দেবজ্যোতি দেবু

০৬ আগস্ট, ২০১৭ ০০:৫৬

বন্ধু, বন্ধুত্ব: খুঁজি, খুঁজে যাই...

ছবি: সংগ্রহ

বন্ধু মানে বাঁধ ভাঙার গান,
বন্ধু মানে দুই দেহে এক প্রাণ।
বন্ধু মানে অহর্নিশ হাসাহাসি,
বন্ধু মানে তুমি আছো, আমি আছি।

বন্ধুত্ব নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘বন্ধুত্ব বলিতে তিনটি পদার্থ বুঝায়। দুই জন ব্যক্তি ও একটি জগত। অর্থাৎ দুই জনে সহযোগী হইয়া জগতের কাজ সম্পন্ন করা। আর প্রেম বলিলে দুই জন ব্যক্তি মাত্র বুঝায়, আর জগত নাই। দুই জনেই দুই জনের জগত।’

তিনি আরও বলেছেন ‘ইহা ছাড়া আর একটা কথা আছে, প্রেম মন্দির ও বন্ধুত্ব বাসস্থান। মন্দির হইতে যখন দেবতা চলিয়া যায় তখন সে আর বাসস্থানের কাজে লাগিতে পারে না, কিন্তু বাসস্থানে দেবতা প্রতিষ্ঠা করা যায়।’

আইরিশ কথাসাহিত্যিক ও সমালোচক সি.জি লিউইস বলছেন, ‘বন্ধুত্ব হল দর্শন কিংবা শিল্পকলার মতোই একটা অপ্রয়োজনীয় বিষয়। এর অস্তিত্বগত কোনও মূল্য নেই; এটা বরং এমন বিষয়গুলোর একটা যা অস্তিত্বকে মূল্যবান করে তোলে।’

ফরাসি লেখিকা আনাইস নিন বলেছেন, ‘একেক বন্ধু আমাদের মধ্যে একেকটা দুনিয়ার প্রতিফলন, হয়তো সে আসার আগ পর্যন্ত ওই দুনিয়াটাই জন্মায় না। আর কেবল বন্ধুর সঙ্গে মিলনের মধ্য দিয়েই ওই দুনিয়া জন্মাতে পারে।’

সক্রেটিস বলেছেন, ‘বন্ধুত্ব গড়তে ধীরগতির হও। কিন্তু বন্ধুত্ব হয়ে গেলে প্রতিনিয়তই তার পরিচর্যা করো।’

ফরাসি দার্শনিক ও লেখক আলবেয়ার কামু বলেছেন, ‘আমার সামনে সামনে হেঁটো না, আমি হয়তো অনুসরণ করব না। আমার পেছন পেছন হেঁটো না, আমি হয়তো পথ দেখাতে পারবে না। আমার পাশে হাঁটো এবং বন্ধু হও।’

আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করে “বন্ধু কি”? আমি চোখ বন্ধ করেই বলতে পারবো, বন্ধু মানে বুকে স্বপ্ন আর হাতে হাজারো রঙের ডালা নিয়ে পাশে থাকা এক দুর্ভেদ্য প্রাচীর। যার মন আকাশের মত বিশাল। যাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে যে নানা রঙে, নানান ঢঙ্গে রাঙিয়ে দিয়ে যায় সর্বক্ষণ। যে মানুষটা বিপদে প্রাচীর হয়ে পাশে দাঁড়ায়, সুখে রংধনু হয়ে রঙ ছড়িয়ে দেয়, দুঃখে দুঃখ তাড়ানিয়া পাখি হয়ে গান শোনায়, সেই আমার বন্ধু।

বন্ধু একটা নদীর নাম। যেখানে ইচ্ছে হলে শরীর ভরা দুঃখ নিয়ে ডুব সাতারে দুঃখহীন হওয়া যায়। চোখ বন্ধ করে ঝাপ দিলেও পরম মমতায় বুকে আগলে নেয়। নিশ্চিন্তে গা ভাসিয়ে দেয়া যায়। যার দিকে দুঃখের ঝুড়ি ছুড়ে দিলে সুখের বৃষ্টিতে ভিজিয়ে দেয়।

বন্ধু মানে কথাবৃক্ষ। যার সামনে নির্দ্বিধায় সব কথা বলা যায় আর সে চুপ করে শোনে। তপ্ত রোদেও যে শীতল ছায়া দেয়। ঝড় বৃষ্টিতে আশ্রয় দেয়। বন্ধু মানে আয়না। যার সামনে প্রতিমুহূর্তে নিজেকে দেখা যায়। যার সামনে কাঁদলে সেও কাঁদে, হাসে না। বন্ধু মানে আস্থা। বন্ধু মানে সেই মানুষ যে ফোনের এক প্রান্তে থেকে অন্য প্রান্তের দীর্ঘশ্বাসের, নীরবতার অর্থ বুঝে নেয়। বন্ধু মানে অক্সিজেন। চরম দুঃসময়েও যে নিঃশ্বাস নেয়ার ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়। বন্ধু সেই, যে স্বপ্ন দেখতে এবং দেখাতে জানে।

বন্ধু মানে অনেক কিছু। কিন্তু আসলে বন্ধু মানে যে কি, তার যথার্থ উত্তর আজও জানা হলো না। বন্ধুত্বকে আসলে কোন শব্দে বা বাক্যে বেঁধে দেয়া যায় না। এর পরিসর অসীম। ক্ষুদ্র জ্ঞানে বন্ধুত্বকে আর কিভাবেই বা সংজ্ঞায়িত করা যায়! অনেকে বলে স্বামী বা স্ত্রী হতে হবে বন্ধুর মত। অনেকে বলে বাবা মা’কে হতে হবে বন্ধুর মত। আবার অনেকে বলে ভালোবাসার মানুষটা যদি বন্ধুই না হলো তাহলে আমাকে বুঝবে কিভাবে! কিন্তু আসলেই কি সত্যিকারের বন্ধুর দেখা পাওয়া যায়?

আমাদের পূর্বপুরুষ থেকে শুরু করে আমাদের প্রজন্মের মানুষ পর্যন্ত অনেকেই বলেন ছেলে-মেয়ের মাঝে বন্ধুত্ব হয় না। এক সময় সেটা প্রেমে পরিণত হয়। কেউ কেউ এটাকে মেনে নিয়েই বলেন, ‘হোক না প্রেম ক্ষতি কি? তবুও তো বন্ধুত্ব টিকে থাকে।’

কেউ কেউ আবার এটাকে অস্বীকার করে বলেন, ‘বিশুদ্ধ বন্ধুত্বে কখনোই এমন হয় না। যে বন্ধুত্ব স্বার্থের ঊর্ধ্বে, যে বন্ধুত্ব উদার, যে বন্ধুত্বে কলুষতা নেই, সেটাই বিশুদ্ধ বন্ধুত্ব। সেখানে কখনোই প্রেম জন্মায় না। চাওয়া-পাওয়ার চাহিদা জন্মায় না। প্রকৃত বন্ধু শুধু দিতে জানে, নিতে জানে না।’

প্রশ্ন জাগে, এই বিশুদ্ধ বন্ধুত্বটা কি? কোথায় পাওয়া যায়? কিভাবে পাওয়া যায়? আক্ষরিক অর্থে এর উত্তর না পাওয়া গেলেও অনুভূতির বাগানে এর দেখা পাওয়া যায় প্রায়ই। যুদ্ধে নিশ্চিত পরাজয় জেনেও যে মানুষটা লড়াই করার সাহস যোগায়, জয়ের স্বপ্ন দেখায়, সেইতো বন্ধু। পরিচিত জনেরা যখন সঙ্গ ছেড়ে দিয়ে একা করে যায়, তখন হাতটি ধরে যে পাশে দাঁড়ায়, সেইতো বন্ধু। জীবনের প্রতিটি বাঁকে যে জীবনের মানে শেখায়, উৎসাহ দেয়, সেইতো প্রকৃত বন্ধু। খারাপ-ভালর পার্থক্য চিনিয়ে দেয়া মানুষটাই তো বন্ধু।

বন্ধু সেই, যে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও বন্ধুকে একা ফেলে বাঁচার সুযোগ নেয় না। বন্ধু সেই, যে বন্ধুকে ক্ষুধার্ত রেখে নিজে খাবার খায় না। বন্ধু সেই, যে নিজে কেঁদে বন্ধুকে হাসাতে জানে।

বন্ধুত্বের অনুভূতিটা হচ্ছে জোছনার মত। যাকে অনুভব করা যায়, দেখা যায়, কিন্তু ছোঁয়া যায় না বা বন্দি করা যায় না।

বন্ধুত্বের মাঝে বয়সের সীমাবদ্ধতা নেই। বন্ধু কোনদিন পুরনো হয় না। বন্ধুত্বের বয়স কোনদিন বাড়ে না। বন্ধু একটা সুন্দর স্বপ্ন। যার দেখা পাওয়ার জন্য সারাদিন অপেক্ষায় থাকি, আর সারারাত আক্ষেপে ডুবে থাকি। এভাবেই বছর কেটে যায় কিন্তু স্বপ্নের দেখা পাওয়া যায় না। যখন পাওয়া যায় তখন হয়তো ধরে রাখার ক্ষমতা থাকে না।

তবুও আমরা বন্ধুর জন্য অপেক্ষায় থাকি। বন্ধুর খোঁজে হাতরে বেড়াই জীবনের প্রতি অলিগলি। এই মনে হয় পেয়েছি, এই মনে হয় নেই। তবুও খুঁজি, খুঁজতেই থাকি।

"খুঁজে ফিরি সেই স্বপ্নভূক বন্ধুকে, যে স্বপ্নবিদ্ধ হতে ভালোবাসে"।

  • দেবজ্যোতি দেবু: সংস্কৃতিকর্মী।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত