সীমান্ত দেব

২০ জুন, ২০১৭ ০১:৪৫

আমরা কি নিজেদের জয়ে জয়ী হতে পারি না?

জাতীয়তাবাদ বিষয়টি কেন হাস্যকর? সবক্ষেত্রে কি জাতীয়তাবাদ বিষয়টি আদৌ হাস্যকর?

পাকিস্তান ও আফগানিস্তান এর সাধারণ মানুষের ওপর হামলা বা অত্যাচার হলে তাকে যেমন জাতীয়তাবাদের নাম ধরে সাধুবাদ দেয়া যায় না, তেমনি শুধু ক্ষমতার দম্ভে যে জাতি বা সম্প্রদায় ৩০ লাখ মানুষ নির্বিচারে হত্যা করতে পারে সে জাতির আদর্শে আদর্শিক কোনো মানুষকেই জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে গিয়ে সমর্থন দেয়া যায় না।

কেন পাকিস্তান আমার কাছে বর্জিত? এ প্রশ্নের খুব সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা আছে আমার কাছে। যে মানুষ অন্য মানুষকে হত্যা করতে পারে, ধর্ষণ করতে পারে, অত্যাচার-নিপীড়ন-শোষণ চালাতে পারে, এখন সে যে দেশেরই হোক আর যে সম্প্রদায়েরই হোক, সে সবসময় আমার কাছে বর্জিত।

শুধু সে-ই নয় তার এই হত্যার আদর্শে যারা যারা আদর্শিক তারা সবাই আমার কাছে বর্জিত, নর্দমার কিটমাত্র। আর পাকিস্তানীরা তো এক-দুজনকে হত্যা করেনি, নির্বিচারে লাখো মানুষ হত্যা করেছে। আর সে হত্যার দায় ততদিন পর্যন্ত প্রত্যেকটা পাকিস্তানীর যতদিন না পর্যন্ত তারা এ অপরাধের জন্য ক্ষমা ভিক্ষা করছে এবং তাদের প্রাপ্য শাস্তিটি পাচ্ছে। কারণ প্রত্যেকটা পাকিস্তানী আজও লাখো সাধারণের হত্যার আদর্শে আদর্শিক।

কয়েকদিন যাবত আমাদের জাতীয়তাবাদের কিছু বিরূপ চিত্র আমার চোখে পড়ছে। ইদানিংকালে ভারত আমাদের কটাক্ষ করছে তাই আমরা জাতি হিসেবে খুবই সোচ্চার তাদের প্রতি, আমরা তাদের প্রতিক্ষেত্রে দাঁতভাঙা জবাব দিতে চাই, কিন্তু যে পাকিস্তান ৭১ থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের গালি দিয়ে যাচ্ছে তাদের আমরা ভাই হিসেবে গ্রহণ করেছি শুধুমাত্র ভারত-জাতিকে জবাব দেয়ার জন্য। কত হাস্যকর না?

ধরে নিলাম, এখন ভারত যা করছে তা ৭১ এর গণহত্যা থেকে বেশি অন্যায়ের কাজ। তাহলে কি আমরা এক অন্যায়কে নিঃশেষ করার জন্য অন্য আরেক অন্যায়কে প্রশ্রয় দিচ্ছি ? নাকি ৭১ এর গণহত্যা আমাদের কাছে এখন আর কোনো অন্যায়ই না? এটি কি অন্য দশটি অতীতের মত যা আজ আমরা ভুলে যেতে বসেছি? নাকি পেয়ারা পাকিস্তান আজও আমাদের মনের কোনে ঠিকই জায়গা নিয়ে বসে আছে?

১৯৪৭ এ ভারত পাকিস্তান আলাদা হয়েছিল ধর্মের জেরে। কিন্তু পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ এর আলাদা হওয়ার কারণ কি ধর্মের জের ছিল?

দেশের অনেক মুসলমান আজও পাকিস্তানকে সমর্থন করে। আজ যদি বাংলাদেশ আবার পাকিস্তান হয়ে যায় তাতেও তাদের কিছু যায় আসে না। আবার দেশের অনেক হিন্দু আজও ভারতকে সমর্থন করে। এবং আজ যদি বাংলাদেশ হিন্দুস্তান হয়ে যায় তাহলে তাদেরও কিছু যায় আসে না। কারণ আমরা জাতি হিসেবে নিজেদের ভাগ করে নিয়েছি।

মুসলমানরা মনে করে দেশ পাকিস্তান হলে আমি শক্তিশালী আর হিন্দুরা মনে করে দেশ ভারত হলে আমি শক্তিশালী। কিন্তু বাংলাদেশটা বাংলাদেশ থাকলেই যে আমরা সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী তা মনে করার মত লোক আজ দেশে খুব বেশি একটা নেই।

আজ আমরা মনুষ্যত্বের উপরে দিয়ে জাতীয়তাবাদকে স্থান দিয়েছি, নিজের সম্প্রদায়কে স্থান দিয়েছি, যার জন্য আজ আমরা বিভক্ত। এবং এই ধরনের জাতীয়তাবাদ সবসময়ই প্রশ্নবিদ্ধ ও হাস্যকর।

কোনটি বড় অপরাধ? পাকিস্তানের ৭১ এর গণহত্যা নাকি ভারতের এখনকার শোষণ?

ভারতকে আমরা এখন দোষারোপ করি , তাদের ওপর প্রতিশোধ নিতে চাই কারণ আজ তারা সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা করছে, টিপাইমুখ বাধ দিয়ে দেশকে মরুভূমি বানিয়ে রেখেছে, তিস্তার পানি দিচ্ছে না, ক্রিকেট খেলায় অধিনায়ক বিরাট কোহলি জিহ্বা বের করে আমাদের ব্যঙ্গ করেছে, সাবেক অধিনায়ক মোস্তাফিজকে ইচ্ছে করে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে, ব্যাটসম্যান শেবাগ বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমকে নাতি বলেছে।

আর আমরা পাকিস্তানকে দোষারোপ করি, কারণ ৭১ এ তারা লাখো নারী ধর্ষণ করেছে, লাখো মানুষকে অত্যাচার , শোষণের পর নির্বিচারে হত্যা করেছে, এমনকি আজও তারা আমাদের বিভিন্নভাবে ব্যঙ্গ করছে এই বলে যে, পাকিস্তানীদের পা চাটার মত বাংলাদেশীর অভাব নেই।

প্রতিটি ঘটনা নিঃসন্দেহে ন্যক্কারজনক। কিন্তু কখনই দুটিকে এক করে দেখা যায় না। কারণ পাকিস্তানের প্রায় সব মানুষ আজও আমাদের আমাদের নিকট তাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত নয়, ক্ষমাপ্রার্থী নয়, বরং তারা সবাই তাদের হত্যার আদর্শকে ঠিক মনে করেই এগিয়ে যাচ্ছে। যার জন্য কখনই পাকিস্তানকে সমর্থন দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। যদি কোনো একক ব্যক্তি এসে তাদের পূর্বপুরুষের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চায় ও অনুতপ্ত হয় তাহলে সে একক ব্যক্তিকে আমার সমর্থন দিতে কোন সমস্যা নেই, সে ব্যক্তিকে ভালবাসতে আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এমন কোনো মানুষ এখনো আমি পাই নি।

বিভিন্ন সংগঠনের সাথে জড়িত থাকার ফলে বিভিন্ন দেশ বিদেশের মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে, তেমনি পাকিস্তানের কারো কারো সাথেও হয়েছে, তারা বর্তমানে বাংলাদেশকে অনেক দিকে থেকে সাধুবাদ জানালেও , তারা তাদের পূর্বের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত নয়, তাদের কৃতকর্ম ভুল, এটি স্বীকার করতে তাদের গায়ে লাগে। তাই আমি তাদের সমর্থন করতেও বাধ্য নই, বরং ঘৃণা করতেই বাধ্য। আর পাকিস্তানীদের থেকেও তাদের প্রতি ঘৃণাটা আজ বেশি যারা আজ স্বাধীন বাংলাদেশে থেকে পাকিস্তানের গুণগান করে এবং ৭১-কে অতীত মনে করে ভুলে যেতে চায়।

আজ ভারত বিভিন্ন উপায়ে আমাদের শোষণ করছে, পরোক্ষভাবে শোষণ করছে। কিন্তু এই শোষণের প্রতিবাদও ভারতের কিছু লোকজন করছে। তাদের প্রত্যেকটি মানুষ ভারতের রাষ্ট্রীয় সকল সিদ্ধান্তের সাথে একমত পোষণ করে না, কিছু কিছু এর বিরোধিতাও করে। তারা জাতীয়তাবাদের উপরে উঠে গিয়ে মনুষ্যত্বের জন্যও চিন্তা করে।

আমি এমন অনেক বাংলাদেশী দেখেছি যারা ভারতীয়দের বাংলাদেশ সমর্থনে অনুপ্রাণিত হয়ে ভারত সমর্থন করতে শিখেছে। আর ৭১ এ ভারতের সমর্থনের কথা না-ই বললাম। ভারতীয়রাই সর্বপ্রথম আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। ৭১-এ ভারতীয় যে কারণেই আমাদের সমর্থন দিয়ে থাকুক না কেন, তারা আমাদের ১ কোটি মানুষকে জায়গা দিয়ে তাদের প্রাণ বাঁচিয়েছিল। ৭১-এ যারা বন্ধু হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিল তাদের মধ্যে ভারতের নামই তালিকার প্রথমে থাকা উচিত। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির ওপর বিচার করলে ভারত তাদের অনেকখানি মর্যাদা হারিয়েছে। সীমান্ত হত্যা সহ সকল অন্যায়ের বিচারও খুব শীঘ্রই হওয়া উচিত।

পাকিস্তান ভারতকে হারালে আমরা জিতে যাব এ ধরনের চিন্তা ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদের জয় আমাদেরই ছিনিয়ে আনতে হবে। ধর্ম, সম্প্রদায়, জাতীয়তাবাদের ওপরে মনুষ্যত্বকে স্থান দিতে হবে।

পাকিস্তান অথবা ভারতকে ভাই বানিয়ে ওদের জয়কে আমাদের জয় বানানোর আগে নিজেদের একবার প্রশ্ন করে নিতে হবে যে, আমরা কি নিজেদের জয়ে নিজেরা জয়ী হতে পারি না?

  • এবিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত