আল আমিন হোসেন মৃধা

২৪ এপ্রিল, ২০১৭ ১৫:১৫

বিভীষিকার ২৪ এপ্রিল : শ্রমিক হত্যার ৪ বছর

আজ ২৪ এপ্রিল। আজ থেকে মাত্র ছয়দিন পরেই আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। আজ বাংলাদেশের ইতিহাসে, বিশ্ব গার্মেন্টস শ্রমিক ইতিহাসে এক বিভীষিকাময় ভয়াল দিন। চার বছর আগে ২০১৩ সালের আজকের এই দিনে ঢাকার অদূরে সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে রানা প্লাজা নামের একটি বহুতল ভবন ধ্বসে পড়ে। ভবনের কয়েকটি তলা নিচে দেবে যায়। কিছু অংশ পাশের একটি ভবনের ওপর পড়ে যায়।

এ দূর্ঘটনায় এক হাজার ১৭৫ জন শ্রমিক নিহত এবং দুই হাজারেরও বেশি শ্রমিক আহত হন ও পঙ্গুত্ব বরণ করেন কয়েক শত শ্রমিক, যা বিশ্বের ইতিহাসে ৩য় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা ও বাংলাদেশের শিল্প ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা হিসেবে পরিচিত।

রানা প্লাজার ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন হিসেবে ঘোষণা করা হলেও ঘটনার দিন জোর পূর্বক শ্রমিকদের কাজে বাধ্য করা হয়েছিলো, কাজ না করলে ভয় দেখানো হয়েছিলো চাকুরিচ্যুতের।

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির আজ চার বছর পেরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এখনো শুরু হয়নি শ্রমিক হত্যার এই বিচার। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে করা মামলার মোট ৪১ আসামির মধ্যে কারাগারে আছেন ভবন মালিক যুবলীগ নেতা সোহেল রানাসহ মাত্র তিনজন। বাকিরা কেউ জামিনে, কেউ ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। শুরু হয়নি এখনো বিচার প্রক্রিয়া।

শারীরিক ও মানসিক পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিকদের প্রায় ৪২ দশমিক ২ শতাংশ এখনও বেকার রয়ে গেছেন বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে। গত শনিবার (২২ এপ্রিল ২০১৭) রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা একশনএইড এর গবেষণায় উঠে এসেছে এ তথ্য।

গবেষণার প্রতিবেদন সম্পর্কে একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, "চার বছর পরও এত বিশাল সংখ্যক শ্রমিকদের এই অবস্থা অত্যন্ত দুঃখজনক। আহত ও নিহত শ্রমিকদের পরিবারের সদস্যদের চুইয়ে চুইয়ে সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে। তাদেরকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি, যা দেওয়া হয়েছে তা আর্থিক সহযোগিতা।"

রানা প্লাজায় আহত শ্রমিকেরা পেয়েছেন অনুদান, পান নি ক্ষতিপূরণ। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) গঠিত ডোনার ট্রাস্ট ফান্ডে এক কোটি ৭০ লাখ ডলার অনুদান দেয় বিশ্বের বিভিন্ন ক্রেতা প্রতিষ্ঠান, যার কিছু অংশ বিতরণও করা হয়েছিলো। বাকি টাকার আর কোন হদিস মেলেনি । নিহত ও পঙ্গু শ্রমিককে তার জীবদ্দশার আয়ের সমমান ক্ষতিপূরণ না দিলে ঐ শ্রমিকের উপর নির্ভরশীল পরিবারকে সারা জীবন মানবেতর জীবন কাটাতে হবে- একথা জেনেও সরকার নীরব।

মালিকের অবহেলায় মৃত্যুর ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান এবং কর্মস্থলে নিরাপত্তা ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত না করার কারণে শ্রমিক হত্যার এই ধারাবাহিকতা চলমান।

২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর রাতে আশুলিয়ার নরসিংহপুরে তাজরিন ডিজাইন লিমিটেড নামের কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জনেরও বেশি শ্রমিক আগুনে পুড়ে নিহত হন এবং আহত ও দগ্ধ হন দুই শতাধিক শ্রমিক। এর কয়েক মাসের মাথায় রানা প্লাজার ধস নিহত হয় হাজার অধিক শ্রমিক।

গত বছর ১০ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের ট্যাম্পাকো কারখানার ভয়াবহ বয়লার বিস্ফোরণ থেকে অগ্নিকাণ্ডে ৩১ জন শ্রমিক নিহত হন ও আহত হন আরও অর্ধশতাধিক। গত বুধবার (১৯ এপ্রিল) দিনাজপুরের গোপালগঞ্জ এলাকার যমুনা অটোরাইস মিলে বয়লার বিস্ফোরণে অগ্নিকান্ডে নিহত হন ১০ শ্রমিক ও দগ্ধ হন ২০ শ্রমিক। মালিকদের অবহেলা, শ্রমিকের নিরাপত্তা ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ না থাকায় (নিশ্চিত না করায়) শ্রমিক হত্যার এই ধারাবাহিকতা বিদ্যমান।

মালিকের অবহেলায় মৃত্যুর ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান, কর্মস্থলে মৃত্যুতে বা স্থায়ী পঙ্গুত্বে আজীবন আয়ের সমান ক্ষতিপূরণ, কর্মস্থলে নিরাপত্তা ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা না হলে শ্রমিক হতাহত আদৌ বন্ধ হবে না।

রানা প্লাজার শ্রমিক হত্যার চার বছর পূর্তিতে সরকারের কাছে অনুরোধ, মালিক শ্রেণীর স্বার্থ ছেড়ে শ্রমিকের স্বার্থে নিম্নোক্ত দাবিগুলো পূরণ করুনঃ

♦ ২৪ এপ্রিলকে রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক দিবস ঘোষণা।
♦ মালিকের অবহেলায় মৃত্যুর ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান।
♦কর্মস্থলে মৃত্যুতে বা স্থায়ী পঙ্গুত্বে আজীবন আয়ের সমান ক্ষতিপূরণ।
♦কর্মস্থলে নিরাপত্তা ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা।
♦ রানা প্লাজার মালিকের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে শ্রমিক কলোনি নির্মাণ।
♦জুরাইনে শ্রমিক স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ।
♦রানা প্লাজার স্থানে ২৪ এপ্রিল স্মরণে শ্রমিক স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ।

মালিক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষাকারী সরকার জানি শ্রমিকদের দাবি কখনই মেনে নেবে। তার চেয়ে আসেন গল্প করি। পুরোনো গল্প- ক্লাস থ্রির একটা ছেলে 'আমাদের গ্রাম' রচনা লিখেছিলো, 'আমাদের গ্রামের নাম মেহের আটি। গ্রামের পাশে মেঘনা নদী। মেঘনার চরে অনেক গরু ঘাস খায়, গরু হাঁটার জন্য চারটি পা ও গুতা দেবার জন্য দুইটা শিং আছে। একটি লেজ, দুইটা কান ও বত্রিশটা দাঁতও আছে। গরুর দুধ দিয়ে আমাদের অনেক উপকার হয় এবং গরুর গোস্ত মানুষ কমাতে সাহায্য করে। কারণ গরুর গোস্ত খেয়ে হার্ট এটাক করে মানুষ মারা যায়। আল্লাহ গরুকে কবুল করুন। আমাদের গ্রাম দেখতে অনেক সুন্দর। তাই আমি আমার গ্রামকে অনেক ভালোবাসি।'

আমাদের শাসক গোষ্ঠীদের ঠিক একই অবস্থা। তাদের শাসনামলে তাজরীন গার্মেন্টস অগ্নিকান্ড, রানা প্লাজা ধ্বসে হাজারের অধিক শ্রমিকের মৃত্যু, ট্রাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেডের অগ্নিকান্ড, উত্তরবঙ্গে তিস্তায় পানি না থাকায় কৃষকের আহাজারি, সুনামগঞ্জে হাওর পারের শত শত মানুষের ক্রন্দন- এ কথাগুলো তুলে ধরলেই তারা পদ্মা সেতু, বিদ্যুৎ, রাস্তাঘাট দেখিয়ে উন্নয়নের মহাসড়কের বুলি শোনাবে। একমাত্র তাদের আমলেই উন্নয়ন সম্ভব, তারাই একমাত্র মুক্তিযুদ্ধের ধারক-বাহক।

সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাত, পাহাড়ি আকস্মিক ঢল ও বাঁধ ভেঙ্গে অকালে কয়েক শত কৃষকের কষ্টার্জিত বোরো ফসল পেকে আসার আগেই কাঁচা অবস্থায় তলিয়ে গেছে শত শত কোটি টাকার ধান। সারা দেশের সচেতন মানুষ যখন হাওরাঞ্চলকে দুর্গত অঞ্চল ঘোষণা ও ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের ক্ষতিপূরণের দাবি তুলছে, এরই মাঝে গত ১৮ এপ্রিল সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের (মন্ত্রীর উপস্থিতিতে) সচিব শাহ কামাল বলেন, 'সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলি, দেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নামে একটা আইন আছে। এই আইনের ২২ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো এলাকার অর্ধেকের উপরে জনসংখ্যা মরে যাওয়ার পর ওই এলাকাকে দুর্গত ঘোষণা করতে হয়। না জেনে যারা এমন সস্তা দাবি জানায়, তাদের কোনো প্রকার জ্ঞানই নেই।'

সভায় অবজ্ঞার সুরে সচিব শাহ কামাল আরও বলেন, 'কিসের দুর্গত এলাকা? সুনামগঞ্জে একটি ছাগলও তো মারা যায়নি। তাহলে কেন সুনামগঞ্জকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করতে হবে?'

মাননীয় সচিব-মন্ত্রী মহোদয়, রানা প্লাজায় প্রায় অর্ধেক শ্রমিক মারা গেছে। ২৪ এপ্রিলকে অন্তত রাষ্ট্রীয়ভাবে গার্মেন্টস শ্রমিক শোক দিবস ঘোষণা করুন, আহত-নিহতদেরকে অনুদান নয়, ক্ষতিপূরণ দিন।

  • আল আমিন হোসেন মৃধা: সভাপতি, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, ঢাকা কলেজ।
  • এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত