আলমগীর হোসাইন

০৯ অক্টোবর, ২০১৭ ১২:৩২

রোহিঙ্গা-চোখে কান্নার জল আর অবশিষ্ট নাই!

নিপীড়িত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের চোখে জল নেই। মিয়ানমার মিলিটারি আর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মগ জনগোষ্ঠীর অকথ্য নির্যাতনে তাদের বুকে বরফজমাট ব্যথা, সে ব্যথায় ব্যথিত হয়ে কক্সবাজারের আকাশটা যেন  নিয়েছে তাদের কান্নার ভার। কেননা শরণার্থীরা চোখে জল ফেলে কাঁদবে সেই অবশিষ্ট শক্তিটুকুও যে তাদের নেই। তাইতো তাদের চোখে বেদনার খরা। গুড়িগুড়ি বৃষ্টিকে মনে হয় মুখ ঢেকে চুপিসারে কান্না করা রোহিঙ্গাদের চোখের জল, ঝড়বৃষ্টিকে মনে হয় তীব্র ব্যথার আর্তনাদে আকাশটা কান্নায় ফেটে পড়ছে।

কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফের শরণার্থী ক্যাম্পে যাওয়া মাত্রই বেদনাক্রান্ত সে আকাশের মতোই যে কারো বুক ফেটে চোখ বেয়ে কান্নার জল আসতে চাইবে। তবে আমার চোখে জল আসেনি। রোহিঙ্গাদের দুর্দশার চিত্রে বুকটা প্রচণ্ডভাবে মোচড় দিয়ে উঠেছিল। বাকরুদ্ধ রোহিঙ্গাদের সাথে নিজেও যেন কিছু সময়ের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। শরণার্থী ক্যাম্পের পরিবেশ, আমার মতো অসংখ্য আগত লোক এবং রোহিঙ্গারা মিলে এ যেন এক অবাক দুনিয়ার বাকরুদ্ধ জনতার স্রোত।

রোহিঙ্গাদের সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোন ভাষা কারো জানা নেই, যেমনটি ধারণা নেই শিশু মিয়ানমার ভবিষ্যৎ। সিলেট থেকে উখিয়া টেকনাফের দিকে ঢুকতেই হাতের ডানপাশে হঠাৎ দৃষ্টি পড়তেই হাহাকার করে উঠে মন। রাস্তার পাশে কাদামাখা শরীরে অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে কী বা বসে আছে অসংখ্য নারী, পুরুষ, শিশু আর বৃদ্ধ। একজন মানুষ হয়ে মানুষের এমন দুর্দশা সহ্য হওয়ার মতো নয়।

আমাদের গাড়ি থামে উখিয়া শরণার্থী ক্যাম্পের কাছেই। গাড়ি থেকে নামতেই রুক্ষ চুল, শুষ্ক ঠোঁটে, জীর্ণ কাপড়ে শীর্ণ দেহের চাঞ্চল্যহীন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটি শিশুর দিকে তাকাতেই বুকটা যেন হাহাকার করে উঠে।

সেই শিশুদলেরই একজন মায়মোনা, বয়স তার সাত কিংবা আট। বাবা-মা কোথায়? এমন প্রশ্ন করতেই যেন তার করুণ দুটি চোখ মুহূর্তে সমস্ত উত্তর জানান দিয়ে যায়। তবু জিজ্ঞেস করলাম তোমার বাবা কোথায়? সে তার আঞ্চলিক ভাষায় ছোট করে বলল বাবা নেই। আরও কিছুক্ষণ তার সাথে কথা হলো, আস্তে আস্তে সে বলল সেই নির্মমতার কথা। মিলিটারিরা তার বাবাকে বাড়ির উঠানে তাদের সামনেই গলা কেটে হত্যা করেছে। ঐদিন রাতেই তার অন্তঃসত্ত্বা মা তাদের পাঁচ বোনকে নিয়ে বাংলাদেশের পথে রওয়ানা দেয়। প্রায় ৭ দিন ধরে পায়ে হেঁটে তারা বাংলাদেশে পৌঁছে।

আমাদের সাথে তখন মায়মোনার বাকি চার বোন এবং আরও কয়েকটি শিশু। একটি শিশুকে বাবা-মা এর কথা জিজ্ঞেস করতেই বাকরুদ্ধ দৃষ্টিতে আমার চোখের দিকে থাকায়, ওর বাবা-মাকে মেরে ফেলেছে মিলিটারি, জ্বালিয়ে দিয়েছে ঘর, সে গ্রামের কয়েকজনের সাথে পালিয়ে আসছিল এখানে। আসার পথে সেই পরিচিতজনদেরও হারিয়ে সে এখন একেবারে অপরিচিত এক দুনিয়ার বাসিন্দা। কোথায় থাকো? এমন প্রশ্ন করতেই হাত উঁচিয়ে ক্যাম্প দেখায়। এখানে যাদের সাথে থাকে তাদের কাউকে সে চেনেনা। শিশুগুলোর জন্য মনের ভেতর থেকে যেন গুঙিয়ে আসে কান্না। সেই শিশুদের দুহাতে জড়িয়ে বুকে টেনে নেই। ওদেরকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা, শক্তি সামর্থ্য কোনটাই আমাদের নেই। তবু চেষ্টা করি। এ চেষ্টা যেন মিথ্যে সান্ত্বনার ব্যর্থ প্রয়াস।

ক্যাম্পের তাঁবুতে দেখা মিলে মুখঢাকা কিছু তরুণীদের। যাদের শরীরে মানবরূপী শকুনদের আঁচড়। অসহায় এ তরুণীদের এক করুণ কাহিনী শোনা গেল আমার সহযাত্রী সিলেট কাজিরবাজার মাদ্রাসার শিক্ষার্থী মুকিত মামার কাছ থেকে। সেদিন উনার শিক্ষক শাহ মমশাদ, ঢাকা রহমানিয়া মাদ্রাসার মহাপরিচালক মাওলানা মাহফুজল হক সহ বিভিন্ন মাদ্রাসার কয়েকজন শিক্ষক ত্রাণ বিতরণে গিয়েছিলেন ওখানে। ত্রাণ বিতরণের এক পর্যায় শিক্ষকদের আগলে দাঁড়ায় কয়েকজন তরুণী। করজোড় করে ওরা যে আবদার করে সে আবদার শুনে অঝোরে চোখের জল ফেলা ছাড়া কোন উপায় ছিলনা তাদের। ওরা অকপটে নির্যাতনের সে বর্ণনা তুলে ধরে। ওদের শরীরে বেড়ে উঠছে পরিচয়হীন আরেক শরীর। ধর্ষিত এই মেয়েরা চায় জন্মনিয়ন্ত্রণের ঔষধ। নষ্ট করতে চায় গর্ভ! ওরা জানায় শুধু মগ কিংবা মিয়ানমারের মিলিটারি নয় এখানেও তারা কিছু মানবরূপী অমানুষের লালসার শিকার হচ্ছে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সু-শৃঙ্খল ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে দেখা যায় মুখে ঢেকে ত্রাণ নিচ্ছে কিছু শরণার্থী, যাদের মুখে অভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট। নিজেদের এমন পরিস্থিতির কথা হয়তো কখনো ঘুর্ণাক্ষরেও ভাবেনি তারা।

শরণার্থী ক্যাম্প সম্বন্ধে বিভিন্নভাবে জানা গেল কিছু অমানবিক তথ্য। তাঁবুর জন্য রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে কৌশলে চাঁদা নিচ্ছে কিছু দালাল, যুবতী মেয়েদের বেশ্যাবৃত্তিতে নেওয়ার চাপ দিচ্ছে, ছেলে শিশুদের দিয়ে অপকর্ম করানোর জন্য তাদেরকে পাচার করার চেষ্টা করছে দুর্বৃত্তরা। দেখলাম কিছু নির্লজ্জ লোক শরণার্থীদের অসহায়ত্বের এই সুযোগে খই ছিটিয়ে দেওয়ার মতো পাঁচ-দশটাকা ছিটিয়ে দিয়ে অসহায়দের হুমড়ি খেয়ে পড়ার মজা লুটছে। যা হৃদয়বিদারক।

তবে এতোসবের মাঝেও মনের মাঝে আনন্দ জেগেছে এই ভেবে যে এই দুর্দিনেও তারা পেয়েছে মাথা গোজার ঠাঁই। সরকারের তড়িৎ পদক্ষেপ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অদম্য ইচ্ছা আর বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মানবপ্রেমের ফলশ্রুতিতেই দশ লক্ষ মানুষের বিশাল স্রোতকে বুকে আগলে রাখার মতো সেই অসম্ভব কাজকে সম্ভব করেছে এদেশের মানুষ।

এখানে বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মাদার অব হিউমিনিটি খ্যাত বিশ্বশান্তির অগ্রদূত শেখ হাসিনার দৃঢ়-মনোবলের কথা আলাদা করে বলতেই হয়। কেননা তার কাছে নতজানু হয়েছে সু চির নৃশংসতা। শেখ হাসিনা বলেছিলেন “আমাদের দেশ আয়তনে ছোট হতে পারে কিন্তু এদেশের মানুষের আছে বিশাল হৃদয়, ষোলকোটি মানুষকে খাওয়াতে পারলে কয়েক লাখ বিপদগ্রস্ত মানুষকে খাওয়াতে আমাদের কোন অসুবিধা হবেনা।”

শরণার্থী ক্যাম্পে গিয়ে মিলে সেই কথাগুলোর হুবহু তাৎপর্য। ক্যাম্পের কয়েকজন শরণার্থী জানালের এখানে তাদের খাবার দাবারের সমস্যা তেমন নেই। দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সেনাবাহিনী তাদেরকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে। সর্বোপরি রোহিঙ্গাদের দুর্দশা দেখতে এবং ত্রাণ নিয়ে এখনে যারা যাচ্ছেন তারা রোহিঙ্গাদের জন্য সরকারের নেওয়া প্রতিটি পদক্ষেপে পুরোই সন্তুষ্ট ।

মন চাচ্ছিল অসহায় এই শরণার্থীদের সাথে আরও কিছু সময় কাটাই কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনীর নিয়ম মেনে সন্ধ্যা হতেই ফিরে আসতে হলো সেখান থেকে। গাড়িতে বসে বারবার চোখে ভাসছিল রোহিঙ্গাদের দুর্দশার চিত্র সাথে কিছু ভাবনা আর প্রশ্নও উঁকি দিচ্ছিল মনে। রোহিঙ্গারা কি আর ফিরে পাবেনা মাতৃভূমির স্বাদ, স্বাচ্ছন্দ্যে ভরা সেই স্বাভাবিক জীবন? নাকি এভাবেই শরণার্থী হয়ে পার করবে জীবনের বাকি সময়?

বিভিন্ন দেশ ত্রাণ দিচ্ছে, বাংলাদেশের সর্বস্তরের সাধারণ মানুষও সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে তাদের জন্য। কিন্তু এ চেষ্টা কি অব্যাহত থাকবে? আর কতোদিনই বা ত্রাণ কার্যক্রম নিয়মিত করা সম্ভব? তাছাড়া শুধু ত্রাণ দিয়ে অদূর ভবিষ্যতে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ রাখা কি সম্ভব হবে? আন্তর্জাতিকভাবে সমবেদনা জানানো হচ্ছে, ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে অথচ তাদের পুনর্বাসন কিংবা দেশে ফেরানোর কোন জোরালো ভূমিকাই নিতে দেখা যাচ্ছেনা। এতে করে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন এদের অসহায়ত্বের সুযোগে জঙ্গিবাদের দিকে নিয়ে যাবে। যার জন্য ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে জঙ্গি-রাষ্ট্র হিসেবে প্রমাণ করার একটা পথও কি সুগম হলো না? যার ফল বাংলাদেশের জন্য ভয়ানক। তবে সরকারের সজাগ দৃষ্টিই কেবল সে পরিস্থিতির সামাল দিতে পারে।

যত দ্রুত সম্ভব আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রেখে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো কিংবা বিভিন্ন মুসলিম দেশে স্থায়ী পুনর্বাসন করাতে হবে। ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক চাপে মিয়ানমার কিছুটা নমনীয় ভাব দেখাচ্ছে, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দিচ্ছে কিন্তু সেটা জোরালো নয়। তবে কি এটি শুধু লোক দেখানো আলোচনার দেয়ালেই পিঠ ঠেকাবে? নাকি কার্যত কিছু হবে। যদি মিয়ানমারে পুনরায় তাদের ফিরিয়ে নেয়ও তবে সেখানে নিরাপত্তার গ্যারান্টিই বা কি হতে পারে? এসব নানান চিন্তা আর প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে মাথায়।

পেছনে ফেলে সব নির্মম চিত্র আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলে সম্মুখে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত হবে রাত শেষে ভোর কিন্তু শরণার্থী শিবিরে যেন এই আলো-আঁধারির কোন মানে নেই কেননা তাদের জীবনই তো অনিশ্চয়তার এক ঘোর অন্ধকারে আচ্ছন্ন।

  • আলমগীর হোসাইন: শিক্ষার্থী
  • ছবি ক্যাপশন- বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গাদের সঙ্গে লেখক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত