সজল কান্তি সরকার

২৪ এপ্রিল, ২০১৭ ১৬:২৫

হাওরের অতীত, বর্তমান

পৃথিবী নামক গ্রহে কৃষিপ্রাণ বৈচিত্র্যপূর্ণ স্বতন্ত্র হাওরাঞ্চল আর একটিও নেই। একসময় হাওরাঞ্চল জুড়ে বন-জঙ্গলের রাজত্ব ছিল। তারপর- 'জঙ্গল কেটে আবাদ করে মেহনতি সকল, সেখানে ফলে আজ সোনালী ফসল।' যেখানে নি:সঙ্গতার আর্তনাদ ছিল- 'অরণ্য জঙ্গলার মাঝে আমার একখান ঘর, ভাইও নাই বান্ধবও নাই কে লইবে খবর।'

ধারণা করা হয়, এ অঞ্চলে কৃষিব্যবস্থা শুরু হয় সপ্তম শতাব্দীর শুরুর দিকে। এখন তার ভাব-ধরণ ভিন্ন। কেননা, আমাদের এই হাওরাঞ্চলে আসাম থেকে বরাক নদী সিলেটের জকিগঞ্জের অমলসীদ সীমান্তে সুরমা ও কুশিয়ারা নামে ভাগ হয়ে প্রবেশ করে। ত্রিপুরার জম্পাই পাহাড় থেকে ৬/৭টি পাহাড়ি ছড়ার মিলিত স্রোতে গড়ে ওঠে জুড়ি নদী, যা বুটলী সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে। ত্রিপুরার কৈলাশের পাহাড়ি এলাকা থেকে মনু নদী সিলেটের গোবিন্দপুর দিয়ে প্রবেশ করে মেঘনায় মিলিত হয়। যেখানে বরাক-সুরমা-মেঘনার দৈর্ঘ্য ৮০০ কি.মি., বাংলাদেশে যা ৪১৮ কি.মি. প্রায়।

ভারতের মনিপুর রাজ্যের অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে কুশিয়ারা-সুরমা-মেঘনা হুমকির সম্মুখীন। তাছাড়া, পাহাড়ি ঢলে কোটি কোটি টন পলি বহন করে নিয়ে আসছে এসব নদী। পলিতেই ভরাট হচ্ছে নদী। বিশেষ করে পৃথিবীর সর্বাধিক বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা ভারতের চেরাপুঞ্জি সুনামগঞ্জের খুবই কাছে হওয়ায়, সেখানে প্রায় ৪৪ ইঞ্চি গড় বৃষ্টিপাতে এ অঞ্চলটি বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। সুতরাং, উজান এলাকায় বা পাহাড়ি বৃষ্টি বহন করে নিয়ে আসা পলি হাওরাঞ্চলের জন্য ক্ষতিকর।

দেশভাগের পর মৎস্য খামারের স্থলে তা রূপান্তরিত হয়ে পর্যায়ক্রমে শুধুমাত্র চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ছিল ৩০% মাছের জলাভূমি বিলসহ ৫০% প্রায়। সেখানে প্রতিকেদার জমি চাষাবাদে জমিদারকে রংজমা ১টাকা দিতে হত। মোড়লগণ টাকা আদায় করতেন। নল খাগড়াসহ হাওরের বেশি অংশ সারা বছরেই পানির নিচে থাকত। স্বাধীনতার পর সরকার নৌকা প্রতি ১ টাকা জমা আদায় করে নল খাগড়া পরিষ্কার করেন। ফলে চাষযোগ্য জমির পরিমান দাঁড়ায় ৬০%, বর্তমানে যা ৭০-৮০%।

উল্লেখ্য যে, ১৯৬৬ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড ৪৬টি প্রকল্পের মাধ্যমে ২০০০ কি.মি. বাঁধ নির্মাণ করেছিল। এতে ৩ লক্ষ হেক্টর জমি চাষযোগ্য হয়। ফলে নদী-নালা, খাল-বিলের সাথে হাওরের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। অপরিকল্পিত স্নুইচগেইট পানি নিষ্কাশনে বিঘ্ন ঘটায়। ফলে মাছের লালন ক্ষেত্র ও প্রজনন ক্ষেত্র নষ্ট হয়। পাম্প দিয়ে পানি সেচে বিল শুকিয়ে মাছসহ বিপন্ন করা হয় জলজ উদ্ভিদ। বর্তমানে বিষ প্রয়োগে মাছ ধরা হাওরাঞ্চলে নতুন কৌশল জানা যায়।

বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, আমাদের সীমান্ত নদীর সংখ্যা ৫৪টি। যেখানে ১০-১২টি নদী স্বাভাবিকভাবে প্রবাহমান। বাকিগুলো উজান এলাকার অতিবর্ষন ও পাহাড়ে বৃষ্টিপাতের ফলে পলি জমে ভরাট হয়েছে ও হওয়ার পথে আছে, যেখানে সুরমা, কুশিয়ারা ও মনু নদীর ভূমিকা অপরিসীম। অন্তত মেঘনার ভৈরব পর্যন্ত খনন অতিব জরুরী। একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৫০০ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত প্রায় মোট ২২টি বন্যা সংঘটিত হয়, কিন্তু পাহাড়ি ঢলে এমন বিপর্যয় কখনও আসেনি।

অপরিকল্পিত বেড়িবাঁধও সড়কপথ হাওরের স্বাভাবিক প্রবাহকে ব্যহত করে। ফলে হাওর স্তরে স্তরে পানি ধরে রাখতে কিংবা পর্যায়ক্রমে পানি নিষ্কাশন করতে বাধাগ্রস্থ হয়। সময়মতো কৃষি জমি জেগে ওঠে না। ঘাত মতো চাষাবাদ হয় না। সময়ের ব্যবধানে ফসল ঢলের মোকাবিলা করে টিকে থাকে না। তাছাড়া অধিক ফলনশীল ও দীর্ঘ সময়ে উৎপাদিত ধানের ভূল চাষবাস তো আছেই।

তাই বলা যায়, বর্তমানে শুধু নদী খনন, পরিকল্পিত বেড়িবাঁধ কিংবা সড়কপথসহ স্নুইসগেইট নির্মাণই নয়, সময় উপযোগী সঠিক জাতের ধানচাষ, নিয়ম অনুযায়ী মাছ ধরাসহ সর্বোপরি স্থানীয়ভবে ধানের ও মাছের প্রক্রিয়াজাতকরণ দরকার। প্রয়োজন ইজারা প্রথার আধুনিকায়ন, পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন ও সংস্কৃতি চর্চা। শিক্ষা ব্যবস্থায় হাওর বিভাগ চালু করা দরকার। আর এসব তখনই সঠিক ভাবে সম্ভব, যখন হাওর মন্ত্রণালয় স্থাপন হবে।

  • সজল কান্তি সরকার: হাওর গবেষক। 
  • এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত