সৌরভ দাস

১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ১৩:৩৩

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদ্দেশে কিছু কথা

একটি সত্য ঘটনা দিয়েই শুরু করছি। ঘটনাটা আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের। বাংলাদেশের কৃষি শিক্ষার শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। গত বছরের ঘটনা। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে অদ্ভুত একটা নিয়ম আছে। স্নাতক প্রথম বর্ষে যারা এখানে ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারে না তাদের কাছ থেকেও কোটি কোটি টাকা আদায় করে বাণিজ্য করা হয়। প্রত্যেক বছর এখানে নির্ধারিত একটা পয়েন্টের ভেতর আবেদন করতে বলা হয়। তারপর আবেদনকারীদের থেকে নির্ধারিত আসনের দশগুলো বাদে বাকী সব আবেদনকারীকে পরীক্ষা হলেই বসার সুযোগ দেয়া হয় না। অথচ তাদের সবার কাছ থেকে টাকা নেয়া হয়। ঠিক যে টাকাটি ভর্তি পরীক্ষার জন্য যোগ্য প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীই দেয় সে পরিমাণ। অর্থাৎ বর্তমানে যেটি ৭০০ টাকা আছে। পরীক্ষা দিতে না পারা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে এভাবে আদায় করা টাকার পরিমাণও অনেক। প্রত্যেক বছর এভাবে কয়েক কোটি টাকা এখানকার প্রশাসনের পকেটস্থ হয়। আর পরীক্ষার জন্য যোগ্য ১২০০০ এর কাছ থেকে আয় তো আছেই। এই কাজটি বিগত বেশ কয়েক বছর যাবত চলে আসছিলো।

১২০০০ বাদে যারা পরীক্ষা দিতে পারে নি সেই সকল শিক্ষার্থীর প্রত্যেকেই নিশ্চয়ই নিন্দা জানিয়েছে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে। কিন্তু তাদের নিন্দা কারো কানে পৌঁছত না। এটাই ছিলো সমস্যা। এই অনৈতিক নিয়মের বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের একটি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে গত বছর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুমুল সমালোচনা হয়। ক্যাম্পাসে বেশ মিছিল হয়। অবস্থান ধর্মঘটের মত কর্মসূচিও পালন করা হয়। এক পর্যায়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও বড় একটা অংশ আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে থাকে। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিদের আন্দোলনে না যাওয়ার ব্যাপারে অনুরোধ করেন এবং কথা দেন আগামী বছর থেকে এ নিয়ম আর থাকবে না। কেবল পরীক্ষার যোগ্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই নির্ধারিত ৭০০ টাকা নেয়া হবে। কিন্তু বছর ঘুরতেই ভাইস চ্যান্সেলরের সেই কথা দেয়া কোথায় যেন উবে গেল। সেদিন সার্কুলারে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন দেখলাম না। হুবহু আগের নিয়মই অক্ষত রয়েছে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের এরকম আচরণকে কি বলা যায়? উনার বিষয়টি নিয়ে একটু ভাবা উচিত ছিলো যে, আমি আমার ছাত্রদের কথা দিয়েছিলাম! কিন্তু ভাইস চ্যান্সেলর মহোদয় সেটি ভাবলেন না। নিজেকে জেতালেন। তবে জেতানোর থেকে হারলেন অনেক বেশি। এ হার পুরো দেশের ছাত্র সমাজের কাছে।

সবচেয়ে অবাক হয়ে যাওয়ার মত বিষয় হলো ভর্তি প্রক্রিয়ায় আয়কৃত এই কোটি কোটি টাকার একটি পয়সাও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ফান্ডে জমা হয় না। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন না, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও না। এর বড় একটি অংশ বিভিন্ন মহলের পকেটস্থ হয়। তারা জনগণের ঘামে টপটপ করা শ্রমের টাকায় বিলাসিতার পাহাড় গড়ে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর আন্দোলনে নামতে ইচ্ছুক সাধারণ শিক্ষার্থীদের চোখে চোখ রেখে কথা বলার সৎ সাহসটিও হারালেন। ঘটনাটা এখানেই শেষ।

তবে প্রশ্ন হচ্ছে এটা কি কেবলই বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে? না। বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়েই এটি কম বেশি হয়। ভিসিরা এখন আর কথা দিয়ে কথা রাখেন না। কারণ সাধারণ শিক্ষার্থীদের থেকে যোজন যোজন দূরে তাদের বাস। তারা কথা রাখার নামে ছলনা করেন, পলিটিক্স করেন। তাদের কাছে ছাত্রদের থেকেও ক্ষমতাসীন প্রভাবশালী শিক্ষক, লুটপাটকারী মহল, ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

প্রত্যেক বছরই স্নাতক প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষার সময় আসলে আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনগুলো কেমন যেন কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে যায়। ভর্তি ফরমের মূল্য নিয়ে তারা বিশাল পরিমাণ বাণিজ্যেও নীল নকশা আঁকে। এই বাণিজ্য দিনকে দিন বেড়েই চলছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো এখানে বাণিজ্যের সমান্তরালে চলে লুটপাট। এই লুটপাটে শেয়ার থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো প্রশাসন, ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন, ভর্তি কমিটি, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঘা বাঘা ক্ষমতাসীন শিক্ষক। এই অযথা বাড়তি বাড়তি ফি নেয়ার বিরুদ্ধে প্রায়শই এখানে সেখানে আন্দোলন হতে দেখা যায়। কিন্তু এই অশুভ চক্রের হাতে গিয়ে সব আন্দোলন মার খায়। তারা নিষ্ঠুরভাবে এসব আন্দোলন দমন করে। তারা ফি কমানো তো দূরের কথা প্রতি বছর নানান অযৌক্তিক অজুহাতে এ ফি বাড়িয়েই চলছে। এটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য এক অশনি সংকেত।

প্রশ্ন হচ্ছে একটি ভর্তি পরীক্ষা নিতে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের কত খরচ হতে পারে? এখন তো সব ইন্টারনেটের মাধ্যমেই হয়। নতুবা মোবাইলে। এখানে স্টুডেন্ট প্রতি পাঁচ টাকাও খরচ হওয়ার কথা না। আর বাকি যে খরচ থাকে তা হলো পরীক্ষার প্রশ্ন ছাপানো, পরীক্ষা আয়োজন, দায়িত্বরত শিক্ষকদের সম্মানী, ফলাফল প্রকাশের অল্প কিছু খরচ এই তা। যদি একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০-৪০ হাজার স্টুডেন্ট পরীক্ষা দেয় তাহলে কত লাগতে পারে খরচ? হিসেব করে দেখুন ৫০ টাকা থেকে ১০০ টাকার মধ্যে এ হিসেব চুকে যায়। খুব ভালোভাবেই চুকে যায়। কিন্তু এই ছোট্ট কাজের জন্য পাঁচশো, সাতশো, এক হাজার, দু হাজার এত টাকা নেয়ার মানে কি? এটি ভর্তি ইচ্ছুকদের সাথে স্রেফ প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। এটি এক কথায় তাদের দুর্বলতার সুযোগ নেয়া!
প্রশাসনের হর্তাকর্তারা ভালো করেই জানেন কষ্ট করে হলেও এসময় অনেক গরিব পরিবারের সন্তানটিও ফরম তুলে। ঋণ করে হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পরীক্ষা দিয়ে যায়। তাই তাদের পকেটে ভাগ বসানোর এটাই উত্তম সময়।

পরিশেষে, বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনের এরকম বেপরোয়া দৌরাত্ম্য রুখে দেয়া এখন সময়ের দাবি। এটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ভবিষ্যতকে খুব খারাপ দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তারা যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে শুধু ভর্তি ফরম নয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিস্টার ফি, ভর্তি ফি বাড়াচ্ছে তা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানও অনেক কমিয়ে দিচ্ছে। সাধারণ পরিবারের ছেলেমেয়েরা এখানে পড়তে হিমশিম খেয়ে যায়। অনেকের টিউশনি করতে করতে ঘাম ছুটে যায়। দিনকে দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনার খরচ খেটে খাওয়া মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে এদেশের বারোটা বাজাতে আর কিছু লাগবে না। যে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ঠিক থাকে না সে দেশ কখনো শক্ত মেরুদণ্ড নিয়ে দাঁড়াতে পারে না। এই সত্যটা না বুঝলে আমাদের কপালে অনেক দুঃখ আছে।

  • সৌরভ দাস: সভাপতি, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, বাকৃবি শাখা।
  • এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত