আব্দুল হাই আল-হাদী

১৪ মে, ২০১৭ ১৭:১৩

পৃথিবীকে ভালোবাসার মূলমন্ত্র

পৃথিবীর চারদিকে আজ কেবল অশান্তি আর হাহাকার। শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের আহাজারি আর বোবা কান্নায় ভারি হয়ে উঠেছে আকাশ-বাতাস। একদিকে বাড়ছে দু’মুঠো অন্নের জন্য ভুখা মানুষের লম্বা লাইন, অপরদিকে চলছে ভোগ-বিলাসের উন্মত্ত মানুষের বিলাসিতার অসুস্থ প্রতিযোগিতা।

মুক্তবাজার অর্থনীতি আর এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থায় পৃথিবীর অধিকাংশ সম্পদই কুক্ষিগত হয়েছে মুনাফালোভী গুটিকয়েক মানুষের হাতে। প্রভাবশালী মানুষ, বহুজাতিক সংস্থা আর দেশগুলোর কাছে ক্রমশ: বিনাশ হচ্ছে পৃথিবীর প্রাণ ও প্রকৃতি। দয়ামায়াহীন মুনাফালোভী মানুষগুলোর খপ্পরে হুমকির মুখে পৃথিবীর অস্তিত্ব।

সে প্রকৃতিকে ভালোবাসার, অশান্তির চিরঅবসান আর শোষণমুক্ত শান্তিময় সমাজ বিনির্মাণের মূলমন্ত্র হতে পারে মায়ের প্রতি ভালোবাসা। মাতৃভক্তি-ই পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শান্তি এবং সমতা প্রতিষ্ঠায় অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে। যে নিজের জন্মদাত্রী মা-কে ভালোবাসতে ও সম্মান জানাতে ব্যর্থ হয়, তাঁর দ্বারা পৃথিবীর কল্যাণ কোনভাবেই সম্ভব নয়।

জীব জগতের প্রায় আঠারো লক্ষ্য প্রজাতির মধ্যে মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বাধিক সংস্কৃতিবান প্রাণি। যে কয়েকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য মানুষকে অন্যান্য প্রাণি থেকে স্বতন্ত্রতা দিয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- নির্ভরশীলতা ও অসহায়ত্ব। প্রাণিজগতে একমাত্র মানবশিশুই জন্মের পর সবচেয়ে অসহায় ও নির্ভরশীল থাকে।

অন্যান্য প্রাণি জন্মের অল্পক্ষণ পরেই অনেকটা চলাচল করতে পারে, কেউবা পারে নিজের খাবার নিজেই সংগ্রহ করতে। কিন্তু মানবশিশুকে জন্মের পর দীর্ঘদিন খাদ্য ও পরিচর্যার জন্য  অপরের উপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। চরম অসহায়ত্ব ও নির্ভরশীলতার এ সময়ে সহযোগিতা আর ভালোবাসার ঢালি নিয়ে নিজের সর্বস্ব নিয়ে যিনি এগিয়ে আসেন, তিনি হচ্ছেন ‘মা’। জন্মের পর মায়ের সাথেই শিশুর প্রথম পরিচয় ও বন্ধুত্ব ঘটে।

মা ও সন্তানের মধ্যকার সম্পর্ক যেমন গভীর, তেমনি প্রাচীনও। বলা যায় যেদিন থেকে মানুষ (Homo-sapience)  নামক প্রাণীটির আবির্ভাব ঘটেছে, সেদিন থেকে ‘মা’ শব্দটি উচ্চারিত হচ্ছে সমস্বরে। সমাজ বিকাশের বন্যদশায় বিয়ে প্রথা চালুর আগে অবাধ যৌনাচার (Sexal Promiscuity) নির্ভর সমাজে আমরা ‘মা’ এর গুরুত্ব ও ভূমিকা দেখতে পাই। সে সমাজে সন্তানের পিতাকে চিহ্নিত করা না গেলেও ‘মা’কে চিহ্নিত করা যেতো অতি সহজে। সাম্যবাদী সে সমাজেও শত ব্যস্ততার মধ্যেও ‘মা’কে হুবহু আজকের  মায়ের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই। আসলে, স্থান কাল-সমাজ ভেদে ‘মা’ এর রূপ এক ও অভিন্ন।

মানব জীবনের সর্বাধিক উচ্চারিত ও পরিচিত শব্দ ‘মা’। সংক্ষিপ্ত অথচ গভীর দ্যোতনাময় এ শব্দটির রয়েছে সুগভীর তাৎপর্য। ‘মা’ শব্দের মতো মা-ও আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে সম্পর্কিত অতি পরিচিত আপনজন। সুখে দুঃখে, আনন্দ বেদনায়, অসুখে-বিসুখে সন্তানের একমাত্র আপনজন ‘মা’। প্রাণবন্ধু, আত্মীয়-স্বজন এমনকি প্রিয়তমা প্রেয়সী স্ত্রী কিংবা স্বামী অসহায় ও দুর্বলতম যেকোনো মুহূর্তে আপনাকে ছেড়ে যেতে পারে। কিন্তু কোন অবস্থাতেই ‘মা’ সন্তানকে ছেড়ে যায় না, যেতে পারে না। এটি প্রায় অসম্ভব।

‘মা’ ডাকের চেয়ে পৃথিবীতে আর কোন মধুর ডাক নেই। আপনি যেকোনো ভাষায় যে টার্মেই শব্দটি উচ্চারণ করেননা কেন, তাঁর আকুতি ও মাধুর্যটার কোন হেরফের হয়না। বিশ্বব্যাপী এক জনমত জরিপে দেখা গেছে, ‘মা’ (Mother) ডাকটি জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, সমাজ, ভাষা নির্বিশেষে সকলের কাছে সর্বাধিক প্রিয় ও মধুর ডাক। তাই বিশ্বসাহিত্য ও ধর্মীয় কেতাব-পুস্তকে দেখা যায় যে, মাকে নিয়ে বিস্তর প্রশস্তি গাঁথা।

কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, আউল-বাউল, ফকির, সন্ন্যাসী প্রত্যেকে নিজের মতো করে মা-কে নিজেদের সৃষ্টিকর্মে তুলে ধরেছেন, গেয়েছেন মায়ের অবিনাশী গান। বাংলা  কবি কাজী কাদের নেওয়াজ বলেছেন,
“মা কথাটি ছোট্ট অতি
কিন্তু জেনো ভাই,
ইহার চেয়ে নাম যে মধুর
তিন ভুবনে নাই।”

কার্ডিনাল মমিলড-এর “মা হচ্ছেন তিনি যিনি অন্য সকলের স্থান পূরণ করতে পারেন, কিন্তু তার স্থান কেউ পূরণ করতে পারে না।” রবার্ট ব্রাউজিং এর মতো, “মাতৃত্বই সকল ভালোবাসার শুরু এবং শেষ (Motherhood All loves begins and end there )।” ইংরেজ কবি Haward Johnson  তার ‘Mother’ নামক কবিতায় অতি চমৎকার ভাবে ‘মা’কে বর্ণনা করেছেন।
তার আট লাইনের এ কবিতাটি হচ্ছে-
‘M’ is for the Million things she gave me,
‘O’ Means only that she’s growing old,
‘T’ is for the tears she shed to save me,
‘H’ is for her heart of purest gold,
‘E’ is for eyes with love-Light shining,
‘R’ means right and right she’ll always be
Put them all together, they spell ‘Mother’ A word that means the world to me.

দক্ষিণ আফ্রিকার লেখক Oliver Sehreiner তাঁর ‘The Story of An African form’ এ বলেছেন, “এমন কোন মহান ব্যক্তি ছিলেন না, যার একজন মহান মা ছিল না।” তার মতে, “মানুষ তাই যা তাঁর মা তাকে শেখায়।” আমেরিকান কবি ও লেখক Ralph waldo Emerson ও অনুরূপ মত পোষণ করতেন। তাঁর মতে, “মানুষ তাই যা তার মা তাকে শেখায়।” বাঙালী কবির ভাষায়-
“অনেক কথার গুঞ্জন শুনি
অনেক গানের সুর।
সবচেয়ে ভালো লাগে যে
আমার মাগো ডাক সুমধুর।”

পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, “... এবং পিতা মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর । তাদের মধ্যে কেউ কিংবা উভয়েই যদি জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদের সাথে ভদ্র ব্যবহার করো এবং (বিরক্ত হয়ে) ‘উহ’ শব্দটি পর্যন্ত তাদের প্রতি করো না। তাদের সামনে নম্রভাবে কথা বলো এবং বলো “হে আল্লাহ! তাদের উভয়ের প্রতি রহমত করো যেমন আমাকে তারা শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন।” (বনী ইসরাইল ২৩:২৪)। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, “মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত।”

বাইবেলে আছে, “He that curselh his father, or his mother, shall surely be put to death” (যে মাতাপিতাকে কষ্ট দেবে, তাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে)। ইহুদী প্রবাদে আছে, “ঈশ্বর সবখানে থাকতে পারেন না, তাই তিনি মায়েদের সৃষ্টি করেছেন।”
 
১৯০৮ সালের ১০ মে পূর্ব ভার্জিনিয়ার গ্রাফটনের চার্চে ‘মা’ দিবস আনুষ্ঠানিকভাবে পালন শুরু হয়। ১৯১১ সালে আমেরিকার প্রতিটি রাজ্যেই ‘মা’ দিবস পালিত হয়। ১৯১৪ সালের ৮ মে মার্কিন কংগ্রেস মে মাসের দ্বিতীয় রোববারকে ‘মা’ দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়। সে থেকে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশসহ পুরো পৃথিবীতে ‘মা’ দিবস পালিত হচ্ছে।

মূলত: পাশ্চাত্যের ভোগবাদী উচ্ছ্ঙ্খৃল সমাজে যেখানে বিচ্ছিন্নতার ছড়াছড়ি ও বন্ধনহীনতা প্রকট, সমাজের মধ্যে মায়ের প্রতি শ্রদ্ধার অভাব এমন অবস্থাই তাদেরকে ‘মা’ দিবস পালন উৎসাহিত করেছে। পাশ্চাত্যের সমাজে সন্তানরা প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার সাথে সাথে ‘মা’কে ছেড়ে চলে যায় এবং বৃদ্ধ ‘মা’ চলে যান বয়স্ক নিবাসে। তারা মায়ের চাইতে বন্ধু-বান্ধব ও পোষা প্রাণিকে সঙ্গ দিতে ও সেবা করতে ভালোবাসে। আর এজন্যেই তারা বছরের এ দিনটিতে মায়ের সঙ্গে দেখা করে এবং উপহার সামগ্রী প্রদান করে।

সাম্রাজ্যবাদী পাশ্চাত্য সমাজের ঢেউ লেগেছে আমাদের  সমাজেও। এখানকার ঐতিহ্যবাহী পরিবার জীবন ভাঙছে, বাড়ছে একক পরিবারের সংখ্যা। মায়েদের প্রতি অবহেলা প্রদর্শনের বাতিক আমাদের সমাজেও পরিলক্ষিত হচ্ছে। সমাজে দেখা যায়, মায়ের সবচেয়ে সামর্থ্যবান, যোগ্য, সচ্ছল ছেলেটি তার স্ত্রী, পুত্র, কন্যা কিংবা শ্বশুড়বাড়ীর আত্মীয়দের নিয়ে শহরের ফ্লাট বাড়িতে মহা আনন্দে দিন যাপন করে অথচ তাঁর মা অসহায় অবস্থায় তারই গ্রামের বাড়িতে দুর্বল, অসচ্ছল ছেলেটির কাছে কোন রকমে দিন কাটাচ্ছে।

সমাজের শিক্ষিত, মায়ের প্রতি উদাসীন শ্রেণীর এ রকম মনোভাবের পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ নয়, আমাদের যুগ যুগ ধরে চলে আসা ‘মা’ এর প্রতি সম্মানের ঐতিহ্যবাহী ধারা বজায় রাখার ব্যাপারে প্রত্যেকের মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।

একজন মাতৃভক্ত মানুষ, সে হোক পুরুষ কিংবা নারী , কখন-ই অন্যের প্রতি রুঢ় আচরণ করতে পারেনা। ভালোবাসা  ও মমত্ববোধে পূর্ণ থাকে তার মন। সে তার কর্মস্থলে অন্যের প্রতি জুলুম করতে পারেনা, সে হতে পারেনা একজন শোষক। সে পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এমনকি আন্তর্জাতিক পরিসরে অত্যন্ত মায়াভরা ও দরদ দিয়ে সব কাজ সমাধান করে। সে রুখে দাঁড়ায় সর্বপ্রকার শোষণ, নিপীড়ন, অন্যায়, অবিচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে। পৃথিবীর প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতিও তাঁর সর্বদা শ্রদ্ধা ও ভক্তি থাকে। সে মানুষ ছাড়াও অন্যান্য জীবের প্রতি সদয় থাকে।

পরিবেশ ধ্বংস করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধ্বংসের যেকোনো অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সে রুখে দাঁড়ায়। সে মনে করে পৃথিবী অনেকটা মায়ের মতো। মা যেমন গর্ভে ধারণ করে, জন্মদানের পর বুকের দুগ্ধ ও মমত্ববোধ দিয়ে আগলে রেখে তিলে তিলে বড় করে, পৃথিবীও তার অফুরন্ত সম্পদ দিয়ে মানুষের আবহমান কাল থেকে মানুষের উপকার করে যাচ্ছে- এ বিশ্বাস থেকে সে পৃথিবীকে অনিষ্ট থেকে রক্ষার, কল্যাণের মূলমন্ত্র পায়।

বাংলাদেশ সরকার সন্তান যেন মা-বাবার যত্ন ও ভরণ-পোষণ করে, সেজন্য আইন প্রণয়ন করেছেন। সে হিসেবে বাবা-মায়ের প্রতি সম্মান ও ভক্তি একজন নাগরিক হিসেবে এখন আমাদের আইনি কর্তব্যও বটে। সে আইনের ভয়ে নয় বরং  নৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক দায়বোধ থেকে যেন মায়ের প্রতি সবার মনোযোগ বাড়ানো প্রয়োজন। এতে মা-ও থাকবেন ভালো, সন্তানেরও মঙ্গল হবে। সর্বোপরি আমরা পাবো একটি সুন্দর মানবিক পৃথিবী।          


আবদুল হাই আল-হাদী, প্রাবন্ধিক ও পরিবেশকর্মী

আপনার মন্তব্য

আলোচিত