গোঁসাই পাহ্‌লভী

২১ মে, ২০১৭ ২৩:১৫

নিয়তির সুতা

রাসেল আহমেদ

রাসেল আহমেদের সাথে আমার শেষ দেখা বই মেলায়। এর পরেও একবার দেখা হয়েছে, তবে বই মেলায় দীর্ঘক্ষণ কথা হয়েছে সস্ত্রীক, উভয়েরই। বলেছিলেন- আপনার হটপটটি নিয়ে যাবেন, তবে অজ’কে ছাড়া আসবেন না। অজ আমার মেয়ের নাম।

জিজ্ঞেস করেছিলাম ‘নৃ’ ছবির আপডেট কি? বললেন, ওভাবে হচ্ছিলো না বুঝলেন, শিফটিং, এডিটর, এর থেকে নিজেই বাসায় বসে কাটছি; নিজের কাজ, নিজেই ধরে ধরে করার মধ্যে দিয়ে যে কি মজা। কথাগুলো বলছিলেন রাসেল আহমেদ। যথারীতি বরিশালের ভাষায়। রাসেল আহমেদের কথায় কোনও অভিযোগ ছিলো না, অনুরাগ ছিলো না, একটা আমেজ ছিলো। তিনি ‘মজা’ শব্দটিকে এমনভাবে উচ্চারন করলেন যেন সত্যি কোনও মজার ঘটনা তখনই ঘটে চলছে, তার মননে, চিন্তায় এবং বর্তমানে ছবি বানানো যেন খুব মজা, ছবির বিষয়বস্তুর মধ্যে আনন্দের স্ফুরণ।

নৃ বানানোরও আগে তাঁর কথা শুনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা বিভাগের এক ছাত্র আরিফের কাছে। আরিফের ক্যামেরাটা বোধ হয় তিনিই কিনেছিলেন। আরিফ তার মায়ের সোনাগয়না বিক্রি করে ক্যামেরাটা কিনেছিলো। কিন্তু ওর চোখে সমস্যা ধরা পড়ায় ডাক্তার বলেছে চোখ বাঁচাতে হলে ক্যামেরা ছাড়তে হবে। আরিফের সেই ক্যামেরাটা কিনেছিলেন রাসেল আহমেদ। এই যে দৃষ্টিহীনতার মধ্যে দিয়ে দৃষ্টির ধারাবাহিকতা, ক্যামেরা ক্রয়বিক্রয়, ক্রয়বিক্রয়কারীদের সম্পর্কের এই ক্যামেস্ট্রিকে স্বাভাবিকভাবেই সিম্বলিক ভেবেছিলাম।

পরে রাসেল আহমেদের সাথে পরিচয় হয়। তাকে আমি একটা ভিডিও ইনস্টলেশনের কথা বলি। একদিন বর্ষায় তার সাথে ছবির হাটে দেখা হলে জানতে চাইলেন গল্পটির কথা। বললাম, মানুষের সোনাগয়না হারিয়ে গেলে পুকুরে বা খালে, কিছু মানুষ আছে সেগুলো খুঁজে বের করে পুকুর থেকে। এভাবেই সেই মানুষগুলো সোনায়গনার বদলে আমাদের বীজ খুঁজে বের করবেন পুকুরের ভেতর থেকে, নদীর ভেতর থেকে, কাদার ভেতর থেকে!

দৃশ্যটি এমন ছিলো যে, ডুবুরি পানির ভেতর থেকে খুঁজে পাওয়া বীজ হাতে তুলে দেখাচ্ছেন। অমনি রাসেল আহমেদ বললেন ,তখন ‘ফ’স’ করে উঠবে! এই, এভাবে দীর্ঘদিন। পরে যখন দেখা হয়েছে, ‘নৃ’ফিল্ম নিয়ে ব্যস্ত খুব। খবর পাচ্ছি বিভিন্ন পোর্টালে, ফেসবুকে। বরিশালের বিভিন্ন লোকেশনে চিত্রগ্রহণ, অর্থাভাবে শ্যুটিং বন্ধ, বিয়ে, প্রডিউসারদের টাকা পয়সা, পৈত্রিক জমি বিক্রি, নানান লেখাজোখা গল্প পড়ছিলাম, দেখছিলাম। আর মাঝে মাঝে তো তাকে পাওয়া গেলে ‘নৃ’ বাস্তবতার বয়ান নিজেই বলতেন, জানান দিতেন। অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন, ‘নৃ’ সম্পর্কে বলেন? ‘নৃ’ বিষয়ে যেভাবে বলা হয় নৃ সেভাবে হয়ে উঠবে কিনা, ছবিটি রিলিজ হচ্ছে না কেন? এইসব প্রশ্নের উত্তর নৃ পরিবারই ভালো বলতে পারবেন, যে ছবিটি শেষ হয়নি তার বিষয়ে আগাম বলার কি আছে। তবে এটা ঠিক, যেখানে, যে ভূমিতে মানুষকে কেন্দ্রে রাখা হয়েছে, যেখানে ভূমিপুত্রের কথা রয়েছে, ফলে, ফিল্মটির বিষয়ে এভাবেই বলেছি যতদূর মনে পরে কেহ প্রশ্ন করলে। এর পরে তো ছবিটির টিজার দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ এই কথা রাসেল আহমেদও বহাল রেখেছেন। কিন্তু তাতে কি হয়েছে? রাসেল আহমেদকে মানুষের জগত ছাড়তে হয়েছে, সবাইকেই মানুষের জগত ছাড়তে হবে, কিন্তু এভাবে? রাসেল আহমেদের মৃত্যু কি স্বাভাবিক? যে হৃদয় কেবল মানুষের আশ্রয়স্থল, সেই হৃদয়ে এমন কি ঘূণপোকা ঢুকেছে যে হঠাৎ করে জীবনের গতিই থামিয়ে দিতে পেরেছে! এই প্রশ্ন, এই সন্দেহ কোনও ব্যক্তি বিশেষের জন্যে নয়, আমরা যে পরিবেশ প্রকৃতিতে রয়েছি সমগ্রতার প্রতিই এই প্রশ্ন।

মানুষ কি নিয়তিতে বাঁধা? ক্লাস সেভেনে যখন পড়েছি, বাংলার শিক্ষক শাহনামা এবং আবুল কাশেম ফেরদৌসিকে নিয়ে বলতে গিয়ে এই নিয়তি শব্দটিকে রাসেল আহমেদের ভাষায় এমন মজা করে বলেছেন যে, শব্দটি বিবিধ অর্থপূর্ণতায় আদৌ ঝরে পড়েনি। বলতেন, ‘কত ফুল ফোটে, কত ফুল ঝরে যায়, কত তারা জ্বলে কত তারা নিভে যায়, পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে ফোটা ফুল আর নিভে যাওয়া তারার মাঝে মানুষের জীবন যেন এক পুতুল নাচের ইতিহাস’। ‘নিয়তির সুতোয় বাঁধা’ এখানে, ঐ যে কান খাড়া হয়েছে, আর থামছেই না, নিয়তির সুতোয় সম্পর্ক সূত্র, নিয়তির সুতোয় রাষ্ট্র রাজনীতি, নিয়তির সুতোয় শিল্পবিশ্ব যেন বুনে চলছে সব কিছু; সম্পর্ক থেকে সম্পর্কহীনতা।

নিয়তি তো নিয়ত থেকে আসা একটা শব্দ। আপনি নিয়ত করেছেন, ফলে সেই নিয়তের উপরে চলাই তো নিয়তি। রাজনীতি করবেন নিয়ত করেছেন, ব্যাংকার হবেন নিয়ত করেছেন, কিংবা ফিল্মমেকার হবার নিয়ত। ফলে আপনি আপনার নিয়তের রাস্তায় হেঁটে নিয়তকে দোষারোপ করা যাচ্ছে না, ঠিক পোলার অপজিট গেম নিজের সাথে খেলার সুযোগ নেই। বাংলাদেশে ঘটছে ঠিক অসুযোগের সুযোগ। বাংলার শাসক গোপালের পরে এমন কোনও রাজার বা শাসকের সন্ধান পাওয়া যাবে না যাকে সমাজ দায়িত্ব দিয়েছে। কোনোও শিল্পীকে এই সমাজ দায়িত্ব দেয়নি, শিল্পীরা নিজেরাই দায়িত্ব নিয়েছেন, মানুষের পক্ষে কথা বলছেন, মানুষের নান্দনিকতাবোধ বিকশিত হতে সাহা্য্য করছেন। এই যে স্বেচ্ছায় দায়িত্ব নেয়ার অভ্যাস, নিয়তির শুরু এখান থেকেই। যেহেতু শিল্পবোধ সমাজের ভেতর সঠিকভাবে ফাংশন করেনা এবং এটা যেহেতু একটা বুদ্ধিবৃত্তিকতা, ফলে শিল্পী নিয়তের রাস্তা দিয়ে একাই হাঁটেন। সমকালে তো দূরের কথা, শিল্পীর বানানো রাস্তায় হাঁটতে জনসাধারণের কয়েক হাজার বছরও লেগে যেতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই নিয়ত ও নিয়তির অবস্থা শোচনীয়। এ নিয়ে এখনও তেমন কোনও পরিসংখ্যান চোখে পড়েনি।

ভাষা আন্দোলনের পরে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারণা, সুলতানের কৃষক সমাজ এবং মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে মানুষ নামক আর্কিওটাইপ সৃষ্টি হয়েছে, এখানকার বুদ্ধিজীবীরা বিবিধ প্রতিকূলতার মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সাহায্যেই লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির যে রূপরেখা জাতীয়তাবাদের এক বিশেষ আর্কিওটাইপ চরিত্র ধারণ করলো, এর যথার্থতার সন্ধান করারও সময় হয়েছে। এই ভূমি, এই ভূমির বিশেষ পুত্রদের ভূমিচ্যুত করেছে। যেখানেই মানুষ হয়ে মানুষের বিষয়ে ভাবনা চিন্তা করেছে, সেখানেই ভাবুক মানুষটি বলি হয়েছে। ক্রুসিফাইডের ইতিহাস মানুষ নিয়ে ভাবার ইতিহাস। রাসেল আহমেদ কি জানতেন না যে, মানুষ নিয়ে ভাবার ফলাফল কি হতে পারে! উন্নত কি অনুন্নত বিশ্ব হোক, মানুষ নিয়ে ভাবার পরিনাম সর্বত্র এক।

চর্যাপদ কিংবা শ্রীকৃষ্ণকীর্তণ বাংলাদেশে পাওয়া যায় নাই, আলাওয়াল কিংবা শ্রীচৈতন্যের পরিবার সিলেট থেকে চলে গেছেন নদীয়ায়। লালন ফকিরকে একটা ধর্মমতের সমাজ প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে টিকে থাকতে হয়েছে। ফলে, বাঙালির রক্তের ভেতর সংস্কৃতি, চিন্তা এবং সৃজনশীলতার পালন তো দূরের কথা, রীতিমত হন্তারক হিসাবে তার পরিচিতি দীর্ঘদিনের।

আমি যেবার চারুকলায় স্নাতকে ভর্তি হই, মাত্র দু’জন শিক্ষকের নামেই সাহস করে ছিলাম। একজন সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ, দুই ব্যাগ ও নেগেটিভ রক্ত দিতে পারছেনা বারডেম। হাজার বছরের মধ্যে অলক রায়ের মতো ভাস্কর সনাক্ত করা যায় না এই বঙ্গে, বিষয়টা হচ্ছে আমরা এই মহানদের জন্যে কি করেছি? দু’য়েকটা পুরষ্কার? শিল্পী কি পুরষ্কারের থেকে জলবায়ূ, আলোকরশ্মি, সৃষ্টিশীলতা অর্জন করেন? সব কিছু চেয়ে চেয়েই যদি অর্জন করতে হয়, তাহলে নিয়ত কিংবা এই নিয়তির আর কি অর্থ থাকে! স্বাধীনতার অর্থ নিয়ে পুনঃবিবেচনারও ক্ষেত্র তৈরি হয়ে যায় অবচেতনেই। এখানে, এমন বাস্তবতারও সৃষ্টি হয়নি যে, সরকার নিজেই প্রত্যাখ্যাতদের নিয়ে একটি ‘স’লো দে রেফুউজের আয়োজন করে!

তরুণ শিল্পীদের এই বিষয়ে ভাববার সময় হয়েছে। সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ স্যার আমাকে বলেছিলেন ভাস্কর্য নেয়ার অর্থ হচ্ছে পিচকে সমুদ্র ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়ার নামান্তর! সিনেমা একটি ইন্ডাসট্রিয়াল প্রোডাক্ট, আপনার ভেতরের মহানুভবতা সে বোঝে না। আমাদের এখানে এমন কোনও প্রতিষ্ঠানও নেই যেখানে তরুণদের এই ভাবনাকে, সৃজনশীলতাকে গুরুত্ব দিয়ে যত্ন সহকারে বিকশিত হতে সাহায্য করবে।

রাসেল আহমেদ আমাদের জন্যে একটি সংকেত, একটি আর্কিওটাইপ হয়ে থাকবেন এতে কোনও সন্দেহ নেই।

 

গোঁসাই পাহ্‌লভী, ভাস্কর, লেখক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত