দিব্যেন্দু দ্বীপ

০৮ মে, ২০১৭ ১২:৫৪

ইসলাম, মার্কসবাদ এবং ক্ষমতা

গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, বেধে দেওয়া কোনো আদর্শ দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালিত হবে কিনা? উত্তর কঠিন নয়, তবে সহজে উত্তরটা দেওয়া ঠিক নয় যেহেতু আদর্শের জন্য মানুষ জীবন দিচ্ছে এবং অনেক বেশি জীবন কেড়ে নিচ্ছে। সংকটটা এখানেই, অর্থাৎ কোনো আদর্শের জন্য মানুষ জীবন দিয়েছে যত না তার চেয়ে কেড়ে নিয়েছে অনেক বেশি, ঠিক এ জায়গাটিতেই আদর্শবাদের পরাজয় ঘটে।

মুক্তির সংগ্রাম এবং আদর্শবাদকে অনেকে গুলিয়ে ফেলে, দুটি এক নয়। মুক্তির জন্য মানুষ জীবন দিয়েছে বেশি, কেড়ে নেয়নি।

‘মুক্তি’ শব্দটির মধ্যেই রয়েছে পরিবর্তনের আকাঙ্খা, যেকোনো চাপিয়ে দেওয়া শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসা। বইয়ের নামটি মনে করতে পারছি না তবে এ প্রসঙ্গে একটি বিখ্যাত লাইন মনে পড়ছে- “যে সমাজ তোমাকে নতুন আদর্শ সৃষ্টি করার সুযোগ করে দেয় সেটিই মুক্ত সমাজ।” এক্ষেত্রে নেলসন ম্যান্ডেলা চমৎকার বলেছেন, তিনি বলেছেন, নিজেকে শৃঙ্খল মুক্ত করা মানে মুক্তি নয়, অন্যকে মুক্তি দেওয়ার আকাঙ্খার নামই মুক্তি।

এটা ইতিহাসে প্রমাণিত যে কোনো নির্দিষ্ট সময়ে বেধে দেওয়া নীতি-আদর্শ দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালিত হওয়ার সুযোগ নেই। এটা ভুল প্রমাণিত হয়েছে বারে বারে। কোনো আদর্শই সময়ের সাথে পাল্লা দিতে পারে না। বাট্রান্ড রাসেল অনেক আগেই এ সমস্যার সমাধান দিয়ে গেছেন তীব্রভাব আদর্শবাদের বিরোধিতা করে। এ প্রসঙ্গে রাসেল বলেছেন, “প্রতিটি আদর্শবাদের মধ্যে মানুষের প্রতি ঘৃণা লুকিয়ে থাকে, আর থাকে ক্ষমতার প্রতি গোপন ভালোবাসা।

অনেকের মনে প্রশ্ন উঠতে পারে ইসলাম কীভাবে মার্কসবাদের সাথে তুলনীয় হয়, যেহেতু দুটি আদর্শ অনেকক্ষেত্রেই বিপরীত ধাঁচের। ইসলাম বিশ্বাস নির্ভর এবং পুঁজিবাদে বিশ্বাসী। অন্যদিকে মার্কসবাদ বিজ্ঞন নির্ভর এবং সাম্যবাদে বিশ্বাসী। তারপরেও লক্ষ্য অর্জনের উপায় এবং কর্মীদের জেহাদী মনস্তত্ত্ব বিবেচনা করলে এ দুটি মেলে অনেকক্ষেত্রে। তবে মার্কসবাদ বেশিরভাগ দেশে জেহাদের জায়গা থেকে সরে আসলেও ইসলামী রাজনীতি সরে আসেনি।

ইসলাম এবং মার্কসাবাদ দুটোই জীবনপ্রণালী এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার বিধান এবং দুটোই রচিত হয়েছে ক্ষমতার অভিপ্রায় থেকে, একইসাথে মানব কল্যাণের চিন্তা থেকেও। পার্থক্য কিছুটা আছে বটে- যেমন, ইসলাম রচিত হয়েছে একক পরিচয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা এবং সমাজ ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য, তাই ইসলামের রীতিনীতিগুলো আদেশমূলক হয়েছে। অন্যদিকে মার্সবাদ রচিত হয়েছে বহুত্ববাদকে ধারণ করে মানব কল্যাণের জন্য।

সহজে করে বলা যায়- ইসলাম (ধর্ম) পরিবর্তনের মাধ্যমে ক্ষমতা চায়, পরিবর্তন চায় না। মার্কসবাদ ক্ষমতার মাধ্যমে পরিবর্তন চায়। তবে সম্ভবত এরকম বোধ উভয়েরই রয়েছে যে আমরা যা বলছি এটা ঠিক আছে, এবং তা কালজয়ী, এটাই শুধু একমাত্র টিকে থাকা উচিৎ। এক্ষেত্রে মার্কসবাদীদের এরকম কথাও বলতে শোনা যায় যে তারাই লেটেস্ট ধর্ম এবং একমাত্র মার্সবাদই কমপ্লিট কোড অব লাইফ। অর্থাৎ, মার্কসবাদী এবং খেলাফতিদের দৃষ্টিভঙ্গিতে এক ধরনের মিলও পরিলক্ষিত হয়।

বর্তমানে পৃথিবীর সবচে আলোচিত বিষয় হচ্ছে, ইসলাম ধর্মের রাজনীতিকরণ চলবে না। আসলে ইসলাম ধর্ম থেকে রাজনীতি বাদ দিলে ধর্মটা আর থাকে না। হিন্দু ধর্ম যেমন প্রথা নির্ভর এবং প্রথাগুলো বাদ দিলে হিন্দু ধর্মের আর অস্তিত্ব থাকে না।

ইসলাম ধর্ম তো ইহজাগতিক ধর্মই, তবে সময়ের বিবেচনায় তখন ঈশ্বরকে উপলক্ষ করতে হয়েছিল হয়ত। আর ঊনবিংশ শতকে রচিত হয়েছে বলে মার্কসবাদ হতে পেরেছে পুরোপুরি বিজ্ঞানভিত্তিক। রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং সমাজ জীবন থেকে ঈশ্বরকে খারিজ করার সাহস ও সুযোগ ততদিনে কিছুটা হলেও তৈরি হয়েছে। যদিও মার্কসবাদ শুধুমাত্র সমাজ জীবন এবং রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে ঈশ্বর-ধর্ম বাদ দিতে চেয়েছে, ব্যক্তিজীবন থেকে নয়। অন্যদিকে ইসলাম ব্যক্তিজীবনে ধর্ম যেমনই থাক সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে তা রাখতে চেয়েছে সম্ভবত সেই আমলের দলবদ্ধতার প্রয়োজনে। এ বিবেচনায় ইসলাম এবং মাকর্সবাদ বিপরীতই বলতে হবে।

ইসলাম প্রচারমূলক এবং পুরোপুরি রাজনৈতিক ধর্ম। তাই রাজনৈতিক ইসলাম বাদ দিতে বলা মধ্যপন্থীদের এক ধরনের কূটকৌশল ছাড়া কিছু নয়। প্রশ্ন হতে পারে- তাহলে সুফিবাদ কী? অকপট হলে উত্তর খুব কঠিন নয়, সুফিবাদ আসলে আরবে সৃষ্ট নবী মোহাম্মদের ইসলাম নয়। তাই সুফিবাদের সমর্থন করে রাজনৈতিক এবং জেহাদী ইসলামকে খারিজ করা যায় না মোটেও।

বড় প্রশ্ন হচ্ছে, সঠিক হোক আর বেঠিক হোক ইসলামিক আদর্শ দ্বারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে চাওয়া কি অপরাধ? যদি অপরাধ না হয় তাহলে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বন্ধ করতে বলার সুযোগ কোথায়?

অপরাধ হচ্ছে জঙ্গিবাদ, তা যে তত্ত্ব বা আদর্শের জন্যই হোক না কেন। এ প্রসঙ্গে ভলতেয়ার বলেছেন, “সকল ধরনের হত্যাকাণ্ডই নিষিদ্ধ এবং তা শাস্তিযোগ্য।” হ্যারি পটারখ্যাত জে.কে. রাউলিং লিখেছেন, “নিষ্পাপ কোনো লক্ষ্য সামনে রেখে হত্যা করা যায় না।” রক্ত না ঝরিয়ে মানুষের মন জয় করে যেটি টিকে থাকবে সেটিই মেনে নিতে হবে, সেটি যদি কেউ কৌশলে বা কূটককৌশলে করে তাহলে তাকেই জয়ী বলে মেনে নিতে হবে।

  • দিব্যেন্দু দ্বীপ: লেখক।
  • এবিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত