আফরিন জাহান হাসি

০৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০১:৫১

ইতিবাচকতার চর্চা শুরু হোক, বন্ধ হোক হত্যা

প্রাণবন্ত, মিষ্টি একটা মেয়ে,নাম লাবণী সাহা। দেবাশীষ সাহা নামে এক পুলিশ অফিসারের সাথে মাত্র পাঁচ মাস হয়েছে বিয়ের। বর তাকে চাপ দিচ্ছিল তার পরকিয়া কে মেনে নিতে, সে একসঙ্গে দুজনের সাথেই সংসার করতে চায়। গত ১০ আগস্ট অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে মেয়েটি ট্রেনের নীচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।
    
এটা কি আত্মহত্যা! স্পষ্টতই হত্যা, আর এতে শুধু ঐ ছেলেই দায়ী নয়, আমাদের সমাজ বহুলাংশেই দায়ী, দায়ী সমাজের নেতিবাচকতার চর্চা। শুধু আইন-কানুনের উন্নতি আর প্রয়োগেই এর সমাধান হবে না। সমাজের ইতিবাচকতার চর্চাই পারবে এ ধরণের হত্যা বন্ধ করতে। নিজের জীবন ত্যাগ করার মত সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় মেয়েটির যে মানসিক অবস্থা ছিল,তাতে সুস্থতার পরশ বুলানোর মত সামাজিক সমর্থন আমাদের নেই। উল্টো নেতিবাচকতার অন্ধকার চারিদিক ঢেকে রেখেছে। আজকে যদি এই মেয়েটির জায়গায় নিজেকে চিন্তা করি, নিজের আপনজনকে চিন্তা করি-মনে হয় সমাজের ইতিবাচক আচরণই দিতে পারতো বেঁচে থাকার আশ্রয়। এই ইতিবাচকতাকে বুঝতে হলে প্রথমে নেতিবাচকতার বিশাল অন্ধকারকে চিহ্নিত করতে হবে।

যতটুকু জানি মেয়েটি তার এই দুর্বিষহ অবস্থা নিয়ে তেমনভাবে কারো সাথে আলাপ করতে পারেনি। যে মানসিক সাহায্য তার দরকার ছিল, তাতে ছিল নানা বাধা। ছেলেটির দেয়া বাধা তো ছিলই। আমাদের সমাজকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, নতুন বিবাহিত দম্পতির ক্ষেত্রে মানিয়ে নেয়া, খুশী করা এসব কিছুই সমাজ প্রত্যাশা করে নারীর কাছ থেকে। একটি মেয়ে সমাজের সেই প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হলে আপনজনও  চাপ দিতে থাকে তাকেই। “ছেলেদের এরকম থাকেই, কিংবা মেয়েরাই পারে চেষ্টা করে এর পরিবর্তন করতে।”-এসব বার্তা প্রচণ্ডভাবে ছড়িয়ে আছে আমাদের সমাজে। মেয়েটি তাই সমাজের প্রত্যাশা পূরণের সেই চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থতার জন্য নিজেকে দায়ী মনে করলো কি!  

অথচ বিবাহিত দম্পতির দুজনই মানুষ,নতুন জীবনে মানিয়ে নিতে দুজনকেই চেষ্টা করতে হবে, উদ্যোগী হতে হবে, - এই ইতিবাচক বার্তাটি কতটুকু প্রচারিত আমাদের সমাজে! ছেলে এবং মেয়ে দুজনের প্রতি কি সমভাবে আছে সমাজের এই প্রত্যাশা?

আবার আমাদের সমাজে দেখা যায়, কেউ তার কষ্টের কোন কিছু একটু শেয়ার করতে চাইছে, কোন সমবেদনা বা সাহায্য সহযোগিতার বদলে শুনতে হয়, “এ আর এমন কি!আমার উপর এর থেকে কত বেশী অত্যাচার হয়েছে...”। ব্যাপারটা এমন যে সে বেশী সহ্য করেছে তাই অন্যকেও অত্যাচার সহ্য করাই শিখতে হবে। তুলনা করে একটা প্রতিযোগিতার মধ্যে ফেলে দেয়া। যে তার দুঃখটা শেয়ার করে মানসিক শান্তি পেতে চেয়েছিল, সমাধান এর জন্য সাহায্য পেতে চেয়েছিল, তাকে উল্টো অপরাধী হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেয়া,সহ্য করতে জানে না বলে।এই নেতিবাচক দৃশ্যও ব্যাপকভাবে বিস্তৃত আমাদের সমাজে। মেয়েটিও কি তাই ভেবেছিল, মাত্র তো কদিন হলো, আর একটু দেখি!

মানুষের মনোবেদনায় সহমর্মিতা জানানো, ইতিবাচকভাবে আলোচনা করা, আলোচনা করে সমস্যার কারণ এবং সমাধান খোঁজা,কিংবা কোথায়,কোন ভাবে এর সমাধান সম্ভব সেই খবর দেয়া- ছোটবেলা থেকে এই শিক্ষা আমাদের সমাজের প্রতিটি মানুষের কাছে কোনভাবে কি পৌঁছায়?

আমাদের সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদের দায় পুরোটাই নিতে হয় নারীকে। এখানে একটা সত্যি ঘটনার উল্লেখ করবো। একজন এক নারী কে খুব বকাঝকা করছে যে, ঐ নারী প্রচণ্ড খারাপ, সে এক ভালো লোককে ডিভোর্স দিয়ে আবার বিয়ে করেছে।

ভালোভাবে জিজ্ঞেস করতেই জানা গেলো যে তিনি ঐ নারীকে কখনো দেখেননি, লোকটিকে একবার দেখেছেন। পুরোটাই লোকমুখে শোনা এবং যেহেতু সবাই নারীটিকে খারাপ বলছে তাই তিনিও বলছেন! লোকমুখেই বিচার হয়ে যাচ্ছে, ঘটনার সংশ্লিষ্টতা দরকার নেই। কী প্রচণ্ড নেতিবাচকভাবে বিবাহ বিচ্ছেদের দায় নারীর উপর পড়ে আছে আমাদের সমাজে। একটি সাধারণ তরুণী যে সবে মাত্র বিবাহিত জীবন শুরু করতে যাচ্ছে, যে এ ধরণের সামাজিক আচরণ দেখে অভ্যস্ত, তা তার উপর কি প্রভাব ফেলবে! আর যদি ধর্মীয় নিয়মে তার ডিভোর্স দেয়ার অধিকারই না থাকে! একটি সংসার টিকিয়ে রাখার পুরো চাপ শুধু মাত্র নারীটির উপর।

দুজন নর-নারীর পারষ্পরিক বন্ধন হচ্ছে বিয়ে। বিবাহিত যুগল জীবন টিকিয়ে রাখা, সার্থক করে তোলার দায়-দায়িত্ব নর-নারীর প্রত্যেকেরই। কোন কারণে তাদের যদি একসাথে থাকা সম্ভব না হয় সেই দায়-দায়িত্ব ও বেশিরভাগ সময়ই তাদের দুজনের। এসব ইতিবাচক বক্তব্যগুলো কতটুকু প্রচারিত-প্রসারিত আমাদের সমাজে?  

আবার কোন নারী যদি শিক্ষিত, স্বাবলম্বী হয়। নিজের জীবনের দায়িত্ব নিজে নিতে চায়, তাকেও শুনতে হয়, “দুকলম লেখাপড়া করে বেশী বাড় বেড়েছে,” কিংবা “ মেয়েরা চাকুরী করলে মাথায় উঠে যায়, এজন্যই মেয়েদের চাকুরী করতে দিতে হয়না।” এসব নেতিবাচক বার্তার অন্ধকারে নিমজ্জিত আমাদের সমাজ। এ কালিমা এতই বিস্তৃত যে কেউ কেউ এটাই সঠিক, এমনই বিশ্বাস করে।

শিক্ষা প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার। স্বাবলম্বী হওয়া সম্মানের বিষয়, যোগ্যতার বিষয়, প্রয়োজনীয় বিষয়- এসব ইতিবাচক কথা সমাজে কতটুকু শোনা যায়?

অন্যকে তীব্রভাবে সমালোচনা করা, নিন্দা করা, গালিগালাজ করা, নিয়মিত ভর্ৎসনা করা এক ধরণের অপরাধ। এই উৎপীড়নকে ইংরেজিতে এক কথায় বুলিং বলা হয়। উন্নত বিশ্বে এর চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। শ্বশুরবাড়িতে, এই সমস্ত আচরণ এর সামনে মেয়েদেরকে প্রায়ই পড়তে হয়। এসব আচরণ মনোবল নষ্ট করে দেয়,অনেকে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। আমাদের সমাজে এগুলো খুব স্বাভাবিক বলে বিবেচিত হয়। এর প্রতিকার এর কোন ব্যবস্থা কোনভাবে নেয়া হয় না।

এ সব ক্ষেত্রে আদর-স্নেহ-ভালোবাসা এবং প্রশংসা মনোবল ফিরিয়ে আনতে পারে। এ ধরণের আচরণ যে কত খারাপ তা নিয়ে সচেতনতা হয়তো অনেক মানুষকে পরিবর্তন করতে পারে।

উপরের আলোচিত সব কিছু বিবেচনায় আনলে দেখা যায় ইতিবাচক আচরণগুলোর চর্চা যদি বাড়ানো যায় তবে দুর্বিষহ অবস্থায়ও মানুষ আশার আলো দেখতে পাবে। যে আশা মানুষকে বেঁচে থাকার প্রেরণা দিবে। বর্তমানে নেতিবাচক বার্তাগুলোর যে চাপ তা থেকে মুক্তি পাবে।

আমাদের দেশে “কান পেতে রই” নামে একটি সংস্থা কাজ করছে যারা মূলত আত্মহত্যা প্রতিরোধে কাজ করছে। যে কোন মানসিক বিপর্যয়ে তারা কাউন্সিলিং করে থাকে, যিনি সাহায্য চান তার তথ্য এবং পরিচয় গোপন রাখা হয়। এছাড়া এখন অনেক মনোবিজ্ঞানীও কাউন্সিলিং সার্ভিস দিয়ে থাকেন। মানসিক বিপর্যয়ে এ ধরণের শিক্ষিত এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকের সাথে আলোচনা একটা ইতিবাচক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এ তথ্যটাও আমাদের সমাজে প্রচার করা জরুরী। সর্বোপরি সাধারণ মানুষের মধ্যে যদি এই ইতিবাচক আচরণগুলোর চর্চা বাড়ানো যায়, প্রতিষ্ঠিত করা যায় তবে সমাজের পরিবেশটাই ভিন্ন হয়ে উঠবে। মানুষ বিপদে সাহস পাবে,ভরসা পাবে। নিজের বিপদের কথা আলোচনা করতে দ্বিধাগ্রস্ত হবে না।

একজন একজন করেও যদি আমরা ইতিবাচকতার চর্চা শুরু করি, পাশের জনকে প্রভাবিত করি, হয়তো একদিন কোন এক মেয়ে ঘুরে দাঁড়াবে বেঁচে থাকার আশায় এই সমাজে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত