এম. জামাল হোসাইন

০৭ আগস্ট, ২০১৭ ১২:১০

স্মরণ: শিক্ষক ও বন্ধু খলিলুর রহমান স্যার

ক্লাস সিক্স-সেভেনে পড়াকালীন সময়ে ক্লাস ক্যাপ্টেন ছিলাম। তখন স্যার বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পরবর্তীতে অধ্যক্ষের (ভারপ্রাপ্ত) দায়িত্বে ছিলেন। সেই সময় আমি অনেক ছোট। সিক্সে পড়া একজন ছাত্র যেরকম হয়! হেডস্যারের ভয়ে অফিসের বারান্দা পর্যন্ত যেতে পা কাঁপত। পা কাঁপত কারণ স্যারের এক ধমকে পুরো বিদ্যালয়ের পরিবেশ স্তব্ধ হয়ে যেতো। মনে হতো শুধু আমরা না, বরং স্কুলের পুরো আয়তনই স্যারের ভয়ে তটস্থ!

দায়িত্বের জন্য কঠোর ব্যক্তি হিসেবে ইতিহাসে ওমরের নাম শুনেছি। আর নিজ চোখে দেখেছি যাকে তিনি হেডস্যার! স্যারকে একটু বেশিই ভয় পেতাম আমি। এ ভয় শুধু ভয় না, এ ভয় শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালবাসার সংমিশ্রণে অন্যরকম এক ভয়। স্যার রাগলে মনে হতো আর বুঝি উপায় রইলো না। আর ক্লাসে এসে হাসলে বা হাসালে মনে হতো এ হাসি কত জনমের চেনা। এই হাসির জন্যই হয়তো পড়ি বা পড়তে আসি।

যাই হোক, ক্লাসে হৈচৈ শুরু হলে কিন্তু পুরো ঝড় ক্যাপ্টেনের উপর দিয়ে যেতো। তো ক্লাস সেভেনের ঘটনা। একদিন বিরতির পরের ঘণ্টাতে (৫ম ঘণ্টা) নির্দিষ্ট বিষয়ের শিক্ষক আসেন নি, আর এই সুযোগে ক্লাসের সহপাঠীরা গল্প আর আড্ডার শোরগোলে পুরো ক্লাস গরম করে দিয়েছিল। হঠাৎ স্যারের আগমন!

স্যার: ক্লাস ক্যাপ্টেন কে?
আমি: জি স্যার, আমি (ভয়ে ভয়ে)।
স্যার: (পিঠ জুড়ে ১ জুড়ো বেতের বাড়ি বসিয়ে) স্যার আসেন নি, আমাকে গিয়ে বলতে পারতে, আমি এসে ক্লাস নিতাম!

আমি মাথা নিচু করে নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। স্যারকে কিভাবে বুঝাব যে উনার ভয়ে উনার কাছে তো দূরে থাক অফিসের বারান্দা পর্যন্ত যেতেও ভয় পাই। সময়ের ব্যবধানে ধীরে ধীরে আমার ভয়ের মাত্রাটাও কেটে যাচ্ছিলো। কারণ স্যারকে ততদিনে বুঝতে শিখছিলাম। প্রতিদিন সকালবেলা সমাবেশ (পিটি) করানো (স্যার তখন প্রায়ই পাশে থাকতেন), বিভিন্ন ব্যাপারে ক্যাপ্টেনদের ডেকে নিয়ে দায়িত্ব বণ্টন, অফিসে নানান প্রয়োজনে যাওয়া-আসা, এমনিভাবে ধীরে ধীরে স্যারের সাথে অনেক বিষয়েই কথা হতো, অনেক কিছুই জানা হতো যা আগে কল্পনাও করতে পারতাম না। ছাত্র-শিক্ষক মানে আমার আর স্যারের মধ্যে একটা বন্ধুসূলভ সম্পর্ক তৈরি হতে থাকে। তখন অনুধাবন করতে পারি আসলেই স্যার যে চেহারা সচরাচর প্রদর্শন করে বেড়ান দায়িত্বের প্রয়োজনে, কমিটমেন্টের প্রয়োজনে তা তাঁর আসল চেহারা না। বরং ঐ কঠোর চেহারার অন্তরালে ছিল এক কোমল হৃদয়। যে হৃদয় তাঁর শিক্ষার্থীদের জন্য ভালোবাসা ও স্নেহের দুয়ার খুলে রাখতো সবসময়। অথচ অজানা এক ভয়ের খাদে এই বিশালত্ব লুকিয়ে ছিল এতদিন।

স্যার আমাকে অনেক ক্ষেত্রে অনেক উপদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু স্যারের একটি কথা আমার আমৃত্যু স্মরণে থাকবে- "বাবা তুমি ছাত্র হিসেবে অনেক ভালো। তাই মন দিয়ে পড়াশোনা করো। কারণ পড়াশোনা করলে শুধু ভালো রেজাল্টের সার্টিফিকেট মিলে না ভালো মানুষেরও সার্টিফিকেট পাওয়া যায়!"

রোববার সন্ধ্যাবেলা বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মগ্নপ্রায় ছিলাম। তখন স্যারের মৃত্যু সংবাদ আপাদমস্তক আমাকে স্তব্ধ করে দিলো। স্যারের ধমকে বিদ্যালয় যতটা স্তব্ধ হতো তার চেয়েও বেশি। হ্যাঁ, সবার মৃত্যু অবধারিত। কিন্তু স্যারের এই আকস্মিক তিরোধান মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে, ব্যাপক কষ্ট।

ভালো থাকবেন পরপারে...
হে প্রিয় বন্ধু, প্রিয় শিক্ষাগুরু!
এম. জামাল হোসাইন: প্রাক্তন ছাত্র, শাহবাজপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ

আপনার মন্তব্য

আলোচিত