রাসেল আল মাসুদ

১০ জানুয়ারি, ২০১৮ ১৬:৫৮

খৎনা

খৎনা; সারকামসিশন হল পৃথিবীর সবচেয়ে পুরাতন সার্জিক্যাল অপারেশন। ধারণা করা হয়, বর্তমান পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ পুরুষ খৎনা করান। আমাদের দেশে আমরা খৎনাকে মুসলমানি করানো বলি। কারণ, মুসলমান ছাড়া এখানে আর কেউ এটা করায় না।

মূলত, এই প্রথাটির প্রথম শক্তপোক্ত প্রমাণ পাওয়া যায় প্রাচীন মিশরিয়দের মধ্যে। খ্রিষ্টপূর্ব ২৪০০ সালে আঁকা ছবিতে। তাদের বিশ্বাস, স্বয়ং সূর্যদেবতা 'রা' নিজেও খৎনা করানো একজন।

এখানে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, কেন খৎনার উদ্ভব হল এবং কেন সেই প্রথা হাজার হাজার বছর পার করার পর এখনও বহমান।

মানুষ একেবারে শুরু থেকেই কিছু জিনিস খুব বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করে। এদের মধ্যে একটা হলো রক্ত, আরেকটা যৌনতা।

মানুষ দেখে, সে যখন একটা পশুকে বা অপর মানুষকে আঘাত করে তখন তার দেহ থেকে রক্ত নির্গত হয়। এই রক্তপাতের মধ্য দিয়ে জীবিতের দেহ ক্রমশ অসাড় হয়ে মৃতে পরিণত হয়। এ থেকে তারা ধারণা করল, জীবনের মূলবস্তু হলো রক্ত। রক্তকে তারা পবিত্র জ্ঞান করতে থাকে এবং পরবর্তী সমাজ বিবর্তনের ফলে ধর্মীয় রীতিনীতির উদ্ভব হলে সেখানে শক্তিমানের সন্তুষ্টির জন্য রক্ত বিসর্জনের প্রথা আসে। কেননা, রক্ত হলো জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান, সবচেয়ে পবিত্র বস্তু, যা মানুষ দেবতাকে দিতে পারে। বর্তমানেও তার ধারাবাহিকতায় পশু বলি, কুরবানি প্রভৃতি প্রথা নানা আকারে টিকে আছে।

দ্বিতীয় বিস্ময় ছিল যৌনতা। যৌনতাকে প্রথমদিকে হয়ত মানুষ ক্ষুধা, ঘুম এসব প্রবৃত্তির মতই ভাবত। কিন্তু ক্রমশ মানুষ সন্তান জন্মের সাথে যৌনতার সম্পর্ক আবিষ্কার করে। অর্থাৎ, তারা বুঝতে পারে নতুন জীবনের সূত্রপাত হয় যৌনতার মধ্য দিয়ে।

শুরুর দিকে ভাবা হতো সন্তান জন্মদানে শুধু মায়ের ভূমিকাই যথেষ্ট, পুরুষ মুখ্য না। তখন মানুষ জন্মদানের মত অনন্য এক ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার জন্য নারীকে পূজনীয় স্থানে বসায়। নারীদেহকে মূর্তি বানিয়ে উপাসনা করা শুরু করে। কখনওবা নারীর রজঃস্রাব যোনির প্রতিরূপকে ব্যবহার করা হয় উর্বরতা সম্পর্কিত আচার অনুষ্ঠানে। পরে সভ্যতার বয়স বাড়ার সাথে সাথে নারী-পুরুষের গোষ্ঠী ও পরিবারগত ক্ষমতা কাঠামোর রদবদল ঘটে। নারীকে আগের ক্ষমতাবান অবস্থান থেকে সরিয়ে পুরুষেই স্থান দখল করে। একই সাথে সে আবিষ্কার করে প্রজননের উৎস শুধু নারী না, বরং পুরুষেরও সক্রিয় ভূমিকা আছে। তাই নারীর পাশাপাশি পুরুষ যৌনাঙ্গের প্রতিরূপও উপাসনার সাথে সম্পর্কিত হয়। এখানে শিবলিঙ্গের উদাহরণ টানা যেতে পারে। যে লিঙ্গপূজা এখনও চালু আছে।

রক্ত এবং যৌনতা, সম্ভবত এদুই বিস্ময়ের সম্মিলন হলো, খৎনা। রক্ত তো দেবতার প্রতি সবচেয়ে মূল্যবান উৎসর্গ। এর মধ্যেও যৌনাঙ্গের রক্ত বিসর্জন হলো দেবতার নিকট অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ কিছু। তার কাছে আত্মসমর্পণের প্রথম শর্ত। ধর্মীয়ভাবে সেই প্রথা প্রাচীন মিশরিয়দের থেকে আরম্ভ হয়ে ইহুদি থেকে মুসলমান পর্যন্ত বহমান, যা বর্তমান পৃথিবীতেও সমান জনপ্রিয়।

পুরুষদের পাশাপাশি নারীদেরও খৎনা করানোর প্রথা চালু হয়েছিল, এবং এখনও কোথাও কোথাও চালু আছে। কিন্তু নারীদের খৎনার ব্যাপারটা শরীরের পক্ষে যায় নি বলেই হয়ত মানুষ এটাকে গ্রহণ করে নি।পুরুষেরটা এখনও সাড়ম্বরে টিকে আছে, কারণ তা শরীরের পক্ষে গিয়েছে।

তবে অন্য প্রথার মতই, প্রথা আরম্ভের ওই প্রাচীন দর্শনটুকু এখন আর এর সাথে নেই। তার বদলে এখন যুক্ত হয়েছে বৈজ্ঞানিক ও শারীরবৃত্তিক কারণ। ডব্লু এইচও’র মত বিশ্বব্যাপি সংগঠনও এখন খৎনার করানোর জন্য উৎসাহিত করে স্বাস্থ্যগত কারণে। ফলে ইহুদি এবং ইসলাম ধর্মের বাইরেও এই প্রথা ক্রমশ ছড়িয়ে গেছে এবং যাচ্ছে।

সহায়তা:
১। মানব সমাজ- রাহুল সাংকৃত্যায়ন
২। উইকিপিডিয়া

আপনার মন্তব্য

আলোচিত