মাসকাওয়াথ আহসান

২৩ এপ্রিল, ২০১৭ ১৯:৫০

রাইফেল, টুপি, আওরাত

রমেল একটা কুয়াশা ঢাকা ভোরে সবুজ ঘাসের শিশিরে পা ভিজিয়ে হাঁটতে থাকে। হঠাত কল্পনা এসে হাত ধরে, শীতে ঠক ঠক করে কাঁপছিলো রমেল। কল্পনা একটা শাল এগিয়ে দেয়। ওটা গায়ে দিতেই শরীর থেকে পেট্রোলে পোড়া যন্ত্রণাটা কমে যেতে থাকে।

রমেল জিজ্ঞেস করে, আমরা কোথায় দিদি!

--আমরা সেই স্বপ্নালোকে; যেখানে রাষ্ট্র নেই, মিলিটারি নেই।

কয়েকটা তরুণ গোল হয়ে বসে শীত পোহাচ্ছে; খড়কুটো জ্বেলে।

কল্পনাদি পরিচয় করিয়ে দেয়, এরা মিজোরাম, মনিপুর, কাশ্মীর, বেলুচিস্তানের ছেলে।

মনিপুরের ছেলেটা হাত বাড়িয়ে দেয়, এসো রমেল; আমরা তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। আর কোন ভয় নেই; এখানে কেউ তোমাকে গুলি করবে না; পেট্রোলে পুড়িয়ে মারবে না। আমাদের এখানে নানারকম সবুজ বনানী আছে; শুধু নেই জলপাই বন।

একজন প্রবীণ হেঁটে আসতে থাকেন। তাকে দেখিয়ে কল্পনাদি বলে, উনি নকশাল বাড়ী আন্দোলনে ছিলেন।

ভদ্রলোক এসে সবাইকে সুপ্রভাত জানিয়ে জিজ্ঞেস করে, কত রক্তের নেশা এই রাষ্ট্রগুলোর বুঝতে পারিনা। আমার বাবা বৃটিশের বিরুদ্ধে লড়েছেন। আমি লড়েছি স্বাধীন ভারতের দিল্লীশাহীর বিরুদ্ধে; আমি আজো বুঝিনি রাষ্ট্র কেন!

বেলুচিস্তানের তরুণ বলে, কাকা আমার দাদা বৃটিশের বিরুদ্ধে লড়েছেন, আমি লড়েছি স্বাধীন পাকিস্তানের ইসলামাবাদশাহীর বিরুদ্ধে; এ লড়াইয়ের শেষ কোথায়!

রমেল খুব বিমর্ষ হয়ে বলে, এ লড়াইয়ের শেষ নেই। এই যে দেখুন আমাকে কী নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করলো রাষ্ট্র।

কল্পনাদি রমেলের মাথায় স্নেহের হাত রেখে বলেন, মন খারাপ করিসনা। ঐ নির্যাতন আর হত্যার মুহূর্তগুলোই যা কষ্ট। তারপর এই দেখ অনন্ত শান্তির আশ্রয়; এখানে হৃদয়হীন রাষ্ট্র নেই, ঘাতক সেনাবাহিনী নেই; নিজের এলাকার দালাল রাজনীতিবিদ নেই।

পাকিস্তানের মার্দান ইউনিভার্সিটিতে মিথ্যা ব্লাসফেমির অভিযোগে গণপিটুনিতে নিহত মার্শাল খানকে হেঁটে যেতে দেখে কল্পনাদি তাকে ডাকে। রমেলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়।

মার্শাল বলে, আমরা তো প্রায় একইসময়ে এলাম। তা তুমিও কী ব্লাসফেমির মিথ্যা অভিযোগের শিকার!

রমেল বলে, অলিখিত ব্লাসফেমিই বলতে পারো। তবে তুমি আমি "বিটুইন মস্ক এন্ড মিলিটারি।"

নকশাল প্রবীণ বলেন, ঐ একই ব্যাপার। সামাজিক সাম্যের আন্দোলনকে বাধা দিতে, অধিকার আদায়ের দাবীকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে প্রতিটি রাষ্ট্রই টুপি-রাইফেল নিয়ে হাজির হয়ে যায়। আজকাল বামপন্থাটা নেই। তাই ধর্মের কাকতাড়ুয়া বানিয়ে নিয়ে পাকিস্তান-ভারত-বাংলা­দেশ নেমে পড়েছে চাঁনমারিতে। অনুভূতির বাতাসা-সন্দেশ বিলাচ্ছে রাজনীতিকেরা।

কাশ্মীরের তরুণ জিজ্ঞেস করে, রাষ্ট্র কেন! আমি তো শৈশব থেকে মিলিটারি ট্রাকের ভারী চাকার শব্দে ভয়ে ভয়ে বেঁচেছিলাম। যখনই সাহস করে প্রতিবাদী হয়েছি; বুলেট আমার বুক ঝাঁঝরা করে দিয়েছে!

বেলুচ তরুণ দূরে ছুঁড়ে দেয়া শূন্য দৃষ্টিতে অশ্রু বাষ্প ছড়িয়ে বলে, মিলিটারিরা আমার বোনকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলো আমাদের সবার সামনে। তারপর মিসিং পারসন-এর তালিকায় তার নামটা ঢুকে গেলো।

কল্পনাদির বুকটা ধক করে ওঠে। স্মৃতিতে সেই বর্বর সময়ের ঘটনাগুলো তোলপাড় তোলে। তাকে নির্যাতন ও হত্যা করে দিব্যি সেই ঘাতক চাকরি করে যাচ্ছে। রাজা যায়, রাজা আসে; কিন্তু ঘাতকেরা থেকে যায় রাজসিক ছায়ায়।

দূরে তনুকে হেঁটে যেতে দেখা যায়। নকশাল প্রবীণ ডাকেন, এসো মা; দেখো তোমার নতুন এক ভাই এসেছে। রমেল ওর নাম।

তনু রমেলকে জিজ্ঞেস করে, ওরা কী তোমার জীবন নিয়েই ক্ষান্ত দিয়েছে; নাকি আমার বাবা-মা'র মতো তোমার বাবা-মাকেও ভয় দেখাচ্ছে, বিচার চাইবি না; বিচার চাইলে একেবারে জানে মেরে ফেলবো।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত