বিভিন্ন ধরনের করোনারি স্টেন্টের দাম প্রায় ৮৫% কম! ১.৫ থেকে ২.৫ লাখ রুপির স্টেন্ট এখন ২৯,৬০০ টাকা। ৩০ থেকে ৭৫ হাজার টাকার স্টেন্টের দাম কমে হয়েছে ৭,২৬০ টাকা!

রোগিরা স্টেন্ট কেনার ক্ষেত্রে কি পরিমাণ দুর্নীতির শিকার হত সেটা আগে পরের দামের পার্থক্য দেখেই আন্দাজ করা যায়।

সাংওয়ানের এক বন্ধুর বাবা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ফরিদাবাদের একটি হাসপাতালে ভর্তি হলে ডাক্তাররা তাকে এনজিওপ্লাস্টি করার সময় করোনারি স্টেন্টের দাম বলা হয় ১ লাখ ২০ হাজার রুপি। স্টেন্টের সাথে সরবারহকৃত প্যাকেটের গায়ে বিক্রয়মূল্য না লেখা থাকায় সাংওয়ান বিষয়টি নিয়ে কৌতূহলী হয়ে ওঠে এবং পরবর্তীতে সে ভারতের ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল প্রাইসিং অথোরিটির সাথে যোগাযোগ করে।

তারা কয়েকবার ফিরিয়ে দেয়ার পর গত ০৯/১২/২০১৪ তারিখে প্রথমবারের মত সাংওয়ানের চিঠির উত্তর দেয়। তাতে বলা হয়, ওষুধ এবং প্রসাধনী আইন অনুযায়ী করোনারি স্টেন্ট একটি ড্রাগ হলেও প্রয়োজনীয় শর্তাবলি পূরণ না করায় তা ন্যাশনাল লিস্ট অফ এসেনশিয়াল মেডিসিনের (এনএলএএম) অন্তর্ভুক্ত নয়। যার ফলে স্টেন্টের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে কার্যত সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই।

সাংওয়ান ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে করোনারি স্টেন্টকে এসেনশিয়াল মেডিসিনের তালিকাভুক্ত করার জন্য দিল্লি হাইকোর্টে আবেদন জানায়। আদালত তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২৫/০২/২০১৫ তারিখে করোনারি স্টেন্টকে এসেনশিয়াল মেডিসিনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়।

সরকারের পক্ষ থেকে কোন ব্যবস্থা না নেয়ার কারণে সাংওয়ান ২০১৫ সালের জুলাইতে আদালতে পিটিশন দাখিল করে। উচ্চ আদালতের চাপে ভারতের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় অবশেষে ১৯/০৭/২০১৬ তারিখে সব ধরনের করোনারি স্টেন্টকে এসেনশিয়াল মেডিসিন হিসেবে ঘোষণা করে। তারপরও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং স্টেন্ট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে বিষয়টা ঝুলে যায়।

শেষমেশ গত ১ মার্চ থেকে নতুন করে করে ঠিক করে দেয়া দামে স্টেন্ট বিক্রি শুরু হয়। সফল হয় বিরেন্দ্র সাংওয়ান, হাসি ফোটে লাখ লাখ ভারতীয় হৃদরোগির মুখে।

আমাদের দেশে করোনারি স্টেন্ট নিয়ে অবৈধ ব্যবসার পরিধি ভারতের চেয়েও বেশি। প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর উপর কোনকালেই সরকারের কোন ধরনের নিয়ন্ত্রণ ছিল না, এখনো নেই। এমন কি সরকারের উদাসীনতার সুযোগ নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ এনজিওপ্লাস্টি করা হয় এমন হাসপাতালগুলোতে কতিপয় দুর্নীতিবাজ হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, মেডিকেল অফিসার, টেকনিশিয়ান, নার্স, কর্মচারী মিলে গড়ে ওঠা একটা অশুভ চক্র করোনারি স্টেন্টের ব্যবসাটাকে চরম অমানবিক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে।

প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার কমিশন আসছে শুধুমাত্র করোনারি স্টেন্ট সরবারহকারী কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে।

হৃদরোগ বিশেষজ্ঞদের কমিশনের লোভে প্রয়োজন ছাড়া অথবা প্রয়োজনের অতিরিক্ত স্টেন্ট পড়ানোর অভিযোগও আছে। স্টেন্ট বসানোর সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে একজন কার্ডিয়াক সার্জনের মতামত নেয়া বাধ্যতামূলক হলেও আমাদের দেশের কার্ডিওলজিষ্টরা সেটা সবসময় এককভাবেই নেন। হাসপাতালের চিকিৎসা সরঞ্জাম সবসময় টেন্ডারের মাধ্যমে কেনার নিয়ম থাকলেও, করোনারি স্টেন্টের ক্ষেত্রে সেটা মানা হচ্ছে না।

প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা লেনদেন হওয়া এরকম একটি মোটা দাগের দুর্নীতি নিয়ে ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্টিং মিডিয়া, ফেসবুক, টুইটার, ব্লগ সাইট, কোথাও কোন রকমের আলোচনা নেই। ক্ষমতার দাপট আর কাল টাকার তীব্র স্রোতে এই দুর্বল প্রতিবাদগুলো খড়কুটোর মত ভেসে যায়। চাতক পাখির মত তাই চেয়ে থাকি একজন বিরেন্দ্র সাংওয়ানের অপেক্ষায়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত