আল আমিন হোসেন মৃধা

০৭ এপ্রিল, ২০১৭ ২১:০৬

ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই, নিউ কলোনিজম নয়

সাত বছর পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ ৭ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে দেশটিতে গেছেন একগুচ্ছ চুক্তি সই করতে। ভারতের সাথে প্রধানত দ্বিপক্ষীয় সামরিক সহযোগিতা চুক্তিসহ সম্ভাব্য ৩৩টি সমঝোতা স্মারক সই করবেন।

প্রতিরক্ষা চুক্তিসহ সম্ভাব্য কি কি চুক্তি সই হতে পারে, তা পরিষ্কার নয়। দু'দেশের বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সম্ভাব্য চুক্তি হতে পারে;

♦ দ্বিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র অনুযায়ী, সহযোগিতার এ ক্ষেত্র বিস্তৃত করতে ভারত ৫০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার প্রস্তাব করেছে। অনুচুক্তি বা সমঝোতা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশে যৌথ সহযোগিতায় প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তৈরি হবে।
♦ ভারতের দেয়া তৃতীয় দফা ঋণ চুক্তি
♦ বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম ছাড়াও মংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার,
♦ পায়রা বন্দরে মাল্টিপারপাস (কন্টেইনার) টার্মিনাল নির্মাণ, লাইটহাউজেস ও লাইটশিপস, কোস্টাল ও প্রটোকল রুটে যাত্রী এবং ক্রুজ সার্ভিস সংক্রান্ত চুক্তি
♦ পানিসীমায় সামরিক শক্তি বৃদ্ধি
♦ ভারতের ভিসা প্রক্রিয়া সহজীকরণ,
♦ দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ
♦ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সহযোগিতা,
♦ স্যাটেলাইট ও মহাকাশ ব্যবস্থাপনা
♦ ভূতাত্ত্বিক বিজ্ঞান,
♦ কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন
♦ সীমান্তহাট স্থাপন সংক্রান্ত চুক্তি এবং
♦ গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি ও গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্প

কি কারণে ভারতের সাথে এই প্রতিরক্ষা চুক্তি? এই চুক্তিতে ভারত এত আগ্রহী কেন?

ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র অনুযায়ী, সহযোগিতার এ ক্ষেত্র বিস্তৃত করতে ভারত ৫০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার প্রস্তাব করেছে। অনুচুক্তি বা সমঝোতা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশে যৌথ সহযোগিতায় প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তৈরি হবে।

চীনের কাছ থেকে নৌবাহিনীতে সাবমেরিন ক্রয় এবং তিন দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো চীনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর সম্পন্ন হওয়ার প্রেক্ষাপটে গত বছরের ৩০ নভেম্বর ভারতের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পরিকর ঢাকা আসেন চীনের সাবমেরিনের বিষয়ে দিল্লির অবস্থান জানিয়ে দিতে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর বহরে সম্প্রতি 'নবযাত্রা' ও 'জয়যাত্রা' নামে দুটি সাবমেরিন যুক্ত হয়েছে। বঙ্গোপসাগরে ব্যবহারের জন্য চীন থেকে কেনা এই সাবমেরিন দুটির বিষয়ে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি খুব একটা ইতিবাচক নয়। ভারতের ধারণা, চীন এ অঞ্চলে তাদের শক্ত ঘাঁটি গাড়তেই বাংলাদেশের কাছে ঋণ দিয়ে সাবমেরিন বিক্রি করে। তাই ভারত বাংলাদেশে ঋণ দিয়ে হলেও প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে মরিয়া এবং ভবিষ্যতে যাতে কোনভাবেই চীন, আমেরিকা ও রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র কিনতে না পারে, তাই ঋণ সুবিধায় সামরিক বাহিনীতে প্রয়োজনীয় সকল অস্ত্র তাদের কাছ থেকে ক্রয়ের চুক্তি করতে এত আগ্রহী।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, প্রতিরক্ষা বিষয়ক এই দুটি এমওইউ বা সমঝোতা স্মারকের মেয়াদ হবে পাঁচ বছর করে, ২৫ বছর নয় (তবে পাঁচ বছর পর পর অটো নবায়ন হবে- এ যেন ভুগোল বোঝানো)। এর একটি দু'দেশের প্রতিরক্ষা সহযোগিতাকে একটা নির্দিষ্ট কাঠামোর ভেতর নিয়ে আসবে। আর অন্যটি হবে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনাকাটা সংক্রান্ত।

চীনের কাছ থেকে পাওয়া দুটি সাবমেরিন 'নবযাত্রা' এবং 'জয়যাত্রা' আনুষ্ঠানিকভাবে নৌবাহিনীতে যোগদানের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, "আমরা কারো সাথে কখনো কোন যুদ্ধে লিপ্ত হতে চাই না। কিন্তু যদি কেউ আমাদের আক্রমণ করে, তাহলে আমরা যেন তার সমুচিত জবাব দিতে পারি, সেই প্রস্তুতি আমাদের সবসময় থাকবে। সে দিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা যা যা করণীয় তা করে যাচ্ছি।"

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমরা যেহেতু কারো সাথে কখনো কোন যুদ্ধে লিপ্ত হতে চাই না এবং আপাতত পাঁচ-দশ বছরেও আমাদের কারো সাথে যুদ্ধ বাধার কোন সম্ভাবনা নেই, তাহলে কেন ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে রাশিয়ার ক্রেমলিনে বসে আপনি ৪.৫% সুদে আট হাজার কোটি টাকা (মোট ২০ কিস্তিতে ১৫ বছরে ঋণের অর্থ শোধ করতে হবে) ঋণ নিয়ে বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে অস্ত্র ক্রয় চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন? কেন ২০৩ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে ২৪ বছরের পুরনো সাবমেরিন কিনলেন? কেনই বা ৫০ কোটি ডলার ঋণ নিয়ে ভারতের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে যাচ্ছেন? যে ভারত অস্ত্র আমদানিতে পৃথিবীর শীর্ষ দেশ, তার কাছ থেকে ঋণ নিয়ে তাদের ব্যবহৃত অস্ত্র কেন কিনতে যাচ্ছেন?

যে চুক্তিতে প্রধান দাবিগুলো থাকার কথা ছিল তিস্তাসহ অভিন্ন ৫৪ নদীর পানির ন্যায্য হিস্যার, সীমান্তহত্যা বন্ধের চুক্তির বিষয়বস্তুর, আলোচনাতে তার কোন হদিস নেই।

প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন দিল্লি সফরে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির গুরুত্ব সম্পর্কে (প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকে কেন্দ্র করে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের ৫ এপ্রিল ২০১৭ সংবাদ সম্মলনে) পররাষ্ট্র মন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, "ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক যে উচ্চতায় পৌঁছেছে, তাতে কোনো একটি চুক্তি হলো কি না, তাতে কিছু আসে যায় না। সম্পর্কের মূল ধারা কোন দিকে যাচ্ছে সেটাই আসল কথা।"

হাসান মাহমুদ আলীর এহেন বক্তব্যের কি মানে কি দাঁড়ায়? বাংলাদেশের জনগন কি চায় তার দরকার নাই, ভারতের সাথে সুসম্পর্ক চাই, চাই ভালো বন্ধুত্ব, চাই ক্ষমতায় টিকে থাকতে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি ব্যক্তিগত সফরে ভারতে যান নি। আপনি ১৬ কোটি বাঙালির প্রতিনিধি হিসেবে রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতে গেছেন। তাই এই বাঙালির এই শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের দাবিগুলোর চুক্তি করুন। তিস্তা চুক্তি করুন, অভিন্ন ৫৪ নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের চুক্তি করুন, সীমান্তে হত্যা বন্ধের চুক্তি করুন। তারা তো আমাদের বন্ধু। ঘনিষ্ট বন্ধুকে তাহলে কাটাতার খুলে (পৃথিবীতে মাত্র তিনটি দেশে সীমানায় কাটাতারের সীমানা প্রাচীর আছে) দিতে বলুন।

আর যদি এই চুক্তিগুলো করতে নাই পারেন, তাহলে চারদিনের রাষ্ট্রীয় সফরকে ব্যক্তিগত সফরে রূপদান করে ভারতের ট্যুরিস্ট প্লেসগুলো ঘুরে ফিরে আসুন। তবুও এ সর্বনাশা চুক্তি করবেন না।

আপনার বাবাই তো বলেছিলেন, "বাংলার মানুষ মুক্তি চায় বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়।" মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বাংলার কৃষক পানি চায়, কৃষি বাঁচাতে চায়, তারা বাঁচতে চায়।

 

  • আল আমিন হোসেন মৃধা: সভাপতি, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, ঢাকা কলেজ।
  • এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত