হাফিজুর রহমান মিতু

২৩ জুন, ২০১৭ ০৩:৫৭

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মৌলবাদ

আওয়ামী লীগ কর্মী রমজান আলীর দুই ছেলে-মেয়ে পড়েন ঢাকা মাল্টিমিডিয়া স্কুল এন্ড স্পোর্টস একাডেমিতে। বড় মেয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে আর ছোট ছেলে প্লে-গ্রুপে। এক বছর পেরোতেই রমজান আলী তার ছোট ছেলেকে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিলেন। খবর পেয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ তার বাসায় গেলে রমজান আলী জানালেন, তিনি তার ছেলেকে হাফেজ বানাবেন। যদি কোন রকমে তার ছেলে কোরানে হাফেজ হতে পারে, তাহলে তার জন্য বেহেস্ত কনফার্ম।

দুই.
মসজিদে এশার নামাজ আদায় করে ফেরার সময় দেখা হলো এলাকার রিপন নামে এক বড় ভাইয়ের সাথে। অনেক দিন পর দেখা হলো তাঁর সাথে। কুশল বিনিময় ও পারিবারিক খোঁজ খবর আদান-প্রদানের এক পর্যায়ে তিনি জানালেন যে, তার এক ছেলেকে মাদ্রাসায় পড়তে দিয়েছেন। তাঁর ইচ্ছা ছেলে কুরআনে হাফেজ হবে। এতে করে তাঁর এবং তার স্ত্রীর বেহেস্ত যেমন কনফার্ম হবে তেমনি তার ছেলেও সুপথে চলবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।

তিন.
গিয়েছিলাম এক বিয়ের অনুষ্ঠানে। পরিচিত-অপরিচিত অনেকের সাথেই সেখানে দেখা ও কথা হয়েছে। অধিকাংশের ভাষ্য প্রায় একই যে, তাদের ছেলে বা মেয়েকে হাফেজ/আলেম বানিয়ে তাদের বেহেস্তের যাওয়ার রাস্তাটা পরিষ্কার রাখা।

বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে অনেকগুলো কারণের মধ্যে এমন একটি কারণ ছোটবেলায় পড়েছিলাম, বাবা-মা মনে করেন তারা যখন বৃদ্ধ হবে তখন ছেলে-মেয়েরা তাদের দেখভাল ও আয়-রোজগার করে খাওয়াবে। সে আশায়ই তাঁরা বেশি বেশি ছেলেমেয়ে জন্ম দিয়ে বৃদ্ধ বয়সে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকার স্বপ্ন দেখেন।

সে সময়ের সাথে বর্তমান সময়ের সামাজিক মানসিকতার যে খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে তা নয়; বরং ক্ষেত্রবিশেষে সে মানসিকতার দৃশ্য আরও প্রকট হয়েছে বলেই মনে হয়!

শেষ বয়সে শুধু স্বাচ্ছন্দ্যে থাকাই শেষ কথা নয়, আরও একধাপ এগিয়ে এবং কোন ধরণের রাখঢাক না রেখে ছেলেমেয়েদের আলেম/হাফেজ বানিয়ে বাবা-মায়েরা এখন বেহেস্তের চাবি হাসিলের নিশ্চয়তার মিশনে নেমেছেন।

বর্তমান সমাজের চিত্র বা মানুষের মননে এবং স্বপনে পরকাল ভাবনর বীজ রোপণের অন্যতম ঠিকাদার যে বাংলাদেশের ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা অগণিত মৌলবাদী সংগঠনগু‌লি, তা বোঝার জন্য খুব বেশি বোদ্ধা হওয়ার দরকার আছে বলে মনে করিনা। দৃশ্যমান রাস্তার মো‌ড়ে মো‌ড়ে গজিয়ে ওঠা মাদ্রাসা, ওয়াজ মাহফিলের বিকট শব্দ আর মসজিদের মাইকে মাওলানাদের বিরামহীন বয়ানের মাধ্যমে খুব সহজেই মৌলবাদীরা সাধারণ মানুষদের মন-মানসিকতাকে তাদের দি‌কে ডাইভার্ট কর‌তে পার‌ছে।

যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নি‌য়ে ১৮৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ভারতের দেওব‌ন্দ মাদ্রাসা, আজ তা স্বাধীন বাংলাদেশে পরিপূর্ণতার দোরগোড়ায় চ‌লে এসেছে প্রায়। ২০১৩ সালের ৫ মে তারই যে একটা মহড়া সবাই দেখতে পেয়েছিল, বোধকরি কেউই তা ভুলে যাননি।

ধর্মীয় ‌মৌলবাদ যে এসমা‌জের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে, তার নমুনা আজ ঢাকার প্রায় প্রতিটা প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়গু‌লোর দি‌কে তাকালে বোঝা যায়। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল সহ আরও কয়েকটি স্কুলে ছাত্রদের মাথায় টুপি পরা বাধ্যতামূলক করা হ‌য়ে‌ছে। অথচ এই রীতি কিছু দিন আগেও শুধুমাত্র মাদ্রাসার সংস্কৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

মৌলবাদীরা সাধারণ মানুষ‌দের এই বলে বোঝাতে সক্ষম হ‌য়েছে যে, অসামাজিক বা অনৈতিক কাজ করেও যদি সন্তান‌দের হা‌ফেজ/আলেম বানানো যায়, তাহলে সে প্রক্রিয়ার মাধ্যমেও বেহেস্ত লাভের নিশ্চয়তা লাভ করা সম্ভব! পাশাপাশি প্রক্রিয়াগতভাবে এসব সন্তানদের যখন মাদ্রাসায় ভর্তি করানো হয়, তখন তা‌দের কোমল মনে ধর্মীয় জঙ্গিপনা বা উন্মাদনার বীজ ঢুকিয়ে দেয়ার মাধ্যমে কথিত ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার মিশন কাফেলা দীর্ঘ করা হয়। অথচ এর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যারা বিশ্বাসী তাঁরা কি করছেন! একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার বাস্তবায়নে অনেকগু‌লি সংগঠনই বিভিন্ন নামে ও ব্যানারে কাজ করছেন। রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ছাড়াও অনেক অরাজনৈতিক সংগঠন রয়েছে যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের জন্য একচ্ছত্র ‘ঠিকাদার’ বলে দাবি করলেও তাঁদের কাজের পরিধি ও যথেষ্টতা নিয়ে প্রশ্ন করাই যেতে পারে!

মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবীর সন্তানেরা ছাড়াও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি সহ ব্যক্তিপর্যা‌য়ে অনেকেই একাত্তর নি‌য়ে গবেষণা ক‌রে মোটা মোটা বই লিখছেন। কিন্তু তাঁদের বই‌য়ের ভিতরের লেখাগু‌লো সাধারণ মানুষের কাছে কতটুকু পৌঁছাতে পারছে বা গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে, তার কোন তথ্য আছে?

তবে উল্লেখিত সংগঠনগুলোর কর্ণধারগণ তা‌দের কর্মের প্রচার ও প্রসারের নামে দেশ-বিদেশে অন্যের খরচে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং বিভিন্ন প্রজেক্টের নামে তহবিল সংগ্রহ করে তা লোপাটও করছেন। বাক্সবন্দি টি‌ভি টক‌শো আর এক দুইটা পত্রিকায় কলাম লিখে কথিত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় সুশীলের তকমা লাগিয়ে নিজ নাম বিশেষণের লাইনই শুধু দীর্ঘ থেকে দীর্ঘায়িত করছেন; কিন্তু কাজের কাজ যে কিছুই হচ্ছেনা।

মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ একাত্তরের চেতনা যেমন নতুন প্রজ‌ন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে সমাজের তৃণমূল পর্যায়ে কোন কাজ করছেনা, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের ঠিকাদারি নেয়া সংগঠনগু‌লোও মোটামুটি একই পথের যাত্রী হয়েছে। অর্থাৎ একাত্তরের চেতনাধারী সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতারা নতুন প্রজন্মের কাছে ৭১-এর চেতনা পৌঁছাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হ‌য়ে‌ছেন। বর্তমান ডিজিটাল যুগে বদ্ধ রুমের সেমিনার, টকশো আর পত্রিকায় কলাম লিখে নতুন প্রজন্মকে কখনই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা উদ্ধুব্ধ করা সম্ভব নয়। বরং নতুনকে নতুন আঙ্গিকে গ্রহণ করার যে নৈতিক মানসিকতা তা থেকেই শিক্ষা নিয়ে ‘আধুনিকতাকে’ বরণ করার চেষ্টায় উদ্ধুব্ধ করতে হবে।

আমার এক চিত্রপরিচালক বন্ধু যিনি দীর্ঘদিন প্যারিসে বসবাস করেন। শুটিংয়ের কাজে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন কয়েক বছর আগে। ওর আশা ছিল স্থায়ীভাবে থেকে যাবে বাংলাদেশে। বছর দুই পূর্বে কথা প্রসঙ্গে তাঁর বাংলাদেশের বসবাসের অভিজ্ঞতা থেকে বললো যে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সংগঠনগু‌লোর চরম হঠকারিতা ও ব্যর্থতার কারণে ধর্মীয় মৌলবাদ ক্রমশই শক্তিশালী হচ্ছে। তা‌দের ধর্মীয় আহবান খুব কৌশ‌লের সাথে পৌঁছে যাচ্ছে ঘরে ঘ‌রে। আফগানিস্তানে মোল্লা ওমর যে কারণে ক্ষমতা হা‌রি‌য়ে‌ছিল, সেই কারণগুলোকে শুধরে এবং ভুল থেকে শিক্ষা নি‌য়ে বাংলাদেশের ধর্মীয় মৌলবা‌দীরা এগিয়ে যাচ্ছে প্রায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে।

বাংলাদেশের পরিস্থিতি আফগানিস্তান থেকেও ভয়াবহ হতে পারে বলে জানিয়েছিল সেই বন্ধু। আক্ষেপের সুরে আমার সেই বন্ধু বলেছিল, মৌলবাদীরা ইসলাম ধর্ম নিজেদের মত ক‌রে প্রচার ক‌রে দল বা সংগঠনের স্বার্থের কথা মাথায় রেখে, আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রচারিত হয় বিশিষ্টজনের নিজ ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলের জন্য!

দুঃখজনক হলেও এর পরিণতির দায়ভার কেউ নেবে না। হয়ত আগামীর ইতিহাসটাও রচিত হবে এই পথ ধরেই।

  • হাফিজুর রহমান মিতু: ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিষ্ট
  • এবিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত