আকরামুল হক

২১ জুলাই, ২০১৭ ২৩:১৬

নাগরিক কর্তৃত্ব বাস্তবায়নে তাহের হত্যার রায় কার্যকর জরুরি

১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই খুন হয়ে যান কর্নেল আবু তাহের। সামরিক জান্তা জেনারেল জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া সামরিক আদালতের রায়ে কর্নেল তাহেরের জীবনাবসান ঘটে। সে সামরিক আদালতের চেয়ারম্যান ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্নেল ইউসুফ হায়দার; সদস্যরা হলেন উইং কমান্ডার আবদুর রশীদ, নৌ সদর দপ্তরের কমান্ডার সিদ্দিক আহমেদ, ঢাকা দক্ষিণের প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল আলী, ঢাকা উত্তরের ম্যাজিস্ট্রেট হাসান মোর্শেদ।

এ আদালতটি গঠিত হয় তৎকালীন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ আবু সায়েমের নির্দেশে। ইতিহাস অবলোকন করলো এক নির্মম দৃশ্যের, একজন বেসামরিক বিচারপতি যিনি সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়েছিলেন তিনি প্রধান সামরিক প্রশাসক হয়েছিলেন! ক্ষমতার ক্লেদাক্ত রাজনীতিতে একজন বিচারপতিও কুশীলব ছিলেন।

১৯৭৫ সালের বিয়োগান্তক পরিস্থিতির ঘটনা পরিক্রমায় ক্যু পাল্টা ক্যু'র খেলায় জড়িয়ে যায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

কর্নেল তাহের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তান থেকে পালিয়ে। মুক্তিযুদ্ধে তিনি আহত হয়েছিলেন, তাঁর একটি পা কেটে ফেলতে হয়েছিল। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে খুন করার পরপরই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও আওয়ামী লীগের রাজনীতির পাকিস্তানপন্থী ধারা ক্ষমতায় বসে। ১৫ আগস্টের বিয়োগান্তক ঘটনার পর খন্দকার মোস্তাক আহমেদের পুতুল সরকারের হাত ধরে 'বাংলাদেশ জিন্দাবাদের' রাজনীতিতে ফেরত যায়। মোস্তাক আহমেদের হাত ধরেই পাল্টা ক্যু করা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ সেনাপ্রধান হন এবং জেনারেল জিয়াকে বন্দি করেন। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ক্ষমতা গ্রহণকালীন সময়েই জাতীয় চার নেতা খুন হয়ে যান জেল অভ্যন্তরে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেনা সদস্যদের হাতে। পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা, জেল অভ্যন্তরে রাজনৈতিক নেতা খুন তাও আবার সেনা সদস্যদের হাতে!

সেনা অভ্যন্তরে ও রাজনীতিতে অস্থিরতার অবসানকল্পে কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার হাত ধরে জাসদের রাজনৈতিক সহযোগিতায় পাল্টা ক্যু ঘটে সেনাবাহিনীতে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর। বন্দি জেনারেল জিয়া মুক্ত হন। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সমস্ত দাবিদাওয়া মেনে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জেনারেল জিয়া জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তা উল্লেখ করেননি। জাসদ ও কর্নেল তাহেরের সাথে বৈঠকে দেয়া প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসেন জেনারেল জিয়া, একই সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার দাবির সাথেও, যে সেনারা জিয়াকে মুক্ত করেছিলেন।

ক্ষমতার দৃশ্যপট থেকে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ও জাসদকে কোণঠাসা করে ফেলেন জেনারেল জিয়া। পাকিস্তানপন্থী সেনা অফিসার ও সাম্রাজ্যবাদের সহায়তায় জেনারেল জিয়া ক্ষমতা সংহত করেই জিয়া জাসদ নেতৃবৃন্দ ও কর্নেল তাহেরকে বন্দি করেন ১৯৭৫ সালের ২৩ ও ২৪ নভেম্বর।

১৯৭৫ সালের ১৫ জুন সামরিক আদালতটি গঠন করেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। আদালত গঠনের ৪০ দিনের মাথায় সামরিক আদালত কোন বিধিবিধানের তোয়াক্কা না করে জেনারেল জিয়ার নির্দেশে কর্নেল তাহেরকে ফাঁসির আদেশ ঘোষণা করে।

যুদ্ধে পা হারানো স্বাপ্নিক একজন মুক্তিযোদ্ধার খুন প্রত্যক্ষ করে বাংলাদেশ ও পৃথিবী। যুদ্ধে ফেরত মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহের কুমিল্লা সেনানিবাসে যোগ দিয়ে কুমিল্লা সেনানিবাসে ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির অবসান ঘটান। তিনি সেনা সদস্যদের কৃষকদের সাথে কাজে লাগান। সেনা অভ্যন্তরে চাষাবাদের কাজে লাগান সেনা সদস্যদের। উৎপাদনমুখী এক সেনাবাহিনী গঠনে আত্মনিয়োগ করা অফিসারকে সেনাবাহিনী থেকে অপসারিত করেন তৎকালীন সেনাবাহিনী ও সরকার।

কর্নেল তাহেরের হত্যাকাণ্ডের পর সেনাবাহিনী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। এর জেরে সেনা অভ্যন্তরে নানান বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। ফলে মারা যান শত শত সৈনিক। জেনারেল জিয়া ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেই বুটের লাথিতে বিদায় করেন বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে। জিয়া একই সাথে সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতির পদ দখল করে দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা সেজে বসেন।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহায়তায় তৈরি করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। বাংলাদেশের সংবিধানকে বুটের ডগায় পিষে ফেলে বেয়নেটের খোঁচায় তৈরি করেন নতুন সংবিধান। জনযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের রাজনীতি ও মূল্যবোধকে পাঠান যাদুঘরে। পাকিস্তানের সাথে একাত্মতাপোষণকারী ৭১’এর খুনি জামায়াত-শিবিরকে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করেন। রাজাকারদের ধরে এনে মন্ত্রিত্ব দেন জিয়া। দেশ ও জাতির সাথে চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা করেন তিনি।

জিয়ার বিশ্বাসঘাতকতার নমুনা হলো ৭৯-এর সংসদে একটি আইন, যে আইনের বলে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার ও জাতীয় চার নেতার হত্যার বিচার বন্ধ হয়ে যায়। ৭৫-এর খুনিদের জিয়া সূর্যসন্তান হিসাবে দায়মুক্তি দিয়েছিলেন। সংবিধানের চার মূলস্তম্ভ ভেঙেচুরে একাকার করা জিয়া ঘোষণা দিয়েছিলেন ‘তিনি রাজনীতি রাজনীতিবিদদের জন্য কঠিন করে তুলবেন, একই সাথে বলেছিলেন টাকা কোন সমস্যা না।' টাকায় রাজনৈতিক নেতা কেনাবেচায় তিনি তার কথা রেখেছিলেন। রাজনীতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা আদর্শের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার রাস্তা জেনারেল জিয়াই খুলেছিলেন।

কর্নেল তাহের হত্যাকাণ্ডের ৩৫ বছর পর হাইকোর্ট জান্তা জিয়ার শাসনামলকে জঙ্গলের শাসন বলে অভিহিত করে এবং কর্নেল তাহের হত্যাকাণ্ডকে ঠাণ্ডা মাথার খুন বলে অভিহিত করে।

আমরা বিস্ময়ে দেখতে পাচ্ছি এ রায়ের আলোকে সরকার ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি তৎকালীন সেনাশাসনের সাথে জড়িত সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেনা কর্তৃত্ব ও এ ধারার রাজনীতি অবসানকল্পে ৭৯-এর সসদের সেই সমস্ত আইন প্রণেতারও বিচারের জন্য আইন প্রণয়ন করা দরকার, যারা আইন বানিয়েছিলেন খুনের বিচার করা যাবে না বলে। ক্ষমতার উচ্ছিষ্টলোভীরা বিপদজনক, যে কোন সময় এ সমস্ত জ্ঞানপাপীরা আবারও ক্ষমতার তখতে তাউসে নিজেদের বসাতে তৎপর থাকবে।

সর্বোচ্চ আদালত কর্নেল তাহের সম্পর্কে যে রায় দিয়েছে সে আলোকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও সরকার ব্যবস্থা নেবে বলেই মনে করি। আমরা কতটা সভ্য হয়ে উঠেছি তা এ রায় বাস্তবায়নের মাধ্যমেই ফুটে উঠবে। বাংলাদেশের নাগরিক শক্তির জয়গান ও নাগরিক কর্তৃত্বের জন্যই এ রায়ের বাস্তবায়ন করতে হবে।

  • আকরামুল হক: অনলাইন এক্টিভিস্ট।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত