আল আমিন হোসেন মৃধা

২০ মে, ২০১৭ ১৫:০৬

চা শ্রমিক দিবস : ৯৬ বছরেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি চা শ্রমিকরা

চায়ের কাপে চুমুক দিতেই শরীরের ক্লান্তিত্ব নিমিষেই শেষ। এক কাপ চা না হলে সকাল শুরু করতেই পারেন না অনেকে। সকালের দৈনিক পত্রিকার সঙ্গে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপটা না হলে চলেই না। বাংলাদেশে চায়ের দোকান কোথায় নেই? শহরের অলি-গলির মোড়ে মোড়ে, পাড়ার দোকানে, মহাসড়কের পাশে, গ্রাম-গঞ্জে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে প্রায় সব জায়গাতেই আছে চায়ের দোকান, চায়ের কাপে জমে আড্ডা। এমনকি রাজনীতিতেও, নির্বাচনী আমেজেও চা ছাড়া যেনো তক্কাতক্কিটা ঠিক জমে না। শীত, বর্ষা কিংবা গরম সব মৌসুমেই চলে চা। রঙ বা লাল চায়ের সাথে আদা-লেবু হলে তো কথাই নেই। কিন্তু এই লাল চায়ের সাথে চা শ্রমিকের রক্তাক্ত ইতিহাসের খবর আমরা কি কেউ রাখি?

আজ ঐতিহাসিক ২০ মে। চা শ্রমিকদের রক্তঝড়া দিবস। ১৯২১ সালের এই দিনে ব্রিটিশদের অত্যাচার থেকে মুক্ত হতে সিলেট অঞ্চলের প্রায় ৩০ হাজার চা-শ্রমিক নিজেদের জন্মস্থানে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা চালালে চাঁদপুরের মেঘনা ঘাটে গুলি চালিয়ে নির্বিচারে হত্যা করা হয় শত শত চা শ্রমিকদের। মেঘনা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয় শ্রমিকদের মৃতদেহ।

পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে চীন ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোথাও চায়ের প্রচলন ছিল না। ১৮৫৪ সালে পরীক্ষামূলকভাবে সিলেটের মালিনীছড়া চা বাগানে চা চাষ শুরু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সে সময় বৃহত্তর সিলেটে চা বাগান তৈরির জন্য ভারতের আসাম, উড়িষ্যা, বিহার, উত্তর প্রদেশসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে শ্রমিকদের নিয়ে আসা হয়। ‘গাছ হিলেগা, রুপিয়া মিলেগা’ এমন প্রলোভনে শ্রমিকরা বাংলাদেশে এলেও তাদের ভুল ভাঙতে বেশি সময় লাগেনি। বিশাল পাহাড় পরিষ্কার করে চা বাগান করতে গিয়ে হিংস্র পশুর কবলে পড়ে কত শত শ্রমিকের জীবন বিপন্ন হয়েছে তার হিসেব মেলা ভার।

চা শ্রমিকদের উপর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অব্যাহত নির্যাতন-নিপীড়নের প্রতিবাদে সে সময়কার চা শ্রমিক নেতা পণ্ডিত গঙ্গাচরণ দীক্ষিত ও পণ্ডিত দেওসরন নিজ দেশে চা শ্রমিকদের ফিরে যাবার জন্য ‘মুল্লুকে চল’ (দেশে চল) আন্দোলনের ডাক দেন। 'মুল্লুকে চল' আন্দোলনের ডাকে ১৯২১ সালের ২০ মে সিলেট থেকে পায়ে হেঁটে চাঁদপুর মেঘনা স্টিমার ঘাটে পৌছান সিলেট অঞ্চলের প্রায় ৩০ হাজারের অধিক চা শ্রমিক। তারা জাহাজে চড়ে নিজ দেশে ফিরে যেতে চাইলে ব্রিটিশ সৈন্যরা নির্মমভাবে গুলি চালিয়ে শত শত চা শ্রমিককে হত্যা করে এবং মৃতদেহ ভাসিয়ে দেয় মেঘনা নদীতে। যারা ব্রিটিশ সৈন্যদের হাত থেকে ঐ দিন পালিয়ে এসেছিলেন তাদেরকেও আন্দোলন করার অপরাধে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সেনাদের হাতে। এরপর থেকেই প্রতি বছর ২০ মে চা শ্রমিক দিবস হিসেবে দিনটি পালন করে আসছেন চা শ্রমিক ও প্রগতিশীল ব্যক্তিবর্গরা।

দিন বদলেছে, বদলেছে অভ্যাস আর তার সাথে অভ্যস্ত হতেই কালে কালে ঘটেছে চায়ের বিবর্তন। সবুজ চা, লাল চা, কালো চাসহ কত বাহারি রকমের চা। কিন্তু বদলায়নি চা শ্রমিকদের জীবন। চা শ্রমিকদের শ্রমে-ঘামে দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরলেও তাদের ভাগ্যের চাকা আগের মতোই স্থির। চা গাছ ছেঁটে ছেঁটে ২৬ ইঞ্চির বেশি বাড়তে দেয়া হয় না। চা শ্রমিকের জীবনটাও ছেঁটে দেয়া হয় চা গাছের মতোই। একটি পাঁচ তারকা হোটেলে এক কাপ চায়ের দাম ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত, অথচ মাত্র ৮৫ টাকা দৈনিক মজুরিতে সংসার চালাতে হয় এই চা শ্রমিকদের।

মাসের বেশির ভাগ দিনই সকালে লবণ দিয়ে এক মগ চা আর সাথে দু'মুঠো চাল ভাজা খেয়ে বাগানে যেতে হয়, তার নিজের উৎপাদিত চায়ের সাথে দুধ চিনি মিশিয়ে খাবার সামর্থও তার নাই। মাসে খুব কম দিনই মেলে রেশনে ময়দা। যতটুকু মেলে, তাও পঁচা-নষ্ট। সারাদিন এক পায়ে দাঁড়িয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে দিনে ২৩ কেজি পাতা তুলতে পারলেই কেবল তা দিনের হাজিরা হিসেবে গণ্য হয়। গাছ ছাঁটার কালে অন্তত ২৫০টা গাছ ছাঁটতে হয় দিনে। কিটনাশক দেয়ার ক্ষেত্রে অন্তত ১ একর জমিতে কীটনাশক ছিটালেই তবে দিনের হাজিরা মেলে। দুপুরে এক ফাঁকে মরিচ আর চা পাতার চাটনি, সাথে মাঝে মাঝে মুড়ি, চানাচুর। খুব কম দিনই মেলে ভারি খাবার।

এই অমানুষিক হারভাঙা কঠোর পরিশ্রমের ফলে চা শ্রমিকদের একেকদিন হাত ফুলে যায়, ফুলে যায় পা, ঝোঁপালো চা গাছের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে হাত-পা কোমর ছিলে যায়। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে সাপ-বিচ্ছুর কামড় খেয়ে কাজ করতে হয় চা বাগানে। সংসারের ঘানি টানতে গিয়ে এবং চা বাগান এলাকায় শিক্ষার সুযোগ খুব বেশি না থাকায় পড়ালেখা হয়ে ওঠে না খুব বেশি তাদের। নিত্যদিনের দৈন্যতায় চা শ্রমিকের সন্তানের শিক্ষা মেলে না, মেলে না চিকিৎসা। যে ঘরটিতে প্রজন্মান্তরে তার বসবাস, সে ঘরটিও তার হয় না। ঘরটি ধরে রাখতে হলে পরিবারের একজনকে অন্তত চা শ্রমিক হতেই হয়।

অথচ চা বাগান মালিকের জমি সরকারেরই খাস জমি। সামান্য অর্থে লিজ নিয়ে সস্তায় চা বাগান করে, শ্রমিকদের অমানুষিক পরিশ্রম করিয়ে নূন্যতম বেঁচে থাকার মজুরি না দিয়ে মুনাফা করে লুফে নেয় শত শত কোটি। যেহেতু সরকারি জমি লিজ নিয়ে চা বাগান, সেহেতু সরকার চাইলেই এ সমস্যার সহজেই সমাধান করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে মালিক পক্ষের স্বার্থ রক্ষায় সরকারের আছে শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী নানা কালা কানুন।

মৌলভীবাজারে ৯২টি, হবিগঞ্জে ২৪টি, সিলেটে ২০টি, চট্টগ্রামে ২২টি, রাঙামাটিতে ১টি, ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় ১টিসহ সারাদেশে মোট ১৬০টি চা বাগান আছে৷ এর মধ্যে চা শ্রমিক ১ লাখ ২২ হাজার। এই শ্রমিকদের মধ্যে ৯০ ভাগই নারী শ্রমিক৷

পরিচিত এক চা শ্রমিক নেতাকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, "বর্তমানে চা বাগানে শ্রমিকদের অবস্থা বেশি ভালো না৷ তারা খুবই দুর্ভোগে আছেন৷ চা শ্রমিকদের ঘরে অনেক সমস্যা৷ আমরা যেটাকে ‘লেবার লাইন' বলি, সেখানে ৮ হাত বাই ১২ হাত এক-একজন চা শ্রমিকের ঘর৷ সেই ঘরে পরিবারের ৮ থেকে ১০ জনকে নিয়ে বসবাস করেন তাঁরা৷ মজুরির অবস্থাও বেশি ভালো না৷ ২০০৭ সালে বেতন ছিল দৈনিক ৩২ টাকা ৫০ পয়সা, ২০০৯ সালে ৪৮ টাকা, ২০১৩ সালে হয় ৬৯ টাকা এবং বর্তমানে হয়েছে ৮৫ টাকা৷"

শ্রমিক শোষণ চলছে বিশ্বব্যাপী, কিন্তু বাংলাদেশের চা শ্রমিকেরা সবচেয়ে বেশি শোষণ-বঞ্চনার শিকার। যে আশা নিয়ে ৯৬ বছর আগে তারা জীবন দিয়েছিলেন, তা পূরণ হয়নি। চা শ্রমিকদের জন্য নিম্নোক্ত দাবিগুলো পূরণ ছাড়া তাদের এ সমস্যা আদৌ সমাধান সম্ভব নয়।

♦ চা শ্রমিকদের দৈনিক বেতন নূন্যতম ৩০০ টাকা ও সপ্তাহে ৫ কেজি চাল রেশন দিতে হবে।
♦ ২০ মে ঐতিহাসিক 'মুল্লুকে চল' অভিযানে নিহত শহিদদের স্মরণে এ দিনকে রাষ্ট্রীয়ভাবে 'চা শ্রমিক দিবস' ঘোষণা ও পালন এবং চা বাগানে ছুটি ঘোষণা করতে হবে।
♦ ৮ ঘন্টা কর্মদিবস নিশ্চিত করতে হবে। ৮ ঘন্টার বেশি কাজের জন্য ওভার টাইম হিসেবে দ্বিগুণ মজুরি দিতে হবে।
♦ অবিলম্বে শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ করতে হবে। বেকার শ্রমিকদের চাকরি, অন্যথায় বেকার ভাতা দিতে হবে।
♦ চা শ্রমিকদের ব্যবহৃত ভূমির স্থায়ী বন্দোবস্তের ব্যবস্থা করতে হবে।
♦ চা শ্রমিকদের জন্য স্বাস্থ্য সম্মত পর্যাপ্ত ঘরবাড়ি নির্মাণ করতে হবে।
♦ গরুর খামার, মাছের খামার, রাবার প্রজেক্ট কিংবা অন্য কোন প্রকল্পের নামে চা শ্রমিকদের জীবন-জীবিকা ধ্বংস করা চলবে না।
♦ চা শ্রমিকদের সন্তানদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে এবং পৃথক চাকরির কোটা নির্ধারণ করতে হবে।
♦ চা বাগানে ঘরে ঘরে বিশুদ্ধ পানি, স্বাস্থ্য সম্মত সেনিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
♦ ভোজ্য তেল, চিনিসহ প্রয়োজনীয় উন্নতমানের রেশন সরবরাহ করতে হবে। রেশনের নামে পঁচা আটা বিতরণ করা বন্ধ করতে হবে।
♦ বাগানের মানুষের সাংস্কৃতিক বিকাশের লক্ষে প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করতে হবে। সুস্থ, রুচিসম্মত বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে।
♦ চা শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে।
♦ চা শ্রমিকদের স্বার্থবিরোধী সকল কালা কানুন অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।

সারা পৃথিবীতে শ্রমজীবী মানুষের কাছে ১ মে শ্রমিক দিবস পালিত হলেও যে দেশে এই শ্রমিকের রক্তঝরা দিবসের ইতিহাস রচিত, সেই মার্কিন মুল্লুকে আজও মে দিবস সরকারিভাবে স্বীকৃত নয়। তেমনি চা শ্রমিকদের রক্তঝরা ইতিহাস এ দেশে রচিত হলেও আজ অবধি চা শ্রমিক দিবস এ দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত নয়। তখন ছিল ব্রিটিশ শাসন, তবে দেশের প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হলেও চা শ্রমিকদের জীবনের শোষণ-নিপীড়নের ইতিহাস সেই ব্রিটিশদের সময়ের মতোই রয়ে গেছে।

 

  • আল আমিন হোসেন মৃধা: সভাপতি, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, ঢাকা কলেজ।
  • এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত