আব্দুল করিম কিম

১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ২১:৫৫

প্রকৃতি ও পরিবেশের বিপন্নতাই এখন সিলেটের প্রধান সমস্যা

আমার সিলেট রুপের বাহার/ আছে হাওড়, আছে পাহাড়।/আছে নদী নীল জল, /পাখ-পাখালির কোলাহল ।/আছে অরণ্য সবুজ শোভা/ জলারবন আছে মনোলোভা ।/ঝর্ণা নামে পাহাড় থেকে/ নয়ন জুড়ায় সিলেট দেখে।

রুপের বাহার সিলেটকে নিয়ে সিলেটিদের গর্বের শেষ নেই। গর্ব করার নানান উপাদান রয়েছে সিলেটের। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে বৈচিত্র্যময় সিলেটের প্রকৃতি ও পরিবেশ। এখানকার ভূপ্রকৃতি ও জলবায়ু বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে স্বতন্ত্র।

বরাকের দুই শাখা সুরমা-কুশিয়ারাকে কেন্দ্র করে এখানে শত নদী বহমান। শত শত বিল ও জলাশয়ের পাশাপাশি সমুদ্রসম বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি এবং দ্বিতীয় রামসার সাইট টাঙ্গুয়ার হাওড় সিলেটের গৌরব। মায়াবী সবুজ পাহাড় ও দিগন্ত বিস্তৃত চা-বাগান নিয়ে শত-সহস্র ছোট-বড় টিলা সিলেটের পরিচয়। ক্রান্তীয় আর্দ্র চিরহরিৎ ও ক্রান্তীয় প্রায়-চিরহরিৎ একাধিক বনাঞ্চল ও বাংলাদেশের একমাত্র মিঠাপানির জলারবন রাতারগুল সিলেট বিভাগের অহংকার। পাথরের রাজ্য জাফলং, বিছনাকান্দি, ভোলাগঞ্জ সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের আকর্ষন। প্রকৃতির অশেষ দান সিলেট বিভাগকে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে স্বতন্ত্র করেছে। এখানকার নদী, হাওড় ও পাহাড়ের প্রভাবে এখানে জন্ম হয়েছে শতাধিক মরমী সাধকের। সিলেটের প্রকৃতি সিলেটের মানুষকে বিশেষ নৃতাত্ত্বিক জীবনধারা দিয়েছে। সিলেটের প্রকৃতি ও পরিবেশ সিলেটের মানুষকে বিশেষ আত্মপরিচয় দিয়েছে।

সিলেট বিভাগে শিক্ষা বা কর্মহীনতা নয়, বর্তমান সময়ের প্রধান সমস্যা প্রকৃতি ও পরিবেশের বিপন্নতা। কিন্তু এখনো তা অনেকের বোধগম্যতার বাইরে। বিশেষ করে প্রবাসীদের সিলেটের পরিবেশগত সমস্যা সম্পর্কে যথেস্ট ধারনা নেই। তাই উদ্বেগও নেই । যে কারনে বিলাসবহুল বাড়ি ও মসজিদ মাদ্রাসা তৈরিতে প্রবাসীদের আগ্রহ দেখা গেলেও সিলেটের নদ-নদী রক্ষায়, পাহাড়-টিলা রক্ষায়, বনাঞ্চল রক্ষায় এখনো তেমন আগ্রহ দেখা যায়নি।

সাম্প্রতিককালে সিলেট বিভাগে প্রবাসীদের কল্যানে একাধিক স্কুল-কলেজ ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের টানে দেশ-বিদেশ থেকে ছুটে আসা পর্যটকদের উদ্দেশ্য করে প্রবাসী বিনিয়োগে হোটেল-মোটেল ও রিসোর্ট গড়ে উঠেছে । এ সবকিছুই উন্নয়নের মাপকাঠিতে প্রশংসাযোগ্য। তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে প্রবাসীরা দেশের স্বজন-পরিজন থেকে এখন আর বিচ্ছিন্ন নন। প্রতিদিন আপনজনের সাথে কথা হয়। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে চেহারাও দেখা হয়। এরপরেও প্রবাসীরা এক দুই বছর অন্তর দেশে ছুটে আসেন। এই ছুটে আসার উদ্দেশ্য কেবল পরিবার-পরিজন ও চেনা মানুষের সাথে দেখা করা নয়, এই ছুটে আসার পেছনে ফেলে আসা নদীর টান থাকে। হাওরের জীয়ল মাছ খাওয়ার ইচ্ছে থাকে। জোনাক জ্বলা সন্ধ্যা দেখার বাসনা থাকে। শীতের রাতে শেয়ালের ডাক ও বসন্ত বাতাসে কোকিলের কুহুকুহু শোনার আকাংখা থাকে। কিন্তু দেশে এসে দেখা যায় ফেলে আসা নদী মরে গেছে। হাওরে মাছের আকাল। সন্ধায় আর জোনাক জ্বলে না। শেয়ালের বসতি নেই, তাই শেয়াল আর ডাকে না। এ বিষয়গুলো প্রবাসীদের ব্যাথিত করে। কিন্তু দেশের রাজনীতি নিয়ে প্রবাসীদের মধ্যে যে পরিমান উৎসাহ ও আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়- এর ছিটেফোঁটা আগ্রহ পরিবেশগত বিপর্যয়রোধে দেখা যায় না। দেশের বিভিন্ন নির্বাচনে প্রবাসী কমিউনিটি নেতারা অংশগ্রহণ করেন কিন্তু দেশের পরিবেশ বিপন্নতা নিয়ে তাঁদের উদ্বেগ বা পরিকল্পনার কথা শোনা যায় না।

সিলেটের প্রাকৃতিক পরিবেশের বিপন্নতা নিয়ে প্রবাসীদের নির্লিপ্ততা রয়েছে তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। প্রবাসীদের এই নির্লিপ্ততার কারণ হতে পারে, এ সম্পর্কে যথাযথ ধারনার অভাব অথবা তাঁদের কাছে এটাই স্বাভাবিক যে, বাংলাদেশে নদী দখল হবে, পাহাড় কাটা পড়বে, জলাশয় ভরাট হবে, যত্রতত্র আবর্জনা ফেলা হবে, উচ্চশব্দে মাইক ও গাড়ির হর্ন বাজবে, গাড়ি ও কারখানার কালোধোঁয়া বাতাসে ভাসবে, বনাঞ্চল সাফ হয়ে নগরায়ন হবে। এভাবে নদী দখল ও দূষণ হতে হতে সব নদী শেষ হয়ে গেলে, পাহাড় কাটা চলতে চলতে সব পাহাড় শেষ হয়ে গেলে, বন বিনাশ হতে হতে সব বন ফুঁড়িয়ে গেলে, হাওড় ভরাট হতে হতে সব হাওড় ভরে গেলে কেমন হবে? ভয়াবহ দূর্যোগ হবে। সিলেট আর সিলেট থাকবে না । রুপের বাহার সিলেটের রুপ বদলে কদাকার হয়ে যাবে। আর কদাকার করার প্রচেষ্টাই চলছে।

উন্নত বিশ্বের অবিবেচক আচরণের কারণে গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়ায় জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নদী আগ্রাসনের পাশাপাশি সিলেটের প্রকৃতি ও পরিবেশের বিপন্নতার জন্য সর্বসাধারনের অচেতনতন্ত্র, প্রভাবশালীদের লুটপাটতন্ত্রে আর রাষ্ট্রের আমলাতন্ত্রকে দায়ী করা যায় কিন্তু নিশ্চুপ বসে থাকা যায় না। প্রায় দুই কোটি মানুষের সিলেট বিভাগে ভূমির সংকট আছে। কিন্তু সেই সংকট সমাধানে প্রাকৃতিক পরিবেশকে গুরুত্ব না দিয়ে গত তিন দশকে নদী-বিল-হাওড় ভরাট ও দখল করে কৃষিকাজ, বনভূমি উজাড় করে বসতি নির্মান, পাহাড়-টিলা কেটে নগরায়ন, কৃষিজমিতে শিল্পাঞ্চল প্রতিষ্ঠা যেভাবে চলছে তা সিলেটের প্রাকৃতিক রুপ-বৈচিত্র্যকে ক্রমান্বয়ে নিঃশেষ।

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মত সিলেট বিভাগের জলবায়ু, ভূ-প্রকৃতি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য বিপর্যস্ত হচ্ছে । পরিত্রাণের উপায় ও কর্মপদ্ধতি নির্ধারন করে সিলেটের বিপন্ন প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় সিলেটের সচেতন নাগরিক'সহ প্রবাসী সিলেটীদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন । বন্যা হলে প্রবাসীরা ত্রান নিয়ে ছুটে আসেন একইভাবে বন্যা থেকে মুক্ত হওয়ার পরিকল্পনা প্রণয়নে প্রবাসী গবেষকদের গবেষনা প্রয়োজন। নদী ভাঙ্গনের শিকার মানুষকে সাহায্য দিতে প্রবাসীরা এগিয়ে আসেন একইভাবে নদী দূষন-দখল ও অপরিকল্পিতভাবে নদী থেকে বালু উত্তোলনের প্রতিবাদেও প্রবাসীদের সমর্থন প্রয়োজন। পাহাড় কাটা, জলাভূমি ভরাট, কৃষিজমি বিনষ্ট, শিল্প দূষণ, বনাঞ্চল ধ্বংসের বিরুদ্ধে ও বন্যপ্রাণী সুরক্ষায় পরিবেশবাদীদের চলমান কার্যক্রমে প্রবাসীদের সর্বাত্মক অংশগ্রহণ প্রয়োজন।
 
সিলেটের পরিবেশগত বিপর্যয় প্রতিরোধে প্রবাসীদের সম্মিলিত উদ্বেগ ও সহযোগিতা জরুরী । আশার কথা, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষনা কেন্দ্রে থাকা প্রবাসী বুদ্ধিজীবিরা বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করছেন। তাঁদের বিভিন্ন উদ্যোগ জাতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশের পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে। অনুরুপ অনুপ্রেরণা সিলেটের জন্যও প্রয়োজন। সিলেট বিভাগের প্রতিষ্ঠিত প্রবাসী ব্যাক্তিত্ব ও কমিউনিটি নেতাদের সিলেট বিভাগের সার্বিক পরিবেশ-প্রতিবেশগত বিপর্যয় প্রতিরোধে সম্পৃক্ততা দরকার।

সিলেটের প্রকৃতি ও পরিবেশ কিভাবে বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে সে সম্পর্কে এবার কিছু ধারনা দেয়া যাক। ব্যক্তি ও গুষ্টি পর্যায়ে পরিবেশ বিনষ্টি তৎপরতা ও অসেচতনতা উদ্বেগজনক। পরিবেশ ও প্রতিবেশের সমস্যা সম্পর্কে এক সময় মানুষের কোনো সচেতনতাই ছিল না। এখন সচেতনতা বেড়েছে কিন্তু করণীয় নির্ধারণে আমরা পিছিয়ে আছি। শিক্ষিত ও শহুরে মানুষ যেখানে পরিবেশ বিনষ্টি কাজ অবলীলায় করে সেখানে অশিক্ষিত সাধারণ মানুষের কাছে বেশি কিছু প্রত্যাশা করা যায় না।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সিলেট মহানগরীর প্রতিটি খাল বা ছড়ায় স্থানীয় বাসা-বাড়ি-ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান থেকে আবর্জনার স্তূপ ফেলা হয়। পচা-বাসী গৃহস্থালি আবর্জনা থেকে শুরু করে পলিথিন, প্লাস্টিক বোতল, রাবার, কাচ-এর মতো অপচনশীল দ্রব্য ফেলা স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তাই সিলেট মহানগরীতে প্রবেশ করেই সুরমা নদীর পানি দূষিত হয়। সুরমা নদী সিলেটের প্রাণ। সিলেট নগরী সুরমা নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠেছে। সিলেটবাসীর ঠিকানা সুরমা। তাই 'সুরমা নদীর তীরে আমার ঠিকানারে...'  অবলীলায় গাওয়া হয় কিন্তু সেই সুরমা নদীকে দূষিত করা হয়। কুশিয়ারা, খোয়াই, মনূ সহ অন্যান্য নদীও বর্জ্য দূষণের শিকার। ঢাকাদক্ষিণ বাজারে কাকেশ্বর নদী ইতিমধ্যে ড্রেনে পরিনত হয়েছে। ভূমির দূর্মূল্যে লূলা নদী তাঁর ভূমি হারিয়ে খালে পরিনত হওয়ায় জলাবদ্ধতা বিয়ানীবাজারের অন্যতম নাগরিক সমস্যা।
 
বাংলাদেশের একমাত্র মিঠাপানির বিপন্ন একরত্তি জলারবন রাতারগুল বা লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে অনিয়ন্ত্রিত দর্শনার্থী ও পর্যটকদের অচেতনতন্ত্র এসব সংবেদনশীল স্থানকে প্রতিনিয়ত বিপন্ন করছে। উচ্চ শব্দে বনভ্রমন ও যত্রতত্র আবর্জনা ফেলা স্বাভাবিক আচরণে পরিনত হয়েছে । উন্মুক্ত আবর্জনা ফেলার কারণে কি কি ক্ষতি হচ্ছে, জানতে চাইলে দেখা যাবে সবাই ক্ষতির বিষয়টা ভালো ভাবেই জানে । অর্থাৎ সবার সচেতনতা ঠিকই আছে, কিন্তু ব্যক্তি পর্যায়ে পরিবেশ বিষয়ে আমাদের উদাসীনতা লজ্জাজনক। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ব্যক্তিগত ও সামাজিক উদ্যোগ অপরিহার্য। এ অবস্থার পরিবর্তনে প্রবাসীদের অভিজ্ঞতা ও অনুপ্রেরনা কাজে লাগানোর সুযোগ আছে । কিন্তু প্রবাসে বর্জ্য ব্যাবস্থাপনায় যিনি অত্যন্ত দায়িত্বশীল, দেশে এসে তিনি নিজেই অব্যাবস্থাপনায় অভ্যস্থ হয়ে পড়েন।

সমাজের প্রভাবশালী গোষ্টির লুটপাটতন্ত্রের কারনে নদী দখল, জলাশয় ভড়াট, পাহাড় কাটা, বন ধ্বংস, শব্দ দূষণ, বায়ু দূষণ, বন্যপ্রানী শিকার ও চোরাচালান হচ্ছে । স্থানীয় প্রভাবশালীরা পরিবেশ বিধ্বংসী অপকীর্তি করে রাজনৈতিক শক্তির প্রচ্ছন্ন সমর্থন নিয়ে। যে কারনে সর্বচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্বেয় সিলেটের প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংস করে ভূগর্বস্থ পাথর উত্তোলনে বোমা মেশিন নামের স্থানীয় প্রযুক্তির ব্যাবহার বন্ধ করা যায় না। প্রভাবশালী পাথরখেকো চক্রের লুতপাটতন্ত্রে সিলেটে বিভাগের পিয়াইন, সারি, ধলাই, লোভা, যাদুকাটা, চলতি, রাংপানি ইত্যাদি নদী ও নদী তীরবর্তি এলাকা গত দেড় দশকে বিপর্যস্থ হয়েছে। অপরিকল্পিত পাথর উত্তোলনের প্রভাবে ডাউকি নদী হারিয়ে গেছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারনে সমাদৃত জাফোলং, শ্রীপুর, বিছনাকান্দি, ভোলাগঞ্জ, উৎমাছড়া, লোভাছড়া প্রতিনিয়ত রুপ হারিয়ে কদাকার হয়ে যাচ্ছে। যা আর বলার অবকাশ রাখে না।

আমলাতন্ত্রের নানা ফাঁকফোঁকরের কারনে প্রকৃতি ও পরিবেশ বিধ্বংসী অপকর্ম নিয়ন্ত্রন করা যায় না । সুরমা নদীকে দখল করে নির্মান করা আলোচিত বিলাসী শৌচাগার পরিবেশ বিনষ্টি তৎপরতার জ্বলন্ত উদাহরণ । জেলা প্রশাসন ও নগর ভবনের ৫০০ মিটার এলাকার মধ্যে সুরমা দখল করে এমন একটি অবৈধ্য স্থাপনা বিনা বাঁধায় নির্মান করার অপতৎপরতাই নদীর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে । বিশ্বনাথ উপজেলার ঐতিহ্যবাহী বাসিয়া নদী দখল করে নির্মান করা অবৈধ স্থাপনা এখনো উচ্ছেদ করা হয়নি ।

পরিবেশ বিপন্নতায় সুশাসনের স্বল্পতা ও আইন প্রয়োগের শিথিলতাকে দায়ি করা যায়। পরিবেশ রক্ষায় সরকারের সর্বোচ্চ মহল আন্তরিক হলেও ব্যক্তি বিশেষের অসহযোগিতা ও আমলাতন্ত্রের কারনে পরিবেশ সুরক্ষার অনেক উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে যায়। দেশে পরিবেশ আইনের কোনো ঘাটতি নেই। ৬৪টি পরিবেশ বিষয়ক আইন রয়েছে কিন্তু এসব আইনের কোনো বাস্তবায়ন নেই। পরিবেশ বিষয়ক আইন ও বিধি টাকা দিয়ে ও প্রভাব বিস্তার করে সহজেই লঙ্ঘন করা যায়। সুশাসনের অভাবে দূর্নীতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। ফলে জলবায়ু তহবিল লুটপাট হয়, হাওড়ে ফসল রক্ষার বাঁধ নির্মানে পুকুরচুরি হয়, বনের জায়গা প্রভাবশালীরা দখল করে নেয়। বন সংরক্ষনের নামে লাউয়াছড়া, রেমা-কালেঙ্গা বা সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের বৃক্ষ নির্বিচারে উজাড় হয়, আইনের তোয়াক্কা না করে বনের পাশেই করাতকল, ইট ভাটা গড়ে ওঠে। বন সংকোচনের কারনে বিপন্ন প্রজাতীর প্রানী প্রায়ই লোকালয়ে এসে প্রাণ হারায়। দেশী ও পরিজায়ী পাখি শিকার নিষিদ্ধ হওয়া সত্বেয় প্রকাশ্যে বেচা-বিক্রি হয়। নদীতে ইচ্ছে খুশি বাঁশের বাঁধ দিয়ে মাছ ধরা এখন অপরাধের পর্যায়ে পরে না। সিলেট বিভাগের অধিকাংশ নদীতে বর্ষা শেষ পানি কমে যাওয়ার সময় বাঁশের বাঁধ দিয়ে প্রভাবশালীরা মাছের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে। শুষ্ক মৌসুমে নদীতে বাঁধ দিয়ে পানি সেঁচে মাছ ধরার ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়েছে। এতে মাছ সহ জলজ প্রাণ বৈচিত্র্য বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে । সিলেট বিভাগের অধিকাংশ নদী থেকে ইচ্ছে খুশি বালি উত্তোলন স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে । বালু ব্যবসায়ীদের কাছে নদী মুনাফার আঁধার । অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের খেসারত দিতে কৃষিজমি নদীতে ধ্বসে পরে ।

আইন প্রয়োগের শিথিলতার সুযোগে শিল্প-কারখানায় বর্জ্য ব্যাবস্থাপনা নিশিচত করা যাচ্ছে না । হবিগঞ্জের মাধবপুর ও চুনারুঘাটে বর্জ্য ব্যাবস্থাপনা নিশিচত না করেই শিল্প উৎপাদন শুরু হয়েছে । ফলে সুতাং, খোয়াই, বলভদ্র নদী দূষণের শিকার । সোনাই নদীর অভ্যন্তরে নির্মিত সায়হাম ফিউচার পার্ক নদীরক্ষায় প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের উদাসীনতার নির্মম সাক্ষী।

সিলেটের পরিবেশ বিপর্যয়ে আন্তঃসীমান্ত নদীরও ভূমিকা রয়েছ। সিলেট বিভাগের অনেক নদীই আন্তঃ সীমান্ত নদী । যা প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরা রাজ্য থেকে সিলেট বিভাগে প্রবেশ করেছে। আন্তঃ-সীমান্ত এ নদীগুলো হচ্ছে সুরমা, কুশিয়ারা, ধলা, পিয়াইন, সারী-গোয়াইন, লোভা, সোনাইবরদল, মনু, ধলাই, জুরি, লংলা, গোপলা, যাদুকাঁটা, জালিয়াখালী, ধামালিয়া, খাসিয়ামারা, উমিয়াম, সোমেশরী, খোয়াই, সুতাং ও সোনাই। এই নদী গুলোর অনেক শাখা নদী ও উপনদী রয়েছে সিলেট বিভাগের চার জেলায়। আন্তঃ-সীমান্ত নদীগুলোর অবস্থা ভালো নয়। নদীগুলোকে ভারত শাসন ও শোষণ করে চলেছে । সুরমার উজানে বরাক নদীতে ভারতের টিপাইমুখ ড্যাম এ অঞ্চলের জন্য মারাত্মক হুমকি। যা ভারতের করিমগঞ্জ সহ বৃহত্তর সিলেটের প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য দূর্ভাবনার। খোয়াই, মনু, সারী, পিয়াইন, ধলাই, যাদুকাটা ইত্যাদি প্রায় প্রতিটি নদীর উজানে বাঁধ বা ব্যারেজ নির্মান করেছে ভারত । সিলেট বিভাগের নদ-নদী নিয়ে বছর জুড়ে সংবাদ মাধ্যমে নিয়মিত ভাবে যে সব প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, তার মূল বক্তব্য 'নদী মরে যাচ্ছে'।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), সিলেট শাখার পক্ষ থেকে ব্যাক্তিগত আগ্রহে গত ১০ বছর ধরে সংবাদ-পত্রে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদের সুত্র ধরে বাংলাদেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলের এই সিলেট বিভাগে প্রায় শত নদীর অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছি। নদ, নদী, শাখা নদী, উপ-নদী যে নামেই ডাকি না কেন- প্রতিটি নদীর প্রবাহমান এলাকায় যে নাম রয়েছে সেই নামের উৎস ধরে খুঁজলেই সেই নদীর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানা যাবে। সিলেটের প্রধান দুই নদী সুরমা ও কুশিয়ারাসহ এই বিভাগের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোর মধ্যে ১১৪টি নদীর পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। পিয়াইন, ধলাই, লোভা, রাংপানি, খোয়াই, করাঙ্গি, চলতি, লাঘাটা, সারী, ক্ষ্যাপা, কালনী, রত্না, সুতাং, মহাসিং, রক্তি, মনু, অন্ধমনু , লোলা, কুড়া, বিলাস, পিংলি, দেওছই, ধনু, বড়দাল, কংস, ডাউকা, চামটি, সুনাই, কন্টিনালা, মাকুন্দা, দৌলতা, খাজাঞ্চি, ফানাই, ধোনা, বলভদ্র, খাসিয়ামারা, গন্ডামারা, ইছামতি, ডেবনা, বিজনা, কচুয়াখাড়া, মুনিয়া, সাতাই, ধামালিয়া, জামালপুর, কালিয়া, পাটলী, বোয়ালিয়া, মাধবপুর, বিবিয়ানা, ধরিয়ানা, দিঘড়- পিয়াইন, বাসিয়া, কলকলিয়া, কচুয়া, গোয়াইন, শস্যনালী, জুঘনাল, দাড়াইন, কানাই, জুড়ী, নলজুর, পাইকরতলা, ধোয়াই, নুনছড়া, গুগালীছড়া, কাফনা, কাকেশ্বর, উন্দাখালি, ঠেংগাখালী, উদনা, ভাদেশ্বর, কামারখালি, কানাইখালী, পৈন্দা, মনিখাই, নয়াগাঙ, বড়গাঙ, ছড়াগাঙ, কাউনাই, সুমেশ্বরী, ঝিংড়ী, কুইগাং, মনাই, সোনাই, বড়ভাগা, যাদুকাটা, চুনাই, দেওড়ভাগা, পেকুয়া, শুটকী, বৌলাই, বোগাপানি, ভীমখালী, সুনই, ধলাই, গোমাইগাঙ, জালিয়াছড়া, বাগরাগাং, বটেরগাঙ, বেমুনা, গোপলা, লংলা, দেড়ু,আমিরদী্‌ন, ভেড়ামোহনা, ষাটমা, লঙ্গু, ধামাই, বাগহাতা, বারনা নামের এই নদীগুলোর প্রাণ প্রবাহের মধ্যেই সিলেটের ভবিষ্যৎ। আর এই ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়েছে মূলত নদীগুলোর তলদেশ ভরে যাওয়ার কারণে।

ভরাট হয়ে যাওয়ার পেছনে দুইটি কারণ গুরুত্বপূর্ণ । প্রথম কারণ হচ্ছে- এ অঞ্চলের পাহাড়-টিলা কেটে সমতল করার প্রবনতা। গত দুই দশকে সিলেট জেলার প্রায় ৫০% টিলা-পাহাড় কেটে ফেলা হয়েছে। এভাবে টিলা-পাহাড় কাটার কারনে প্রচুর পরিমান মাটি জলাশয়গুলোকে ভরাট করেছে। ছোট ছোট খাল ও ছড়া ভরাট হয়ে যাওয়ায় বর্ষায় পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। শুকনা মৌসুমে তা সহজে অনুধাবন করা যায়। এই বক্তব্যের স্বপক্ষ্যে সিলেট বিভাগের মৌলবিবাজার জেলার হাকালুকি হাওর নিয়ে প্রকাশিত বেসরকারী সংগঠন পরিপ্রেক্ষিতের জরিপের কথা উল্ল্যেখ করতে পারি। পরিপ্রেক্ষিত বলছে, হাকালুকি হাওড়ের ২৮১টি বিলের মধ্যে সম্পূর্ণ ও আংশিক ভরাট হয়ে গেছে ১৩৩টি বিল ।

দ্বিতীয় কারন হচ্ছে- উত্তর-পূর্ব ভারতের খাসিয়া-জৈন্তিয়াহিল ও ত্রিপুরা রাজ্যে থেকে আসা আন্তঃ সীমান্ত নদী, ছড়া ও খাল দিয়ে নেমে আসা পানিতে লাখ লাখ টন বালি ও মাটির প্রবাহ।  সিলেটের অধিকাংশ বড় নদীর উৎস উত্তর-পূর্ব ভারতের খাসিয়া-জৈন্তিয়াহিল। উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ে বৃষ্টি হলে উজান থেকে পাহাড়ি ঢলে নেমে আসা পানিতে থাকে উদাম পাহাড় ধুয়ে আসা লাখ লাখ টন বালি ও মাটি। আর এই বালি ও মাটি বছরের পর বছর ধরে সিলেট বিভাগের নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর-বাওরকে ভরাট করতে করতে এমন অবস্থায় নিয়ে এসেছে যে, এখন অতিরিক্ত পানি দ্রুত নামতে না পারে না। ফলে নতুন নতুন ফসলের জমি ও গ্রামাঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হচ্ছে । যা অদূর ভবিষ্যতে পৌণঃপুনিক ভাবে বাড়তেই থাকবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাহাড়ি ঢলের সাথে ও আন্তঃ সীমান্ত নদী দিয়ে বালি ও মাটি আসার পরিমান আশংকাজনক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যা মূলত উত্তর-পুর্ব ভারতে  অবাধ বৃক্ষ নিধন ও পাহাড়ে চলা অপরিকল্পিত কয়লা ও পাথর উত্তোলনের প্রভাব।

পাহাড় থেকে নেমে আসা বালি ও মাটিতে নদীর শুধু তলদেশ নয়, উৎসমুখ পর্যন্ত ভরাট হয়ে গেছে । এর অন্যতম প্রমাণ সুরমার উৎসমুখ ভরাট হয়ে যাওয়া। ভারতের মণিপুর রাজ্যের মাও সংসাং হতে উৎপন্ন বরাক নদী সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার অমলসীদ নামক স্থানে সুরমা ও কুশিয়ারা দুই শাখায় প্রবাহিত হয়েছে। অমলসীদে সুরমার উৎসমুখ দীর্ঘ এক দশক ধরে ক্রমান্বয়ে ভরাট হচ্ছে। সুরমার উৎসমুখ ও তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে বরাকের প্রায় ৮৫% পানি কুশিয়ারা দিয়ে প্রবাহিত হয়। এবারের শুষ্ক মৌসুমে সুরমার উৎসমুখ বরাক থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে বরাক নদীর সমস্ত পানি শুস্ক মৌসুমে কুশিয়ারা নদী দিয়েই বয়ে যায়। তাই জকিগঞ্জের আমলসীদ থেকে কানাইঘাট উপজেলার লোভাছড়ার সংযোগস্থল পর্যন্ত সুরমা মুমূর্ষু নদী । প্রায় ৩২ কিলোমিটার এলাকায় মুমূর্ষু সুরমায় ৩৫টির চর জেগেছে। এসব স্থান দিয়ে লোকজন হেঁটে পার হচ্ছে । নদীর মাঝ বরাবর চলছে ফসল ফলানোর চেষ্টা।

সিলেট বিভাগের পরিবেশ বিপর্যয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও রয়েছে । উন্নত বিশ্বের অবিবেচক আচরণের কারণে গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়ায় জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের ক্ষতি সম্পর্কে সবাই অবগত। সিডর, আইলার মতো ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।

এদিকে বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে প্রতি বছর দেশের উপকূলে ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। গত ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। গবেষকদের ধারণা ২০২০-২০২৫ সালের মধ্যে পানির উচ্চতা আরো বেড়ে যাবে । তখন শুষ্ক মৌসুমে পানিশূন্যতার কারনে লবণাক্ত পানি জোয়ারকালে সিলেট অঞ্চল পর্যন্ত চলে আসতে পারে।  

এ অবস্থায় সিলেটের পরিবেশগত বিপর্যয় রোধে প্রবাসীদের সর্বাত্মক অংশগ্রহণ প্রত্যাশিত। পাহাড় কেটে ও জলাশয় ভরাট করে হাউজিং বা শিল্প-কারখানা নির্মানে প্রবাসী বিনিয়োগ বন্ধ করা প্রয়োজন। দেশে অবস্থান কালে নিজের গ্রাম ও এলাকার মানুষকে প্রবাসীরা বর্জ্য ব্যাবস্থাপনায় উৎসাহ প্রদান করে নীজ নীজ গ্রাম ও শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন। একই সাথে দেশের নীতি নির্ধারকদেরকে সিলেটের পরিবেশ বিপর্যয়রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহনের চাপ দিতে পারেন। প্রবাসীরা অন্যান্য সামাজিক দায়িত্বপালনের পাশাপাশি চলমান পরিবেশ ও নদী আন্দোলনে আর্থিক সহযোগিতা করতে পারেন।

(নিউইয়র্কে জালালাবাদ এসোসিয়েশন আয়োজিত বিশ্ব সিলেট সম্মেলনে পঠিত বক্তব্য)

আপনার মন্তব্য

আলোচিত