শামীম আহমদ চৌধুরী

২৪ এপ্রিল, ২০১৭ ০২:৫৪

জুয়েল গাজীর মামলা, কানাডা আদালতের রায় ও একটি পর্যালোচনা

কানাডার এক আদালতের বিচারক বিএনপিকে টেরোরিস্ট সংগঠন হিসাবে অভিহিত করেছেন, এমন এক সংবাদ বাংলাদেশের পত্র পত্রিকায় এবং ইলেকট্রিক মিডিয়ায় জোরালোভাবে প্রচার করা হয়েছে। বিএনপির বিরুদ্ধে কোন মামলা নাই, শুনানি নাই হঠাৎ করে “উড়ে এসে জুড়ে বসার মত” এমন রায় কোথা থেকে এলো, আর কেইবা দিলো; এবং কেনইবা দিল? একটু খোঁজ নিয়ে দেখা দরকার।

বিএনপির মত এত বড় একটা সংগঠনকে কানাডার বিচারক টেরোরিস্ট সংগঠন হিসাবে ঘোষণা করার দাবি যদি সত্যি হয়ে থাকে: The New York Times, The Telegraph এর মতো পত্রিকাগুলোর কথা বাদই দিলাম, নিশ্চয় কানাডার প্রথম সারির সকল সংবাদপত্র এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এ খবরকে হেডলাইন হিসাবে প্রচার করেছে? হেডলাইনে না থাকুক অন্তত পিছনের পাতায় তো এ খবর নিশ্চয়ই থাকবে? আমরা গুগল, ইয়াহু, বিং সার্চ করে এই খবরের ছিটেফোঁটাও পাইনি। না, পত্রিকায় না ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়।

কানাডার মিডিয়া এতো বড় একটা খবর বেমালুম মিস করে ফেললো আর বাংলাদেশের পত্রপত্রিকাগুলো এই সংবাদটা মুহূর্তের মধ্যে পৌঁছে গেলো তা কি করে সম্ভব? বাংলাদেশের প্রতিটি সংবাদ মাধ্যম কানাডা প্রবাসী সাংবাদিক সওগাত আলী সাগরের উদ্ধৃতি দিয়ে সেকেন্ড হ্যান্ড খবর হিসাবে এই সংবাদটি ছেপেছে। “জনৈক জুয়েল গাজীর এসাইলাম আবেদনের রিভিউয়ে বিচারক বিএনপিকে টেরোরিস্ট সংগঠন হিসাবে অভিহিত করেছেন।

জুয়েল গাজী তারেক রহমানের মত কোন লিডার না যে প্রতি মুহূর্ত তাকে সবাই ফলো করছে? বিএনপি, ছাত্রদল বা তার অঙ্গ সংগঠনের কেন্দ্রীয় কোন লিডার না যে কেউ তাকে ফলো করবে? তাহলে প্রশ্ন থেকে যায় কোথাকার কোন নাম গন্ধহীন, পদ-পদবিহীন এক জুয়েল গাজীকে ফলো করা হলো?

যদি ফলো না করা থাকে, তাহলে বুঝতে হবে সেখানে বড় ধরণের কোন ঘাপলা আছে! পূর্বে ডিনাই হওয়া হাজারো বিএনপি কর্মীর এসাইলাম রিভিউয়ের রায়ের সাথে জুয়েল গাজীর রিভিউকে মিলিয়ে দেখা যেতে পারে বিএনপি সম্পর্কের তখনকার বিচারকের সাথে এখনকার বিচারকের পার্থক্য কিসের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে? ঘাপলাটা কোথায়?

কোর্ট নয়, জুয়েল গাজীই বিএনপিকে টেরোরিস্ট সংগঠন দাবি করেছে
সাংবাদিক সওগাত আলী সাগর তার ফেইসবুকে ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছেন "কানাডার ফেডারেল কোর্টের একটি রায় পড়ছি। মামলার বিষয় হচ্ছে The Officer’s finding that he or she had reasonable grounds to believe that the BNP (Bangladesh Nationalist Party) engaged, is engaging or will engage in terrorism, is reasonable.” রায়ের বক্তব্যগুলো চুম্বকের মতো টেনে ধরছে।"

তার স্ট্যাটাস থেকে বুঝা যাচ্ছে মামলার বিষয় হচ্ছে বিএনপি টেরোরিস্ট সংগঠন কিনা এটা নির্ধারণের মামলা পড়ছেন, অথচ এটা জুয়েল গাজীর ডিনাই হওয়া এসাইলামের রিভিউ। তাহলে কি এই এসাইলাম আবেদনের মূল উদ্দেশ্যই ছিল বিএনপিকে টেরোরিস্ট সংগঠন হিসাবে চিহ্নিত করানো? এসাইলাম আবেদন করে নিজের প্রতিপক্ষকে ভয়ানক সন্ত্রাসীর অপবাদে ঘায়েল করার এমন চতুর ইউনিক আইডিয়া জগতে এটাই প্রথম! চাকুরীর আবেদনে প্রতিপক্ষের লোকজন খারাপ বলে আসা।

এসাইলাম আবেদনের মূল উদ্দেশ্য থাকে কানাডায় বসবাসের সুযোগ চাওয়া। সাধারণত লোকে "সরকারের নির্যাতনে জীবন বিপন্ন তাই বেঁচে থাকার জন্য কানাডায় এসাইলাম চাই," এমনটাই লিখে থাকে। এসাইলাম ডিনাই হয় নির্যাতনের অভিযোগ মিথ্যা, আবেদনকারীর রেকর্ড খারাপ অথবা আবেদনকারী টেরোরিস্ট দলের সাথে (আলকায়দা, আলসাবাব, আইএসএস, এমকিউএমের মতো) সম্পর্ক থাকার কারণে। যে আবেদনকারী নিজ থেকেই বলে আমি যে দল করি এটা (আলকায়দা , আলসাবাব, আইএসএস, এমকিউএম) এর মত খারাপ তাহলে সেটা আর যাই হোক কানাডা বসবাসের আশায় যে করা হয়নি তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা না!

ইমিগ্রেশন অফিসার যে দলের নামই জানেনা তাকে বলতেছে এই দল একটা টেরোরিস্ট সংগঠন! কোর্ট নয়, জুয়েল গাজীই বিএনপিকে টেরোরিস্ট সংগঠন হিসাবে অভিহিত করেছে। জুয়েল গাজী তার আবেদন পত্রে বিএনপির সদস্য হিসাবে দাবি করলেও আওয়ামী লীগ বা হাসানুল হক ইনুর কথাই তুলে ধরেছেন। জুয়েল গাজী নিজেকে বছরের পর বছর ধরে দলের একজন একনিষ্ঠ এক্টিভিস্ট হিসাবে দাবি করলেও দলের কোন পদে ছিলেন বলে উল্লেখ করতে পারেননি। শুধু একজন সাধারণ কর্মী হিসাবে এসাইলাম প্রার্থনা করেছেন।

জুয়েল গাজীর আবেদনের সারসংক্ষেপ ৭ নং প্যারাগ্রাফে আছে। তার অনুবাদ নিচে দেওয়া হলো।
আবেদনকারী ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে,"বিএনপি হল এমন একটি পার্টি যে কিনা সশস্ত্র সংগ্রাম বা সহিংসতার ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্য।" তিনি উল্লেখ করেছেন যে যখন একটি ধর্মঘট ডাকা হয় তখন তার দল গোলাবারুদ এবং অস্ত্র ব্যবহার করে।

বিএনপি, বিরোধী দল হরতালের সময় সশস্ত্র যুদ্ধের মত সমরাস্ত্র ব্যবহার করে। তারা হাতবোমা, পিস্তল, এবং বড় তলোয়ার ব্যবহার করে। তারা সরকারের বড় বড় কর্তাব্যক্তিকে ধর্মঘটের সময় আক্রমণ করেন।" এ আবেদনকারী বলেছেন যে হরতালের সময় কেউ ঘর হতে বাহির হতে পারেনা, অফিস বন্ধ থাকে, সব ধরণের যাতায়াতের যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ থাকে, রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। তিনি উল্লেখ করেছেন যে বিরোধী দল এই কাজগুলো করে।

এ আবেদনকারী তার IMM 5669 ফর্মে বিএনপির ভয়ানক পদ্ধতি ব্যবহারের আরো বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, তিনি এমন একটা দলের সদস্য ছিলেন যাদের কাজের ধরণ ছিল ক্রিমিনাল এক্টিভিটি বা অপরাধীর কাজকর্ম। .....তিনি বর্ণনা করেছেন যে বিএনপি এমন গ্রুপের সহিত মিলে যে কিনা লাঠি ব্যবহার করে মানুষকে আঘাত করে এবং পিস্তল দিয়ে মানুষকে গুলি করে এবং বোমা মারে। তারা দোকানপাট জ্বালায়। যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হলো তিনি কি ব্যক্তিগতভাবে এসব কাজকর্মে জড়িত ছিলেন? তিনি বলেন যে, তিনি তা করেননি এবং এসব থেকে নিজেকে দূরে রাখতেন। তিনি নিজেকে দলের সাধারণ সদস্য হিসাবে উল্লেখ করেছেন। আবেদনকারী বলেছেন যে তিনি মিছিল মিটিংয়ে উপস্থিত থাকতেন এবং যখন একটা হরতাল ডাকা হতো তাতে তাদেরকে উপস্থিত থাকতে হতো। গাজী বর্ণনা দেন যে, তাকে বিভিন্ন সময় ককটেল ছুড়তে বলা হলে তিনি কখনও ককটেল ছুঁড়ে মারেননি এবং শুধু তাদের সাথেই থেকেছেন। তিনি হরতালে গাবতলি এবং মিরপুর অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি আরো স্বীকার করেছেন যে, হরতালে বিএনপির সদস্য দ্বারা সাধারণ মানুষকে আঘাত করতে দেখেছেন।

কানাডায় আসার দুই মাস পূর্বে বিএনপি একটা গাড়ির গতিরোধ করে যাত্রীদেরকে বের করে দেয় এবং তাদের মারধর করে। তিনি বর্ণনা করেছেন, যখনই এই সমস্ত ঘটনা ঘটে আমি তখন সে স্থান থেকে চলে যাই এবং লুকিয়ে থাকি কারণ পুলিশ সেখানেও থাকে। তিনি যখন পার্টিকে বললেন যে, তিনি আর এ সমস্ত ধ্বংসাত্মক কাজ করবেন না পার্টি তাকে বাধ্যতামূলক কাজ করতে বললো কারণ সামনে নির্বাচন আসছে। তিনি বললেন যে তিনি এসব ছেড়ে দেবেন কারণ তিনি পুলিশের হাতে বন্দি হতে চাননা। তিনি বললেন যে বিএনপি তাকে মেরে তার মৃতদেহ লুকিয়ে রাখতে পারে।

সন্ত্রাসী কি এসাইলামে নিজেকে সন্ত্রাসী দাবি করে
সাধারণত এসাইলাম প্রার্থনাকারী নিজেকে তার দলের কোন পদে থাকার প্রমাণ হিসাবে সংগঠনের সভাপতি সাধারণ সম্পাদক কাছ থেকে দলীয় প্যাডে লিখিত আকারে সার্টিফিকেট দাখিল করে থাকে। দলের কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার প্রমাণ হিসাবে এক্টিভিটির বিভিন্ন সময়ের পত্রিকার কাটিং, ফটোগ্রাফ, ভিডিওগ্রাফি দাখিল করে থাকে।

সবাই এসাইলামে উকিল নিয়োগ করে যাতে আবেদন করতে কোন ধরনের ভুল না হয়। উকিলের প্রথম কাজই থাকে যে কারণগুলো থাকলে একজন আবেদনকারীর আবেদন ডিনাই হয় সে কারণগুলোকে অ্যাপ্লিকেশন পেপার থেকে বাদ দেওয়া। যে দোষগুলো থাকলে একজন আবেদনকারীকে কানাডায় এসাইলাম দেওয়া হবেনা, স্পষ্ট করে কানাডার আইনে লিখা আছে ([24] Sections 33 and 34(1) of the IRPA আর [25] Section 83.01(1) of Criminal Code ), গাজীর এটর্নি তার এসাইলামের আবেদনে শুধু এই দোষগুলোই যে তার আছে তা স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন, দেখেই বুঝা যায় আবেদনকারী এবং এটর্নি উভয়ের কুমতলব আছে।

নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমান আর ঢাকার ত্রাস অভি এক সময় কানাডায় এসাইলাম চেয়েছিলেন। অভি আজও আছেন। তাদের একজন কি তার অ্যাপ্লিকেশনে লিখেছেন ..
# আমি নারায়ণগঞ্জের ত্রাস, গডফাদার, প্রতিটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের আদেশদাতা হিসাবে উল্লেখ করেছেন। আমি দেশে থাকলে আমার প্রতিপক্ষ আমাকে মেরে ফেলবে আমি যাদের মেরেছিলাম। আর আরেকজন.. .
# এসাইলাম অ্যাপ্লিকেশনে ঢাকার ত্রাস, গডফাদার আর তিন্নি হত্যাকারী হিসাবে দাবি করেছেন? দেশে থাকলে তিন্নির পক্ষের লোক মেরে ফেলবে তাই কানাডায় এসাইলাম চাই।

কানাডা হত্যাকারিদের অভয়ারণ্য না যে তারা নিজেকে এক একজন হত্যাকারি হিসাবে দাবি করবে?
পকেটমার নাকি জেলে গেলে নিজেকে ডাকাত হিসাবে দাবি করে, আর মারামারির মামলায় জেলে গেলে নিজেকে খুনি হিসাবে দাবি করে। কারণ, খুনি শুনলে সবাই নাকি দাঁড়িয়ে কুর্নিশ করে। তা না হলে নাকি পুরাতন দাগী আসামিদের গা টিপে দেয়া আর কত শত ফুটফরমাশ খাটতে হয়।

কানাডা কি বাংলাদেশের জেলের মত জোর যার মুল্লুক তার অবস্থা? তা নাহলে জুয়েল গাজী তার আবেদনপত্রে কেন বিএনপিকে সন্ত্রাসী, মানুষ মারা দল এবং তিনি তার সদস্য হিসাবে দাবি করবেন?

জুয়েল গাজীর এসাইলাম আবেদনকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উপস্থাপিত
জুয়েল গাজীর এসাইলাম আবেদন যে কত বড় একটা নাটক তা বুঝাতে হলে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট নিয়ে একটা এনালগি তুলে ধরা দরকার। এখানে এসাইলামকে ধরা হলো ঘরজামাই হয়ে শ্বশুরবাড়িতে থাকা আর এটর্নি/ উকিল ধরা হলো বিয়ের ঘটক হিসাবে।

একমাত্র মেয়ের পিতা ঘরজামাই হিসাবে ভাল-গুণী পাত্র খুঁজছেন জেনে ঘটক পাত্রের বায়োডাটা সহ পাত্রকে সাথে নিয়ে হাজির হলেন। সম্ভাব্য ঘরজামাই তার যোগ্যতা কি জিজ্ঞেস করতেই গড়গড় করে বলা শুরু করলো "আমি একজন সিরিয়াল রেপিষ্ট, খুনি, হাতবোমা, পেট্রোলবোমা মেরে হরতালে মানুষ খুন করা গোষ্ঠির যুবক। শুধু এগুলোই নয় আরো হাজারো অপকর্ম আমাদের গ্রামের লোকজন করে। বায়োডাটায় ঘটক এগুলো স্পষ্ট করে লিখেছে যেন যে কেউ পড়লে বুঝতে পারে, জামাই একটা রেপিষ্ট গ্রামের বাসিন্দা।

জামাই জোরগলায় যদি দাবি করে যে সে ব্যক্তিগতভাবে রেইপ করেনা, গোত্রের লোক যখন রেইপে যায় সে শুধু তাদের সঙ্গ দেওয়ার জন্য সাথে থাকে, সম্ভাব্য ঘরজামাইয়ের এমন বাহারি গুণ শোনে মেয়ের বাবা "গ্রামের লোকজন যে রেইপিষ্ট এটা প্রমাণে থানার সার্টিফিকেট এনে দাও?" না বলে আপদকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিদায় করে দেবে। এমন গুণের অধিকারী ঘর জামাই প্রার্থীকে যে ঘটক তার বাড়িতে নিয়ে এসেছে চূড়ান্ত ভদ্রলোক না হলে তার পাজামা-পাঞ্জাবি খুলে রেখে দেওয়াই স্বাভাবিক!

আত্ম-স্বীকৃত রেইপিস্টের জন্য বিয়ের পয়গাম নিয়ে কোন বাড়িতে যাওয়ার মানে হলো সেই বাড়ির মান সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া নতুবা যে গ্রামকে সে রেইপিস্টের গ্রাম হিসাবে উল্লেখ করেছে সে গ্রামের কেউ যাতে এ মেয়েকে বিয়ে করতে না পারে এর জন্য আগে থেকেই ঐ গ্রাম সম্পর্কে কন্যার বাবার মনে খারাপ ধারনা তৈরি করে রাখা।

এসাইলাম রিভিউয়ের পর্যালোচনার জুয়েল গাজী তার আবেদন পত্রে বিএনপিকে একটি জঘন্যতম টেরোরিস্ট অর্গানাইজেশন হিসাবে উল্লেখ করেছে। কানাডার সরকার, আদালত বা লাইব্রেরির ডকুমেন্টের কোথাও বিএনপিকে টেরোরিস্ট অর্গানাইজেশন হিসাবে নির্ধারিত করার কোন প্রমাণপত্র না থাকায় ইমিগ্রেশন অফিসারকে ইন্টারনেট সার্চ ইঞ্জিনে (গুগল, ইয়াহু, বিং ইত্যাদি ) সার্চ টার্ম '“Bangladesh nationalist party terrorist acts” লিখে ডকুমেন্ট জোগাড় করতে হয়েছে (প্যারাগ্রাফ নং ১১)। জুয়েল গাজী যদি বিএনপিকে টেরোরিস্ট অর্গানাইজেশন দাবি না করতো আজ পর্যন্ত কোন ইমিগ্রেশন অফিসারকে এমন সার্চ করতে হতোনা।

বিএনপিকে টেরোরিস্ট সংগঠন হিসাবে প্রচার করার জন্য জুয়েল গাজীর এসাইলাম আবেদনটাকে এমনভাবে ফ্রেমিং করেছে (ভিত্তি: যেমন আমরা জ্বালাই-পোড়াই, লাটি-ছুড়ি-পিস্তল দিয়ে মারি-কাটি ইত্যাদি) যে বিচারক অযাচিতভাবে মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছেন “he or she had reasonable grounds to believe that the BNP..” ( paragraph #37); তার যৌক্তিক ভিত্তি আছে বিএনপিকে টেরোরিস্ট সংগঠন ভাবার।

এখানে "reasonable grounds" বলতে গাজীর স্বীকারোক্তি (যেমন আমরা জ্বালাই-পোড়াই, লাটি-ছুরি-পিস্তল দিয়ে মারি-কাটি ইত্যাদি), আর ইন্টারনেট সার্চ করে পাওয়া ইনফরমেশনকে বোঝাচ্ছে। গাজী যদি বিএনপিকে টেরোরিস্ট সংগঠন দাবি না করতো তাহলে অফিসারকে সার্চ করতে হতো না। পুরো সার্চটাই হয়েছে গাজীর তথ্যের উপর ভিত্তি করে। গাজী যদি মিথ্যে হয়ে থাকে তাহলে সার্চের আর কোন মূল্য থাকেনা।

ইমিগ্রেশন অফিসাররা সাধারণত এসাইলাম প্রার্থীর লুকায়িত তথ্য খুঁজে বাহির করে যাতে কোন টেরোরিস্ট অথবা খারাপ মানুষ কানাডার এসাইলাম নিয়ে কোন খারাপ কাজ না করতে পারে। খারাপ দলের সদস্যরা যদি এসাইলাম প্রার্থনার সময় নিজ থেকেই তার দল যে খারাপ এটা তুলে ধরে তাহলে ইমিগ্রেশন অফিসারদের কাজ পুরোটাই লাঘব হয়ে যাবে! বাস্তবতা এমন হলে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বলতোনা যে সাধারণ এসাইলাম প্রার্থীর নাম ধরে আইএসএস আমেরিকায় ঢুকে দেশটা নষ্ট করে ফেলবে। প্রকৃত টেরোরিস্ট সংগঠনের সদস্যরা নিজেদের পরিচয় গোপন রাখে বলেই এমনটা প্রেসিডেন্টকে ভাবতে হচ্ছে।

হত্যা, ধর্ষণের মত জুয়েলের আবেদনটাও মিথ্যা
বাংলাদেশে অনেক মামলা আছে বাবা নিজ হাতে সন্তানকে হত্যা করে প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করতে আর নিজের মেয়েকে ভাড়াটে দিয়ে ধর্ষণ করায় যাতে মিথ্যা মামলা দিয়ে প্রতিপক্ষকে জেলের ভাত খাওয়ানো যায়। এই লাইনেই শরিক হয়েছে জুয়েল গাজীর মামলা এসাইলাম আবেদনের নাম বিএনপিকে টেরোরিস্ট হিসাবে প্রমাণিত করার অপচেষ্টা।

শুনেছি গাঁয়ে চোর ধরা খেলে তার সাথীও চোর হিসাবে এমন মানুষদের নাম বলে যাদের সাথে তার শত্রুতা অথবা যারা চুরিকে খারাপ মনে করে। একটা ঘোরের মধ্যে লোকজন কয়েকদিন এই ব্যক্তিদের খারাপ মনে করলেও পরে বেরিয়ে যেত যে এটা চোরের দুরভিসন্ধি।

আমাদের দেশের জাজেরা কান্না দেখেই বুঝতে পারবেন কোনটা প্রকৃত সন্তানহারা বাবার কান্না, আর প্রকৃত ধর্ষিতা মেয়ের জন্য বাবার হাহাকার। আমেরিকা কানাডার লোকজন কল্পনাও করতে পারবে না যে আমরা কতটা নিচে নামিতে পারি! তাই জুয়েল গাজীর মামলা প্রকৃত এসাইলাম আবেদনের মামলা কিনা এনিয়ে বিচারক কোন সন্দেহ করেন নি।

ইমিগ্রেশন অফিসারের (গাজীর দাবি করা টেরোরিস্ট সংগঠন ছাড়া) বিএনপি সম্পর্কে যে কোন ধারণাই নাই এটা তার সার্চ দেখেই বুঝা যায়। তিনি মনে করেছেন বিএনপি হলো সোমালিয়ার আলসাবাব, কলোম্বিয়ার ফার্ক অথবা মিডলইস্টের আইএসএসের মত কোন বড় জঙ্গিগোষ্ঠী। তা না হলে, তিনি কেন বিএনপি দ্বারা বিমান হামলার কথা বলতেন।

(paragraph 11 line #7) Several excerpts of information collected through this search are included in the Decision, discussing BNP-led air strikes and……

(১১ নং প্যারাগ্রাফের ৭ নং লাইন অনুবাদ : সার্চের মাধ্যমে সংগৃহীত করা তথ্যের বেশ কিছু উদ্ধৃতাংশ ডিসিশনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে , বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিমান হামলার আলোচনা হয়েছে ……)

ঠাকুর ঘরে কে রে; আমি কলা খাই না
[30 নং প্যারাগ্রাফের এক জায়গায় আছে ] Basic research on the internet was conducted using the following search term: “Bangladesh nationalist party terrorist acts” and the following information was found. As this is publicly available information, it has not been shared with the applicant.

এই তথ্যটা যে কেউ পেতে পারে (সর্বজনীনভাবে উপলব্ধ তথ্য), কিন্তু আবেদনকারীর সাথে শেয়ার করা হয়নি (As this is publicly available information, it has not been shared with the applicant.)! আবেদনকারীকে জানানো হয়নি এটা উল্লেখ করার মানে কি ? এটা দিয়ে অফিসার বুঝতে চেয়েছেন তার সাথে আবেদনকারীর কোন ধরণের সম্পর্ক নাই, বা কথোপকথন হয় নি।

তিনি সার্চের মাধ্যমে বিএনপির সন্ত্রাসী কাজকর্ম সম্পর্কে যে তথ্যগুলো পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন আসলে সার্চ করলে (গুগল, ইয়াহু, বিং) এ ধরনের তেমন কোন তথ্য আসেনা। অফিসারকে এই তথ্যগুলো জুয়েল গাজীই দিয়েছেন সেটা লুকাতেই এমন কথা লিখেছেন। ইমিগ্রেশন অফিসার, জুয়েল গাজী তার লয়ার সবাই একে ওপরের যোগসাজশে এই ইমিগ্রেশন আবেদনটাকে বিএনপির বিরুদ্ধে বিষোদগার করার ক্ষেত্র হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন।

এখানে বিএনপি টেরোরিস্ট সংগঠন কিনা সত্য মিথ্যা (correctness) যাচাই হচ্ছেনা।
৪৫ নং প্যারাগ্রাফে দেখা যায় জুয়েল গাজী বিএনপিকে টেরোরিস্ট সংগঠন না বলার জন্য অনুরোধ করেছেন, কারণ হিসাবে দেখিয়েছেন যে "আমেরিকা বিএনপিকে টেরোরিস্ট সংগঠন বলেনা। "কিন্তু বিচারক তার সাথে একমত হতে পারলেন না, কারণ আমেরিকা এবং কানাডায় টেরোরিস্টের সংজ্ঞায় ভিন্নতা আছে; এবং ৪৮ নং প্যারাগ্রাফে তিনি তার উত্তর তুলে ধরেছেন। এখানেও জুয়েল গাজী এবং তার আইনজীবী বিচারককে ফ্রেমিং করেছেন যাতে বেশি জায়গা জুড়ে বিএনপি টেরোরিস্ট সংগঠন এটা আলোচনায় থাকে।

(প্যারাগ্রাফে নং ৪৮ বিচারক বলেছেন) "আরো যোগ করছি, বিজ্ঞ আমেরিকার ইমিগ্রেশন বিচারক নতুন প্রসিডিং করে বলেছিলেন বিএনপি টেরোরিস্ট সংগঠন নয়। এখানে আমি কিন্তু নতুন করে কোন শুনানি করছিনা। এই কোর্ট জুডিশিয়াল রিভিউ করে দেখছে ডিসিশনটা যৌক্তিক কিনা, এই ইস্যুটার (বিএনপি টেরোরিস্ট সংগঠন কি না?) সত্যমিথ্যা এখানে যাচাই করা হয়নি।" এর মানে কি, বিচারক বলেছেন বিএনপি টেরোরিস্ট সংগঠন কিনা এর সত্যি- মিথ্যা তিনি যাচাই করে দেখেননি। বিচারকের অনুভূতিটা কতটুকু সত্য তা তিনি নিজেও জানেন না, কারণ এখানে আমেরিকার কত নতুন কোন শুনানি হচ্ছেনা। এর সঠিক সিদ্ধান্তের জন্য নতুন করে শুনানির দরকার।

[৫২ নং] বিএনপিকে টেরোরিস্ট অর্গানাইজেশন হিসাবে বিচারকের মুখ দিয়ে অনুভূতি প্রকাশ করানোর মাঝেই যেন জুয়েল গাজীর এসাইলাম আবেদনের সার্থকতা। বিএনপি টেরোরিস্ট সংগঠন কিনা এর সঠিক সিদ্ধান্তের জন্য জুয়েল গাজীর নতুন কোন শুনানির দরকার নাই, কারণ এটা করলে তখন বিএনপিও মামলার একটা পক্ষ হয়ে যাবে! তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকবে।

"নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গের মত" এই আবেদনে এসাইলামের চিন্তা বাদ দিয়ে বিএনপিকে কিভাবে ঘায়েল করা যায় এটা নিয়ে সমস্ত ব্যস্ততা চোখে পড়ে!

উপসংহার
পরিশেষে বলতে হয় গাজী বনাম কানাডা মামলাটা দ্বাবিংশ শতকের একটা ইউনিক আইডিয়া। যার মাথা দিয়ে এমন এক আইডিয়া এসেছে "এসাইলাম অ্যাপ্লিকেশনে যে কারো সম্পর্কে যা ইচ্ছা তাই লিখে ফেললে, তার কোন কিছু করার থাকেনা কারণ ওই ব্যক্তি এই এসাইলামের কোন পক্ষই না। "তাকে মিনিমাম একটা পুরষ্কারে ভূষিত করা উচিত। এই আইডিয়াটাকে এখনই ট্রেডমার্ক করে না রাখলে হয়তো কিছুদিনের মধ্যে দেখা যাবে এই আইডিয়াকে কাজে লাগিয়ে চাকুরীর আবেদনপত্রে যে কেউ যে কারো সম্পর্কে আজেবাজে লিখে দিচ্ছে।

মামলাবাজ মানুষ হায়েনার চেয়েও অধম হয়ে যায়, নিজের সন্তান হত্যা করে, নিজের মেয়েকে ধর্ষণ করায় প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করতে। বিএনপির প্রতিটা নেতাকর্মীর উপর শত শত মামলা কত না জানা কারণে। সুনামগঞ্জে গার্বেজ ট্রাক জ্বললে ঢাকার বিএনপির নেতারা মামলার আসামি হওয়াটা অনেকের দৃষ্টিতে স্বাভাবিক কারণ এটা ডিজিটাল যুগ যে কোন কিছুই কল্পনা করা সম্ভব।

“কানাডার বিচারকের নাম নিয়ে কোন কিছু বললে লোকে বিশ্বাস করবে” এমন চিন্তা মাথায় নিয়েই এসাইলাম অ্যাপ্লিকেশন দিয়ে বিএনপিকে শায়েস্তা করার নতুন যে টেকনিক, এটা কোন ছোটখাটো আবিষ্কার নয়, যার চিন্তার ফসল তিনি এবার পুরষ্কার চাইলেও চাইতে পারেন!

  • এবিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত