আল আমিন হোসেন মৃধা

১৯ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০৯

চার্লস ডারউইন : পৃথিবীকে বদলে দিয়েছেন যিনি

'স্কুল ফাঁকি দিয়ে কেউ রবীন্দ্রনাথ হতে পারে না'- ছোট বেলায় স্কুল শিক্ষকের মুখে এ মহান উক্তি কে না শুনেছি। স্কুল ফাঁকি দিয়ে যেমন রবীন্দ্রনাথ হওয়া যায় না, তেমনি আইনস্টাইন ও চার্লস ডারউইনও হওয়া যায় না। বাল্যকালে এ তিনজনই ছিলেন ডানপিটে স্বভাবের এবং স্কুল পালানো ছিল এঁদের স্বাভাবিক ব্যাপার। একাডেমিক শিক্ষা দিয়ে নয়, নিজেদের সৃষ্টিকর্ম দিয়ে যেমন জায়গা করে নিয়েছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে তেমনি জায়গা করে নিয়েছেন শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞান সাধকদের অন্তরে।

পৃথিবীতে কত-শতই না বিজ্ঞানী আছেন, তাঁদের সৃষ্টিকর্মও শত শত। কিন্তু এঁদের মধ্যে এমন কয়েকজন বিজ্ঞানী আছেন, যাদের অসাধারণ চিন্তাশক্তি ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা দিয়ে আমাদের পৃথিবীটাকেই বদলে দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে চার্লস রবার্ট ডারউইন অন্যতম, যিনি প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিবর্তনের ধারণা দেন। ১৮৮২ সালের আজকের এই দিনে ব্রিটেনের বিশিষ্ট জীববিজ্ঞানী, বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদের উৎপত্তি ও বিকাশ তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা চার্লস ডারউইন মৃত্যুবরণ করেন। বিজ্ঞান শাস্ত্রের সাড়া জাগানো এই বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের আজ ১৩৫তম মৃত্যু দিবস।

পৃথিবীকে বদলে দেয়া ব্রিটিশ প্রকৃতিবিদ, ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন এর জন্ম ১২ ফেব্রুয়ারি, ১৮০৯ সালে রবার্ট ডারউইন ও এরেসমাস ডারউইন এর ঘরে ইংল্যান্ডের মফস্বর শহর শ্রুসবারিতে।

ছাত্র হিসেবে মাঝারি গোছের ছিলেন, সবসময়ই প্রথাগত শিক্ষাকে ঘৃণা করতেন। ডানপিটে ছাত্র হলেও আলবার্ট আইনস্টাইন এবং এরকম অনেক বিজ্ঞানীর মতো ডারউইনও জন্মসূত্রে মেধাবী ছিলেন। বাবা রবার্ট ডারউইন ডাক্তার বানানোর ইচ্ছায় তাঁকে মেডিক্যাল স্কুলে ভর্তি করেছিলেন। কিন্তু মেডিক্যালে পড়তে ডারউইনের মোটেও ভালো লাগতো না। তাই মেডিক্যালে পড়া ছেড়ে দিলেন তিনি। তাঁর ছিল প্রকৃতির উপর বিশেষ এক ধরণের টান। এক সময় বাবা রবার্ট ডারউইন বুঝতে পারলেন, তাঁর এই ছেলেকে দিয়ে বিশেষ কিছু হবে না। তাই তাঁকে ধর্মবেত্তা হওয়ার জন্য ইউনিভার্সিটি অফ ক্যামব্রিজে ভর্তি হতে আদেশ করলেন। মজার বিষয়, যার কাজকে অনেক ধর্মবেত্তা ধর্মের চূড়ান্ত অবমাননা হিসেবে উল্লেখ করেছেন, সেই ব্যক্তিই স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছিলেন ধর্মতত্ত্বে। অবশ্য তিনি কোনক্রমে সেই ডিগ্রি পেয়েছিলেন, পরীক্ষার ফলাফল মোটেই ভাল ছিল না।

ডারউইনের সব গবেষণাই খুব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। তবে সবচেয়ে বিখ্যাত গবেষণামূলক কাজ ছিল, প্রাকৃতিক নির্বাচন নিয়ে ধারণা। যার মূল কথা হল- পৃথিবীর সমস্ত প্রাণী প্রজাতিই একই পূর্বপুরুষের কাছ থেকে এসেছে এবং সময়ের সঙ্গে বিবর্তিত হয়েছে।

বিজ্ঞান জগতে যে গুটিকয়েক বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব মাত্র আমাদের জীবন-জগৎ-দর্শনকে তীব্র ঝাঁকুনি দিতে পেরেছে, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো 'প্রাকৃতিক নির্বাচন' তত্ত্ব।

ডারউইন কিন্তু শুধু তার এই প্রাকৃতিক নির্বাচন বিষয়ক মতবাদ দিয়েই ক্ষান্ত থাকেন নি। তিনি বিস্তারিত গবেষণার মাধ্যমে তাঁর এই যুগান্তকারী তত্ত্বের সপক্ষে শক্ত প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। সেটা করার জন্যে পাঁচ বছর ধরে এইচএমএস বিগল নামের একটি নৌ জাহাজে গবেষণায় কাটিয়েছিলেন।

প্রকৃতির প্রতি ডারউইনের গভীর আগ্রহের কারণে তিনি এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞান অধ্যয়নে মনোযোগী ছিলেন না, বরং তিনি সামুদ্রিক অমেরুদণ্ডী প্রাণী নিয়ে গবেষণা করতে থাকেন। অতঃপর ধর্মতত্ত্ব নিয়ে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন তাঁর মধ্যকার প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের আগ্রহকে অনুপ্রাণিত করে।

ডারউইন ১৮৩১ সালে পাঁচ বছরের জন্য প্রকৃতিবিদ হিসেবে সমুদ্র ভ্রমণে 'বিগল' এ চড়ে বসেন। বিগল ছিল ব্রিটিশ নৌবাহিনীর জরিপ জাহাজ, যা দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলে জরিপ কাজ চালাতো। এই নৌ ভ্রমণের অভিজ্ঞতাকে পরবর্তীতে ডারউইন বলেছেন, "আমার প্রথম প্রকৃত শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ"। পাঁচ বছর তিনি জাহাজে চড়ে পৃথিবী চষে বেড়িয়েছেন। তখন তাঁর হাতে চিন্তা করার মত যথেষ্ট সময়ও ছিল। এসময়ই প্রাকৃতিক বিশ্ব ডারউইনের সামনে উন্মোচিত হয়ে পড়ে। এই অভিজ্ঞতাই তার সকল গবেষণাকর্মের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছিল।

বিগল জাহাজের ৫ বছরের যাত্রাপথে অনেকগুলো স্থানের পরিবেশ ও প্রাণীকূল ডারউইনের পরবর্তী গবেষণায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ক্রান্তীয় ব্রাজিলের বৈচিত্র্যময় প্রজাতিসমূহ, বুয়েনস আইরেসের ৪০০ মাইল দক্ষিণে একটি বিশাল শ্লথের জীবাশ্ম আবিষ্কার (এছাড়াও তিনি বেশ কিছু জীবাশ্মের সন্ধান পেয়েছিলেন)। জীবাশ্ম আবিষ্কারের পর তিনি এই প্রাণীগুলোর বিলুপ্তির কারণ নিয়ে ভাবনায় পড়ে গিয়েছিলেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানটি হচ্ছে গালাপাগোস দ্বীপ, যেখানে ডারউইন পাঁচ সপ্তাহ ছিলেন। এই দ্বীপে যখন বিগল পৌঁছুলো তখন সেখানে প্রচণ্ড গরম ছিল। তিনি কচ্ছপ ও হরবোলা পাখির দুটি পরস্পর সম্পর্কিত প্রজাতি পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে লক্ষ্য করলেন, এই দুটি প্রজাতিই আশপাশের বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলোতে এমনভাবে উপনিবেশ স্থান করেছে, যাতে মনে হয় তারা একই পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তিত হয়ে এই পর্যায়ে এসেছে।

পানিতে থাকার সময়ও ডারউইন বই পড়ায় ব্যস্ত ছিলেন। জাহাজে বসেই তিনি চার্ল লায়েলের 'Principles of Geology' বইটি পড়ছিলেন। এই বইয়ে উল্লেখ ছিল, বর্তমানে যে হারে ভূমিক্ষয় ও আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত হচ্ছে এবং পলি জমছে, অতীতেও ঠিক একই হারে হতো। এই ধারণাকে বলা হয় 'uniformitarianism'। এই বইয়েই লায়েল 'catastrophism' প্রকল্পকে অস্বীকার করেছিলেন। এই প্রকল্পে বলা হতো, আকস্মিক অগ্ন্যুৎপাত বা কোন অতিপ্রাকৃত শক্তির প্রভাবেই পৃথিবীর ভূভাগ গঠিত হয়েছে। আন্দিসের একেবারে অভ্যন্তরভাগে অভিযাত্রীরা একটি সুপ্রাচীন সামুদ্রিক তলানি উদ্ধার করেছিল, যা প্রাকৃতিক কোন কারণে মাটির ৭০০০ ফুট নিচ থেকে উপরে উঠে এসেছে। এই আবিষ্কারই লায়েলের তত্ত্বকে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিল।

ডারউইন ধারণাও করতে পারেননি যে, তাঁর এই অভিযান জৈব বিজ্ঞানে আমূল পরিবর্তন এনে দেবে। ৫৭ মাসের এই অভিযানে কিন্তু আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে যাওয়ার মতো কোন ঘটনা ঘটেনি। ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন যেমন তার 'annus mirabilis' গবেষণাপত্রে হঠাৎ করেই বিশেষ আপেক্ষিকতা, ব্রাউনীয় গতি ও এ ধরণের আরেকটি ধারণার জন্ম দিয়ে রাতারাতি বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী বনে গিয়েছেন, তেমন কিছু ডারউইনের ভাগ্যে জোটেনি। এই অভিযানকে তাই ক্ষণিকের বিস্ফোরণ না বলে পাঁচ বছরের এক অমূল্য তথ্যভাণ্ডার বলতে হয়।

১৮৩৬ সালের অক্টোবরে বিগল ইংল্যান্ডে ভিড়ার আগেই ডারউইনের লেখা চিঠিগুলো সেখানকার বিজ্ঞানী মহলে ছড়িয়ে পড়েছিল। চিঠিগুলোর সুবাদে তিনি ইতিমধ্যেই পণ্ডিত বনে গিয়েছিলেন। এই খ্যাতি তাঁর বাবার ধর্মবেত্তা বানানোর ইচ্ছাকেও দমিয়ে দিয়েছিল। তাঁর এই ভ্রমণ শেষে তিনি লন্ডনের একটি পশু মার্কেট পরিদর্শন করেন। তিনি এখানে দেখতে পান যে 'Breeders' রা সংকরায়নের মাধ্যমে নতুন চরিত্রের গরু উদ্ভাবন করছে। এই সব অভিজ্ঞতা লাভের পর তিনি ১৮৫৯ সালে তাঁর একটি বই প্রকাশ করেন 'The Origin of Species' নামে।

অরিজিন অব স্পিসিস সংক্রান্ত যে চিন্তাভাবনা ও সিদ্ধান্তে ডারউইন পৌঁছান, তার ২০ বছর পর পুস্তকাকারে তাঁর আবিষ্কার ও সিদ্ধান্ত ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত হলো। পৃথিবীর জ্ঞানভান্ডারে সংযোজিত হলো এক ঐতিহাসিক সম্পদ- অরিজিন অব স্পিসিস।

ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠলেন সারা দেশের ধর্মগুরুরা। এই তত্ত্ব বাইবেলোক্ত সৃষ্টিতত্ত্বের বিরোধী- এই বলে আক্রমণ করা হলো ডারউইন তত্ত্বকে। শুধু সভা-সমিতি নয়, কার্যক্ষেত্রে নানা ভাবে ডারউইনকে হেয় করার চেষ্টা করা হলো। মানুষকে বানরের মতো করে কার্টুন আঁকা হলো। 'Monkey law' নামে আমেরিকার বিভিন্ন প্রদেশে ডারউইন তত্ত্ব পড়ানো নিষিদ্ধ হলো।

তবে বইটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়লেন ফ্রিডরিক এঙ্গেলস। পরের বছর কার্ল মার্কস এই বইটি পড়ে ১৮৬০ সালের ১৯ ডিসেম্বর এঙ্গেলসকে লিখলেন, আমাদের ধারণার প্রাকৃতিক-ঐতিহাসিক বুনিয়াদ সৃষ্টি করে দিয়েছে বইটি।

ডারউইনের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ঋণ স্বীকারের উদ্দেশে 'ক্যাপিটাল' গ্রন্থটিতে ডারউইনের নামেই উৎসর্গ করেছিলেন মার্কস।

ডারউইন তত্ত্বের অনেককিছুই আজ আধুনিক বিজ্ঞানের চর্চায় পরিত্যক্ত, সংশোধিত হচ্ছে। কিছু কিছু প্রশ্ন নিয়ে চলছে গবেষণা, বিতর্ক। এটাই স্বাভাবিক। কারণ বিজ্ঞান এগিয়ে চলে নানা জনের নানা প্রয়াসের মধ্য দিয়ে। যদিও ডারউইনের মতো দিকপালদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। পৃথিবীর ইতিহাসে ডারউইন ও তার বিবর্তন তত্ত্বের মৃত্যু নেই।

বিগল অভিযান থেকে ফেরার পরই ডারউইন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ১৮৮২ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্তই তিনি অসুস্থ ছিলেন, যদিও এর কারণ সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু জানা যায়নি। মাথা ব্যথা থেকে শুরু করে হৃদরোগ, মাংসপেশীর খিঁচুনি ইত্যাদি সব ধরণের লক্ষণই তাঁর মধ্যে দেখা গিয়েছিল।

বিজ্ঞানী ডারউইন যেমন বিজ্ঞান নিয়ে ভাবতেন, তেমনি সমাজ নিয়েও ভাবতেন। দাস প্রথা নিয়ে যখন মানুষ সোচ্চার, উনিও তাদের পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, "আমি দেখতে পাচ্ছি মানুষ ধীরে ধীরে দাসত্বের বিরুদ্ধে কিভাবে সোচ্চার হয়ে উঠছে। ব্রিটেনের জন্য এটা কতই না গর্বের ব্যাপার হবে, যদি সে প্রথম ইউরোপিয়ান দেশ হিসেবে এই প্রথাকে বিলুপ্ত করতে পারে।"

ডারউইনের বিজ্ঞানী হিসেবে খ্যাতির কারণে তিনি ছিলেন ১৯ শতকের মাত্র পাঁচজন রাজ পরিবার বহির্ভূত ব্যক্তিদের একজন, যারা রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সম্মান লাভ করেন। ডারউইনকে ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবিতে সমাহিত করা হয়, বিজ্ঞানী জন হার্শেল ও আইজ্যাক নিউটনের সমাধির পাশে। তাঁর এই ১৩৫তম প্রয়াণ দিবসে জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলি।

(সহায়ক বই: অরিজিন অফ স্পিসিস, চার্লস ডারউইন। বইটি ভাষান্তর করেছেন শান্তিরঞ্জন ঘোষ)

 

  • আল আমিন হোসেন মৃধা: সভাপতি, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, ঢাকা কলেজ।
  • এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত