আল আমিন হোসেন মৃধা

১৫ জুন, ২০১৭ ০০:৩৯

পাহাড়ে মৃত্যুর মিছিল : দায় প্রকৃতির, না রাষ্ট্রের?

অতি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের ফলে রাঙামাটি, বান্দরবান ও চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে উদ্ধার কাজে নিয়োজিত ৪ সেনা সদস্যসহ কমপক্ষে ১৩৮ জনের (সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী) প্রাণহানিতে গভীর শোক প্রকাশ করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি।

প্রবল বর্ষণে গত সোমবার মধ্যরাত ও গতকাল মঙ্গলবার ভোরে পাহাড় ধসে রাঙামাটি থেকে ১০৬ জন, রাঙ্গুনিয়ায় ২১ জন, চন্দনাইশে তিনজন, বান্দরবানে ছয়জন এবং খাগড়াছড়ি থেকে একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। পাহাড় ধসে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে রাঙামাটিতে। মঙ্গলবার ভোর পাঁচটা থেকে রাঙামাটি শহরের বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় ধস শুরু হয়। বেলা ১১টা পর্যন্ত ছয় ঘণ্টায় শহরের ভেদভেদি, রাঙ্গাপানি, যুব উন্নয়ন, টিভি স্টেশন, রেডিও স্টেশন, রিজার্ভ বাজার, মোনঘর, শিমুলতলি ও তবলছড়ি এলাকায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। সেখানে এখনো অনেকে লোক মাটিচাপা পড়ে আছে। মঙ্গলবার পর্যন্ত রাঙামাটির বিভিন্ন স্থান থেকে শতাধিক লাশ উদ্ধার করা হয়। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সেনাবাহিনীর দুই কর্মকর্তা ও দুই সৈনিক। পাহাড় ধসে বন্ধ হয়ে যাওয়া রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়ক চালু করতে গিয়ে প্রাণ হারান তাঁরা।

চট্টগ্রামসহ পার্বত্য তিন জেলায় পাহাড় ধসের ঘটনা এই প্রথম নয়। এর আগেও এরকম ভয়াবহ প্রাণহানি ঘটনা ঘটেছে। ২০০৭ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পাহাড় ধসে এদেশে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেছে।

বিগত কয়েক বছরে (বৃহৎ) পাহাড় ধসে নিহতের পরিসংখ্যানঃ
১১ জুন ২০০৭ চট্টগ্রামে মারা যায় ১১২ জন।
১৫ জুন ২০১০ কক্সবাজার ও বান্দরবনে মারা যায় ৬০ জন (৬ সেনা সদস্য সহ)।
২৭ জিন ২০১২ চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও কক্সবাজারে মারা যায় ১১৫ জন।
১৩ জুন ২০১৭ চট্টগ্রাম, বান্দরবান, কক্সবাজার ও খাগড়াছড়িতে মারা যায় ১৩৮ জন।

ধারাবাহিকভাবে প্রতি বছর পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনা শুধু মাত্র কি প্রাকৃতিক বিপর্যয়? প্রতি বছর পাহাড় ধসে যে সংখ্যক মানুষকে প্রাণ দিতে হচ্ছে এটা কেবল মাত্র অতি বর্ষণের ফলে পাহাড়ি ঢলের কারণে সৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়। এটা একটি মনুষ্য সৃষ্ট বিপর্যয় বটে, যার দায় রাষ্ট্রের। ভূমিদস্যুদের অবৈধ পাহাড় কাটা এবং পাহাড়ের গাছপালার অবাধ কর্তনের ফলে পাহাড়গুলোর গোড়া মাটিশূন্য এবং পাহাড়গুলো বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়েছে। ফলে বালুময় পাহাড়গুলোর বালু-পাথর-গাছের শিকড়ের যে বন্ধন, তা আলগা হয়ে ভূমিধসের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।

সরকার কর্তৃক পাহাড় ইজারা দেয়া এবং ইজারাদার কর্তৃক অবৈধভাবে পাহাড় কাটা, গাছপালা কাটা এবং পাহাড়ের ঢালে বসতি স্থাপনের কারণেই প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে এই অসংখ্য প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। আর এই নিরীহ পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর হতাহতের দায়দায়িত্ব সরকারকেই বহন করতে হবে।

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) এবং বাংলাদেশ ভবন নির্মাণ আইন (১৯৫২) অনুযায়ী কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোনও পাহাড় কাটা যাবে না। এই আইন থাকলেও সরকারি নেতা-নেতাকর্মীরা গভীর অরণ্যে এমনকি প্রকাশ্যেই পাহাড় ও গাছপালা কেটে নির্মাণ করছে ইটভাটা। ইট তৈরিতে ব্যবহার করছে পাহাড়ের মাটি ও জ্বালানি হিসেবে ইট পোড়ানোর কাজে ব্যবহার করছে পাহাড়ি গাছপালা। এগুলো দেখার কেউ নেই। কারণ দেখবে যারা, করছে তাদেরই লোকজন।

মানুষ প্রাকৃতিক জীব, প্রকৃতির সাথেই মানুষের বেড়ে ওঠা। প্রকৃতিকে ব্যবহার করেই মানুষের বেঁচে থাকার জীবিকা অর্জন। কিন্তু এই প্রকৃতিকে মানুষ যখন তার ব্যবহারে বাধ্য করে এবং প্রকৃতির উপর অস্বাভাবিক কার্যক্রম চালায়, প্রকৃতি তখনই প্রতিশোধ নেয়। প্রকৃতির সাথে মানুষের নিবিড় সম্পর্ক তখন রূপ নেয় বৈরিতায়। প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্ক-বৈরিতা বিষয়ে অতি চমৎকারভাবে ফ্রেডরিক অ্যাঙ্গেলস আলোচনা করেছিলেন তাঁর 'প্রকৃতির দ্বন্দ্ববাদ' শীর্ষক গ্রন্থে।

ঐ গ্রন্থে তিনি বলেছিলেন, ‘প্রকৃতির ওপর আমাদের বিজয় নিয়ে নিজেদের গর্বিত ভাবার দরকার নেই। কারণ, প্রতিটি বিজয়ের পর প্রকৃতি প্রতিশোধ নেয়।'

ঠিক তেমনি কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় পাহাড় কেটে, পাহাড়ের গাছপালা কেটে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি পার্বত্য অঞ্চলের উপর স্টীম রুলার চালানোর ফলে প্রকৃতির নেওয়া প্রতিশোধে পাঠার বলি হচ্ছে নিরীহ পাহাড়ি জনগোষ্ঠী।

একদিকে আমাদের শাষকগোষ্ঠীরা কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার জন্য মহাপ্রাণ সুন্দরবনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়ে ক্ষতিপুরণ হিসেবে যেমন গাছ লাগানোর কথা বলছেন, অপরদিকে তেমনি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে শত শত মানুষের নিহত হবার মূল ঘটনাকে আড়াল করে ক্ষতিপুরণ হিসেবে ত্রাণ তৎপরতা দেবার নামে নামে মিডিয়াতে গলাবাজি করছেন।

প্রকৃতির উপর মানুষের হাত নেই। এমনকি প্রাকৃতিক বিপর্যয়েও মানুষের কিছু করার থাকে না। কিন্তু কি কারণে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটছে, তার মূল সমস্যার সমাধানের দিকে সরকার হাত না বাড়ালে এ মৃত্যুর মিছিল থামবে না এ সংখ্যা প্রতিবছর বাড়তেই থাকবে। ত্রাণ সহায়তা দিয়ে মানুষকে দু'বেলা খাওয়ানো যায়, ভাঙ্গা ঘর পুনঃনির্মাণ করা যায়, কিন্তু মৃত ব্যক্তিকে ফিরিয়ে আনা যায় না।

  • লেখক : রাজনৈতিক কর্মী
  • এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত