ইন্দ্রানী সেন সম্পা

০৭ নভেম্বর, ২০১৭ ০১:৩০

আমার বাবা জিতেন সেন

সাংবাদিক রাজনীতিবিদ জিতেন সেন। আমার বাবা। আজ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৫ সালের ৭ নভেম্বর এমনই এক শীতের রাতে তিনি আমাদেরকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে যান। পেশায় সাংবাদিক, নেশায় সমাজতন্ত্রের  স্বপ্নে বিভোর একজন দৃঢ়চেতা মানুষ ছিলেন। নীতিবান সাংবাদিকতা আর প্রজ্ঞাবান রাজনীতিবাদ হিসেবে তিনি আজও সুপরিচিত।

হবিগঞ্জ জেলায় আজমেরীগঞ্জ উপজেলার বিরাট গ্রামের সম্ভ্রান্ত সেন পরিবারে বাবার জন্ম। স্বর্গীয় রাজেন্দ্র চন্দ্র সেন ও স্বর্গীয় নিরোদা কুমারী সেনের পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। আমার ঠাকুরদাও ছিলেন তৎকালীন মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানীর অনুসারী। আমার বড় জেঠো স্বর্গীয় কমরেড রাখাল সেনের হাত ধরেই বাবার রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি। আমার জেঠু যিনি ছিলেন সাম্যবাদী দলের প্রথম সারির কেন্দ্রীয় নেতা। পারিবারিকভাবে বিশাল সম্পদ ও সচ্ছল ব্যবসায়ী পরিবারে বসবাস করলেও বাবা শৈশব থেকে স্বপ্ন দেখতেন একটি সাম্যবাদী সমাজের। আরাম আয়েশে থাকলেও নিজে দাঁড় টেনে নৌকা চালিয়ে স্কুলে যেতেন। গরীব-মেহনতী মানুষের দু:খ দুর্দশা তাকে বিচলিত করতো। তিনি মাত্র ১৫ বছর বয়সে গ্রামের বাড়ি থেকে হবিগঞ্জ শহরে এসে লজিং থেকে পড়াশুনা চালিয়ে তৎকালীন ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে থাকেন।

ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে তিনি সরাসরি সাংবাদিকতা পেশার সাথে জড়িত হয়ে পড়েন। ১৯৬৮ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক আওয়াজ’ পত্রিকায় হবিগঞ্জ মহকুমার সংবাদদাতা হিসেবে অল্প বয়সেই নিয়োগ প্রাপ্ত হন। এরপর তিনি যুক্ত হন ‘সাপ্তাহিক গণশক্তি’ পত্রিকার সাথে। তিনি আফ্রো-এশিয়া ও লেটিন আমেরিকার জনগণের নেতা মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর রাজনৈতিক আদর্শে দীক্ষিত হয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) একনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে তিনি হবিগঞ্জ মহকুমা কমিটির দপ্তর সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। এ সময়ে তিনি গ্রামগঞ্জে, পাড়ায়-পাড়ায় ছাত্রদের সংগঠিত করে ঊনসত্তরের গণ অভ্যূত্থানে নেতৃত্ব দেন এবং গণঅভ্যূত্থানের সংবাদ সংগ্রহ করে তাঁর সাহসী লেখনির মাধ্যমে সংবাদপত্রে তুলে ধরেন। ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থীদেরকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ করতে থাকেন। মুক্তিযুদ্ধের এক পর্যায়ে তিনি ভারতের ধর্মনগর শহরের আগরতলা রোডে উপ্তাখালি ক্যাম্পে ব্লক সুপারভাইজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

ষাটের দশক থেকে আশির দশকের ১৯৮৬ সালের  মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত তিনি হবিগঞ্জ শহরে অবস্থান করেন। হবিগঞ্জের সাপ্তাহিক স্বাধিকার পত্রিকায় তিনি প্রতিষ্ঠাতা বার্তা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও সাপ্তাহিক দৃষ্টিকোণ, সাপ্তাহিক স্বদেশ বার্তায় বার্তা সম্পাদক এবং পাক্ষিক তরপ দর্পন পত্রিকায় নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও বিভিন্ন সময় নির্বাহী পরিষদের দায়িত্বও পালন করেন। তিনি সাপ্তাহিক পত্রিকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (সাসাই) এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং প্রেস শ্রমিক ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা উপদেষ্টা ছিলেন।

স্বাধীনতাত্তোর ১৯৭৪ সালের তৎকালীন সময়ে মাত্র চারটি পত্রিকা রেখে সরকার সব পত্রিকা বন্ধ করে দেয়ার পরও তিনি সাংবাদিকতা থেকে সরে যাননি। এ সময়ে তিনি অনিয়মি ভাবে প্রকাশিত বিভিন্ন ম্যাগাজিনে বস্তুনিষ্ঠ লেখা লিখতেন এবং গোপনে সকল রাজনৈতিক কর্মকান্ডও চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশেরে স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারের হত্যার পর রাজনৈতিক কারণে দীর্ঘদিন তিনি আতমগোপনে থাকতে বাধ্য হন। পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালে  বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এম এল) রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলে তিনি সাম্যবাদী দলে যোগদান করেন। সে সময়ে সাপ্তাহিক গণশক্তি নিয়মিত প্রকাশিত হলে তিনি সে পত্রিকায় পূনরায় সাংবাদিকতা শুরু করেন।

১৯৮৬ সালে তিনি পোস্ট অফিসের গুরুত্বপূর্ণ পদে সরকারী চাকুরী পেলেও সাংবাদিকতায় অশেষ আগ্রহ এবং সমাজতন্ত্র কায়েমের একনিস্ট ত্যাগী নেতা ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আত্মনিয়োগের কারণে তিনি সে চাকুরী তিনি গ্রহণ করেন নি। ১৯৮৭ সালে সাংবাদিকতা পেশাকে আরো মজবুতভাবে গ্রহণের লক্ষে সিলেট থেকে প্রকাশিত সর্বাধিক জনপ্রিয় পত্রিকা  দৈনিক জালালাবাদীতে সিনিয়র ষ্টাফ রিপোর্টার পদে যোগদান করেন। তিনি সাপ্তাহিক সিলেট সমাচারের বার্তা-সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন।

তারপর ১৯৯২ সালে প্রগতিশীল ধারার পত্রিকা দৈনিক আজকের সিলেট আত্মপ্রকাশ করলে তিনি তার প্রতিষ্ঠাতা বার্তা-সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। তিনি ১৯৯৫ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত দৈনিক বৃহত্তরের সিলেটের মানচিত্র পত্রিকায় বার্তা-সম্পাদক এবং ২০০০ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। সে সময় তিনি ঢাকা থেকে প্রকাশিত জাতীয় দৈনিক ভোরের কাগজ পত্রিকায় সিলেট প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে ২০০১ সালের আগষ্ট মাস থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত জাতীয় দৈনিক আজকের পত্রিকায় সিলেট প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৮ সালে তিনি সিলেট প্রেসক্লাবের স্থায়ী সদস্য পদ লাভ করেন এবং বিভিন্ন সময়ে প্রেসক্লাবে নির্বাহী সদস্যও নির্বাচিত হন। ১৯৮৯-৯০ সালে সিলেট সাংবাদিক ইউনিয়নে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। তখনকার সময়ে ব্যস্ততা ও কঠোর পেশাগত কাজের চাপ থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণে তিনি পিছপা হননি। ৯০’এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, কৃষক-শ্রমিক আন্দোলন, ভূমিহীন খেতমজুর আন্দোলন, টিপাইমুখ রক্ষা আন্দোলন, তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা আন্দোলন, সাম্রাজ্যবাদ ও  সন্ত্রাশ বিরোধী আন্দোলন, সিলেট বিভাগ আন্দোলন সহ সকল স্থানীয় ও প্রগতিশীল আন্দোলনে সামনের সারির নেতা ও সংগঠক হিসেবে কাজ করতে থাকেন।

১৯৯২ সালে সাম্যবাদী দল, ওয়ার্কার্স পার্টি ও কমিউনিস্ট লীগ যৌথ কংগ্রেসে এক পার্টিতে রুপান্তরিত হলে তিনি বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টিতে যোগদান করেন। তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে এক পর্যায়ে তিনি বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। আজীবন বিপ্লবী এ মানুষটির দীর্ঘ কর্মময় জীবনে তিনি অনেক সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কর্মী তৈরী করে গেছেন। যারা আজ স্ব-স্ব ক্ষেত্রে মেধার স্বাক্ষর রেখে কাজ করে চলেছেন। বাবা, এ নিরীহ মানুষটি ব্যক্তিজীবনে স্ত্রী ও আমরা চার ভাই-বোনকে নিয়ে অত্যন্ত সাধারণ জীবন-যাপন করলেও রাজনৈতিক ও পেশাগত আদর্শ থেকে কখনও বিচ্যুত হন নি। প্রচন্ড দারিদ্রতা থাকা সত্ত্বেও জাগতিক লোভ-লালসা থেকে দুরে থেকে শোষণমুক্তির সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত রেখে আজন্ম লড়াই করে গেছেন এবং নৈতিক সাংবাদিকতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। আমাদেরকে শিখিয়ে গেছেন কীভাবে আর্থিক দৈন্যতার মাঝেও নীতিগত ও রাজনৈতিক আদর্শ বাঁচিয়ে রেখে সমাজে মাথা উচু করে দাঁড়াতে হয়। আজ তার প্রয়াণ দিবসে জানাই বিনত শ্রদ্ধা। বাবা, তোমার লড়াই আজও থামেনি। আমারা হাটছি তোমারই পথ ধরে, শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে।

লেখক: জিতেন সেনের মেয়ে, নাট্যকর্মী ও নারী সংগঠক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত