আল আমিন হোসেন মৃধা

১৪ মে, ২০১৭ ১১:৫০

শুভেচ্ছা, পৃথিবীর সকল মা

'রাত থম থম স্তব্ধ নিঝুম, ঘোর- ঘোর-আন্ধার,
নিশ্বাস ফেলি, তাও শোনা যায়, নাই কোথা সাড়া কার।
রুগ্ন ছেলের শিয়রে বসিয়া একেলা জাগিছে মাতা,
করুণ চাহনি ঘুম ঘুম যেন ঢুলিছে চোখের পাতা।
শিয়রের কাছে নিবু নিবু দীপ ঘুরিয়া ঘুরিয়া জ্বলে,
তারি সাথে সাথে বিরহী মায়ের একেলা পরাণ দোলে।
ভন্ ভন্ ভন্ জমাট বেঁধেছে বুনো মশকের গান,
এঁদো ডোবা হতে বহিছে কঠোর পচান পাতার ঘ্রাণ?
ছোট কুঁড়ে ঘর, বেড়ার ফাঁকেতে আসিছে শীতের বায়ু,
শিয়রে বসিয়া মনে মনে মাতা গণিছে ছেলের আয়ু।'

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন তাঁর 'পল্লী জননী' কবিতায় সন্তানের প্রতি মায়ের অকৃত্রিম ভালবাসার কথা তুলে ধরেছিলেন এভাবেই।

পৃথিবীতে মা শব্দের চেয়ে অতি আপন শব্দ আর দ্বিতীয়টি নেই। মা! ছোট্ট শব্দটিই যেন ভীষণ মমতার, ভালোবাসার। সন্তানের কাছে সবচেয়ে আপন, সবচেয়ে প্রিয় হচ্ছেন তার মা। ছোট বেলায় বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন মা। মায়ের গর্ভ থেকে শুরু করে জন্মের পরেও তিল তিল করে নাড়ি ছেঁড়া ধনকে একজন ভালো মানুষ হিসেবে বড় করে তোলেন মা। 'আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে'—কবির এই ভাবনাটি প্রতিটি মায়েরই মনের কথা। মা, এক শর্তহীন ভালোবাসার নাম, ভালোবাসার সবটুকু দিয়েও এ ঋণ শোধ করা যাবে না।

আজ মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার, বিশ্ব মা দিবস। সারা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আজকের এই দিনে বাংলাদেশেও পালিত হয় দিবসটি।

মা দিবসের ইতিহাস:
‘মা দিবসের’ প্রচলন শুরু হয় প্রথম প্রাচীন গ্রীসে। সেখানে প্রতি বসন্তকালে একটি দিন দেবতাদের মা ‘রিয়া’ যিনি ক্রোনাসের সহধর্মিণী তার উদ্দেশ্যে উদযাপন করা হতো। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় ‘মা দিবস’ পালিত হতো বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। রোমানরা পালন করতেন ১৫ মার্চ থেকে ১৮ মার্চের মধ্যে। তারা দিনটিকে উৎসর্গ করেছিলেন ‘জুনো’র প্রতি। ষোড়শ শতাব্দী থেকে এই দিনটি যুক্তরাজ্যেও উদযাপন করা হতো ‘মাদারিং সানডে’ হিসেবে। ইস্টার সানডের ঠিক তিন সপ্তাহ আগের রবিবারে এটি পালন করেন তারা।

অপর ইতিহাস হলো- ১৯১১ সালের মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার আমেরিকা জুড়ে মায়েদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে ‘মাদারিং সানডে’ নামে একটি বিশেষ দিন উদযাপন করা হয়। এর আগে দিবসটি সর্বজনীন করে তোলার লক্ষ্যে এগিয়ে আসেন জুলিয়া ওয়ার্ড নামের এক আমেরিকান। জুলিয়া ওয়ার্ড হোই রচিত "মাদার্স ডে প্রক্লামেশন" বা "মা দিবসের ঘোষণাপত্র" মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মা দিবস পালনের গোড়ার দিকের প্রচেষ্টাগুলির মধ্যে অন্যতম। আমেরিকান গৃহযুদ্ধ ও ফ্রাঙ্কো-প্রুশীয় যুদ্ধের নৃশংসতার বিরুদ্ধে ১৮৭০ সালে রচিত হোই-এর মা দিবসের ঘোষণাপত্রটি ছিল একটি শান্তিকামী প্রতিক্রিয়া।এরপর মা দিবসকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়ার লক্ষ্যে ১৮৭২ সালে জুলিয়া ওয়ার্ড ব্যাপক লেখালেখি শুরু করেন। ১৮৭২ সালের মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার নিজের মায়ের মৃত্যুবার্ষিকীতে ‘মা দিবস’পালন করেন। ১৯১২ সালে আনা জার্ভিস স্থাপন করেন মাদার'স ডে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোশিয়েশন (আন্তর্জাতিক মা দিবস সমিতি) এবং "মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার" আর "মা দিবস'' এইসব শব্দবন্ধের বহুল প্রচার করেন। মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন মা দিবসের দিনটিকে সরকারী ছুটির দিন হিসাবে কংগ্রেস দ্বারা অনুমোদন করার জন্য বিল পাশের সময় আইনে এই প্রচারণারই সাহায্য নেন। ১৯১৪ দিবসটিকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এরপর পৃথিবীর দেশে দেশে মা দিবসটি পালনের রেওয়াজ ছড়িয়ে পড়ে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও যথাযথ মর্যাদায় দিবসটি পালিত হয়। প্রতি বছর এই দিনটি আমাদের স্মরণ করে দেয় মায়ের মর্যাদার কথা। ইংরেজ কবি রবার্ট ব্রাউনিং বলেছিলেন, 'মাতৃত্বেই সকল মায়া-মমতা ও ভালোবাসার শুরু এবং শেষ।' কিন্তু মা দিবসের এই দিনে ভালো আছেন কি আমাদের সব মা?

মা দিবসে বৃদ্ধাশ্রমে মায়েদের আকুতি:
সব সময় সন্তানদের কথা মনে পড়ে। রাতে ঘুম আসে না। আর ঘুমালেও গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। তখন ছেলেমেয়েদের মুখগুলো খুব দেখতে ইচ্ছে করে। বারবার মনে করি ওদের কথা মনে করব না, কিন্তু ভুলতে তো পারি না। ছেলেরা যেখানেই আমায় ফেলে রাখুক ওরা সামনে এলে সব কষ্ট ভুলে যাই। শুধু অপেক্ষায় থাকি কখন ওরা আমাকে দেখতে আসবে।' দৈনিক জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত আবেগাপ্লুত কথাগুলো বৃদ্ধাশ্রমের এক মায়ের।

পোলায় এক সাপ্তার (সপ্তাহ) জন্য রাইখা গেছিলো, আজ ১২ বচ্ছর (বছর)। পোলা আর আয়ে (আসে) নাই।’ কথাগুলো বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন এক মা। তিনি হলেন গাজীপুর খতিববাড়ী বৃদ্ধাশ্রমে থাকা রাবেয়া খাতুন।

'ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার, মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার-ওপার। নানা রকম জিনিস আর আসবাব দামি দামি, সবচেয়ে কম দামি ছিলাম একমাত্র আমি। ছেলে আমার আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম, আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম।’ নচিকেতার এই গানের বাস্তব দৃশ্য আমাদের সমাজে হরহামেশাই দেখা মেলে। প্রতি নিয়ত ঠাই মিলছে বৃদ্ধাশ্রমে মায়েদের।

আমাদের দেশে দরিদ্র প্রবীণদের সংখ্যা শতকরা ৩৭ জন। তাই বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা এবং সদস্য দুটোই ধীরে ধীরে বাড়ছে। বৃদ্ধাশ্রমে যারা থাকেন তাদের শতকরা ৭০ ভাগই নারী এবং তাদের বেশিরভাগই কারও না কারও মা।

বৃদ্ধাশ্রম প্রশ্নে, আপনি হয়ত বলবেন বিদেশের কথা৷ কিন্তু বিদেশে সমাজব্যবস্থা ভিন্ন, রীতি-নীতিও আলাদা৷ সামাজিক নিরাপত্তাও পাশ্চাত্য দেশগুলিতে অনেক বেশি৷ এমনকি জার্মানিতেও বৃদ্ধ বাবা-মা বৃদ্ধাশ্রমে যাবেন, অথবা তাঁদের নিজেদের খরচ নিজেরাই বহন করবেন – এটাই স্বাভাবিক৷ কর্ম-জীবনের উপার্জনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, এ জন্য সরকারি ভাতাও পেয়ে থাকেন তাঁরা৷

কিন্তু, আমাদের দেশে? আমরা তো দেশকেও ‘মা' বলে ডাকি৷ '

জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো', 'ও আমার দেশের মাটি তোমার মাথায় টেকায় মাথা।' এভাবেই বড় গলায় গর্ব করি দেশমাতৃকার জন্য৷ কিন্তু নিজের মায়ের বেলায়? বৃদ্ধাশ্রম।

মা এমন একটা শব্দ যেখানে বর্ণমালার কমতি থাকতে পারে ভালবাসার নয়। এ পৃথিবীতে যার মা নেই সেই বোঝে মায়ের অপূর্ণতা। আজকের এই মা দিবস তার কাছে কত কষ্টের, অপূর্ণতার, সব থেকেও যেন কিছু নেই। আব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন, 'যার মা আছে সে কখনই গরীব নয়।' রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন তেরো বছর দশ মাস, তখন তিনি মাকে হারান৷ মা না থাকাই তিনি তাঁর মাকে নিয়ে কল্পনা করতেন, কল্পনায় মায়ের ছবি আঁকতেন। তিনি লিখেছিলেন, 'মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে/ মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।'

কেউ বলেন, মাকে ভালোবাসতে আবার দিন লাগে? মা তো মা-ই। তবু পালিত হোক না মায়ের সম্মানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের জন্য বছরের একটি বিশেষ দিন।পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় বাবার পাশাপাশি মায়ের অবদানও যে সন্তানের জীবনে অনেক বেশি ও বড় তা স্মরণ করতে ‘মা দিবস’ পালন করা অবশ্যই প্রয়োজন৷ আজকের এ বিশেষ দিনে আমাদের প্রত্যাশা পৃথিবীর সব মায়েদের কল্যাণ হোক৷ কোন মাকে যেন আর বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে না হয়। ‘আজকের দিনে মায়েদের কাছেও সন্তান হিসেবে আমাদের প্রত্যাশা, সকল মা যেন তাঁর সন্তানদের সৃজনশীল ও মনুষ্যত্বসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন। পৃথিবীর সকল মা’কে মা দিবসের শুভেচ্ছা।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত