মো. এবাদুর রহমান শামীম

২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ১৫:০৪

বাঙালির আবেগ-মানবতাবোধে বিশ্ব অবাক তাকিয়ে রয়

কথিত আছে, বাঙালি মাত্রই হুজুগে। আর হুজুগে বাঙালি প্রচণ্ড আবেগপ্রবণও। এই আবেগি বাঙালি আবার মানবতাবাদীও বটে। হুজুগে বাঙালি সব কাজে তাঁর আবেগ-অনুভূতিকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। অনেকের মতে, আবেগপ্রবণ বাঙালি হুশে নয়; বরং জোশে সব কাজ-কর্ম করে, বিধায় প্রায়শই বিভিন্ন কাজ-কর্মে গোলমাল বাধায়। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য বাঙালির সব অর্জনের পেছনে এই "আবেগ" নামক শব্দটি টনিক হিসেবে কাজ করেছে।

বাঙালির রয়েছে হাজার বছরের জাতিসত্তার স্বতন্ত্র, স্বকীয় ও গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। প্রাচীনকাল থেকে আমাদের দেশে জাতি, বর্ণ ও ধর্ম নির্বিশেষে লোকজন বসবাস করে আসছে। ধর্ম প্রচার, জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা, ব্যবসা-বাণিজ্যের চারণভূমি হিসেবে সুনাম-সুখ্যাতি অর্জন করেছে এই দেশ। বৌদ্ধ সহজিয়া, সাধু-সন্ন্যাসী, বৈষ্ণব ও পীর-সূফী-দরবেশ এবং পরিব্রাজক, বণিকদের নিরাপদ আবাসভূমি ছিল এই জনপদ।

ঐতিহাসিকভাবে একথা প্রমাণিত যে, বাঙালি আবহমানকাল থেকে উদার ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী। এই দেশের রূপ-প্রকৃতি ও মানুষের আত্মীয়তায় মুগ্ধ হননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া সত্যিই দুষ্কর। বাঙালির জীবনদর্শন ও জীবনাভূতির পরতে পরতে লুক্কায়িত রয়েছে আবেগ-উচ্ছ্বাস, সহমর্মিতা ও মানবতাবোধ। এমনকি বাংলা সাহিত্য , আন্দোলন-সংগ্রাম ও খেলাধুলাসহ সর্বক্ষেত্রে রয়েছে আবেগ-অনুভূতি, সহমর্মিতা ও মানবতাবোধের সেতুবন্ধন।

চর্যাপদ, বৈষ্ণব সাহিত্য, মঙ্গলকাব্য, শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন, মহাভারত, অন্নদামঙ্গল, পুঁথি ও মাঁর্সিয়া সাহিত্য, গীতাঞ্জলী ও কপালকুণ্ডলা সহ প্রায় সব সাহিত্যকর্মে আবেগ ও মানতাবোধের জয়গান প্রতিধ্বনিত হয়েছে। ভারত চন্দ্র রায় গুণাকরের 'আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে' [বাংলা সাহিত্যে আধুনিক যুগ তথা মানবিক যুগের সূচনা] কিংবা বঙ্কিমচন্দ্রের 'পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ' [সাহিত্যে রোমান্টিকতার উন্মেষ] - লেখনির মধ্যদিয়ে বাঙালির আবেগ, সহমর্মিতা ও মানবতাবোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, সাত চল্লিশে দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের মহান স্বাধীনতা আন্দোলনে আমাদের পারস্পরিক আবেগ-অনুভূতি ও মমত্ববোধ ছিল প্রেরণা ও সাফল্যের মূল উৎস। এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে সালাম, বরকত, জব্বার, রফিক, শফিউর সহ নাম না জানা আরও অনেকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলে রচিত হয় বাঙালির আত্মত্যাগের এক নতুন ইতিহাস। এই ভাষা আন্দোলনই স্বাধীনতার নামক স্বপ্নের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। যার ফলশ্রুতিতে আজ আমরা বাংলা ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করছি।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু এক অলিখিত আবেগময় ও তেজস্বী ভাষণে স্বাধীনতার অনানুষ্ঠানিক ও প্রস্তুতিমূলক ঘোষণা দেন। বাকিটা ইতিহাস.....। নিরস্ত্র বাঙালিরা বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে পাকিস্তানি সশস্ত্র সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যুদ্ধকালীন আপেল মাহমুদ দীপ্ত কণ্ঠে গেয়ে উঠলেন ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি....’। অমর এই গানের মাধ্যমে বাঙালির দেশপ্রেমের পাশাপাশি মানবতাবোধের প্রকৃত পরিচয় ফুটে উঠে। মাত্র নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ আর ত্রিশ লক্ষ শহীদ এবং আড়াই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম ও ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করি। মাতৃভাষার জন্য এবং মাতৃভূমির স্বাধীন করার জন্য পৃথিবীর কোনও জাতি এতো ত্যাগ স্বীকার করেনি। সম্ভব হয়েছে শুধু এই হুজুগে ও আবেগপ্রবণ বাঙালি জাতির দ্বারা। বঙ্গভঙ্গের পটভূমিতে রচিত বিশ্বকবির 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি....' গানে কবির আবেগ-অনুভূতি মূলত প্রাধান্য পেয়েছে। যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের মর্যাদা লাভ করে।

খেলাধুলা বিশেষ করে ক্রিকেট খেলার ক্ষেত্রেও বাঙালির আবেগ-অনুভূতি ও উচ্ছ্বাস অন্য সব কিছুর ঊর্ধ্বে। ক্রিকেট হচ্ছে আমাদের জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। ক্রিকেটের সাফল্য লাল সবুজের পতাকাকে গোটা বিশ্বে সগৌরবে উড্ডীন করেছে। মুলতানে পাকিস্তানের বিপক্ষে সেই টেস্টের কথা মনে পড়লে আজও নিজের অজান্তে চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে যায়। ম্যাচ হারার পর খালেদ মাহমুদরা চোখের জল মুছতে মুছতে মাঠ ছাড়ে। এশিয়া কাপের ফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে হারার পর সাকিব-মুশফিকের কান্নার দৃশ্য আজ অবধি আবেগতাড়িত করে।

সম্প্রতি মিয়ানমারের রাখাইন [আরাকান] রাজ্যে স্টেট কাউন্সিলর নব্য লেডি হিটলার অন সান সু চি ও সেনাপ্রধান নব্য ফারাও জেনারেল মিন অং হ্লাই'র নেতৃত্বে সামরিক জান্তা ও উগ্র ধর্মান্ধ জঙ্গি কর্তৃক রোহিঙ্গা নির্যাতন, ধর্ষণ ও নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠি প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে। প্রথমে বিজিবি সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করে। পরবর্তীতে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বললেন রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক হোন। যেই কথা, সেই কাজ। সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেওয়া হল। মাত্র কয়েকদিনের মাথায় কয়েক লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করল। সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী বললেন ১৬ কোটি মানুষের খাবার দিতে পারি, দশ লাখ [পুরাতন ৫ লাখ+নতুন ৫ লাখ] রোহিঙ্গাকে দিতে পারব না কেন? প্রয়োজনে খাবার ভাগ করে খাব......।

হুজুগে, আবেগি ও মানবতাবাদী বাঙালি নিজ নিজ মতপার্থক্য ও ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের সাহায্যের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়লো। রোহিঙ্গা সংকটের মধ্যদিয়ে দ্বিধা-বিভক্ত বাঙালির মধ্যে এক অলিখিত সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হল। বলা হয়ে থাকে, যখন পাঁচজন বাঙালি এক হয়েছে, তখন বাকি তিনজন ঠিকই তাদের পেছনে লেগে যায়। বরাবরের মতো রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমরা তা ভুল প্রমাণ করেছি। শুধু ব্যক্তি উদ্যোগে পাঁচ লক্ষাধিক মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, স্যানিটেশন ও শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা সহজসাধ্য কাজ নয়। যা একমাত্র বাঙালির দ্বারা সম্ভব হয়েছে।

আমাদের এই আবেগ-অনুভূতি, সহমর্মিতা ও মানবতাবোধ আজ সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। কয়েকদিন আগে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি বলেছেন, শরণার্থীদের প্রতি বাংলাদেশের মানুষ যে মমত্ববোধ দেখিয়েছে, তা তিনি তাঁর কর্মজীবনে কখনো দেখেননি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে সাহসী ভূমিকা রাখায় বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সম্প্রতি ব্রিটিশ মিডিয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে "মাদার অব হিউম্যানটি' বা 'মানবতার মা" নামে আখ্যায়িত করেছে। ইতিহাস সাক্ষী মানতাবোধের এমন নজির খুব কম জাতিই স্থাপন করতে পেরেছে। সর্বোপরি রোহিঙ্গা ইস্যুটি মানবিক হলেও এ ব্যাপারে আমাদের সতর্ক ও সচেতন হওয়া দরকার। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ভাবাদর্শ বা আবেগ-অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে কোন মহল যেন সমাজ ও রাষ্ট্র বিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে না পারে সেদিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে। ইতিহাস ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের আবেগ-অনুভূতি, সহমর্মিতা ও মানবতাবোধের সুযোগ নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ব্রিটিশরা প্রায় ২০০ বৎসর এবং পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী প্রায় ২৩ বৎসর শাসন-শোষণ করেছিল। এর পূর্বেকার শাসন-শোষণ ও বঞ্চনা-লাঞ্ছনার ইতিহাস না হয় বাদই দিলাম। ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়া উচিত। যাতে করে কারো পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে "নিজের পায়ে নিজে কুড়াল না মারি"।

আবেগ-অনুভূতি, মমত্ববোধ, সহমর্মিতা ও মানবতাবোধের সমন্বয়ে পৃথিবীর বুকে গড়ে উঠা এক বিস্ময় জাতির নাম বাঙালি। গোটা বিশ্বজুড়ে আজ বাঙালিদের জয়জয়কার বা বেটাগিরি।

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য যথার্থ বলেছেন:

সাবাস, বাংলাদেশ,
এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়:
জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার
তবু মাথা নোয়াবার নয়।

মো. এবাদুর রহমান শামীম: প্রভাষক, মোল্লাপাড়া হাজী আব্দু মিয়া কলেজ, ওসমানীনগর, সিলেট।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত