আলমগীর শাহরিয়ার

১৬ জানুয়ারি, ২০১৮ ০১:৩২

১/১১-এর অন্ধকার ও মুক্তির সাহসী মিছিল

বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর সভা শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, "বাংলাদেশে আর ওয়ান-ইলেভেনের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না । ঘোলা পানিতে কারোর মাছ শিকারের দূরভিসন্ধি সফল হবে না।"

এরশাদ পরবর্তী সময়ে রাজনীতির এক গভীর অন্ধকার অধ্যায়ের সূচনা ২০০৭ সালে জানুয়ারী মাসে জরুরী অবস্থা জারির মধ্য দিয়ে । জনমনে যা ওয়ান-ইলেভেন নামেই সমধিক পরিচিত । রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীদের ধর-পাকড় চলছিল রাতের অন্ধকারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আড়ালে সামরিক ছায়া সরকার চালাচ্ছিল দেশ । ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন সে এক বিভীষিকাময় সময় । এদেশের বুকে জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসা অন্ধকার অধ্যায়ের পট পরিবর্তন হয়েছিল স্বাধিকার আর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শহীদদের রক্তের উত্তরাধিকার রাজপথে এদেশের চিরসাহসী ছাত্র আন্দোলনের পথ ধরেই ।

২০০৭ সালে সেনা সদস্যদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের খেলার মাঠে এক বিরোধ ও সংঘর্ষের জের ধরে গড়ে উঠে আন্দোলন । সে সময় সারাদেশে বাক স্বাধীনতাহীন, স্বাভাবিক কার্যক্রম থমকে যাওয়া সময়ে অবরুদ্ধ মানুষ প্রথম সুযোগেই বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সে আন্দোলনের পথ ধরেই সামরিক ছায়া সরকার নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে বাধ্য হয়। যে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করে। বিএনপির দুর্নীতি, সন্ত্রাস, রাজাকারদের পুনর্বাসন আর সারাদেশে জঙ্গীবাদ বিস্তারের বিরুদ্ধে, মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ও আকাঙ্খার দেশ ফিরে পাবার পক্ষে মানুষ নিরঙ্কুশ রায় দেয় । বাংলাদেশে রাজনীতির ইতিহাসে ২০০৭ সালের আগস্ট ছাত্র আন্দোলন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও কারারুদ্ধ নেত্রী শেখ হাসিনা মুক্তি আন্দোলনে এক উজ্জ্বল অধ্যায় । আমরা তখন সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। ভর্তি হয়ে ক্লাস শুরু হবার পরই এ আন্দোলনের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। গণতন্ত্র ও গনতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনার মুক্তির আন্দোলনে একজন ক্ষুদ্র কর্মী হিসেবে সেদিন রাজপথে সেনা-পুলিশের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মিছিল করে আহত হয়েছি। যখন প্রথম বর্ষে পড়ুয়া সহপাঠীরা স্বাভাবিকভাবেই আন্দোলন থেকে নিরাপদ দূরত্বে ছিলেন। তখন বয়স ছিল একুশ । তখনও মহাদেব সাহার কবিতাটি পড়া হয়নি।
"একুশ মানেই আসছে,
সালাম ফিরে আসছে, বরকত ফিরে আসছে
তাজুল ফিরে আসছে/...
একুশ মানেই মুক্তিযুদ্ধ ফিরে আসছে
সেই সাহসে বুক পেতে দেয়া তারুণ্য ফিরে আসছে
তারুণ্য এর চোখে দুর্জয় শপথ ফিরে আসছে,...
একুশ মানেই আসছে, স্বপ্ন আসছে, ভবিষৎ আসছে /..."

রক্তের স্পন্দনে এই কবিতার চেতনা জাগ্রত ছিল। দুর্জয় তারুণ্যে, সাহসে, অকুতোভয় বুকে পেতে আর্মি, পুলিশের গুলি আর টিয়ার শেলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলেছি, শেখ হাসিনা ও অবরুদ্ধ গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচারী তত্বাবধায়ক নিপাত যাক।

আন্দোলনের তুঙ্গস্পর্শী সময়ে শাহবাগে পুলিশের মুখোমুখি সংঘর্ষের ছবি জনপ্রিয় একটি প্রধান দৈনিকের প্রথম পাতায় হেডিং হিসেবে প্রকাশ হলে আত্মগোপনে থাকতে হয়েছিল অনেকদিন। আন্দোলনের সহযোদ্ধাদের অনেককেই তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেশব্যাপী চিরুনি অভিযান চালিয়ে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। অনেকেই তখন নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষুব্ধ ছাত্র আন্দোলনের মুখে ২০০৮ সালে ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় । নির্বাচনের আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব ক্যাম্পাসে তখন বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের একচ্ছত্র আধিপত্য । আমরা যারা ছাত্রলীগকে ভালবাসতাম তারা তখন হলে ছিলাম শঙ্কিত সংখ্যালঘু । প্রথম বর্ষের ছাত্র হিসেবে ছাত্রদলের মিছিল মিটিংয়ে যোগ দেবার জন্য রাতে গেস্ট রুমে ডাকা হত । ডাকে না পেয়ে রুমে যেয়ে খোঁজ নিত। অনেকটা পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতাম। আর সহপাঠি, বন্ধুদের অনেককেই দেখতাম হল থেকে সকালে গলা কাঁপিয়ে ছাত্রদলের মিছিলে যেতে। আমরা যারা আপস করিনি তাদের অনেকেই হল পর্যন্ত ছাড়তে হয়েছিল । বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশে আস্থা রাখতাম বলে আদর্শ ও বিশ্বাসের সঙ্গে আপস করার কথা চিন্তা করিনি কখনো।

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দলকে বিজয়ী করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র ও ছাত্রলীগের একজন কর্মী হিসেবে নিজ নির্বাচনী এলাকায় প্রচার প্রচারণায় ছুটে গেছি । আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে বিজয়ের পুর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত নিরলস কাজ করেছি । নৌকার পক্ষে জনমত গঠনে এলাকা চষে বেড়িয়েছি । বিজয়ের পর ক্যাম্পাসে ফিরেছি । কি আশ্চর্য সরকার পরিবর্তনের পর অনেককেই দেখলাম রাতারাতি বোল পাল্টে ছাত্রলীগ হয়ে গেল । বিশজনকেও যখন একটা মিছিল করতে পাওয়া যায়নি তখন রাতারাতি ইউ টার্ন নিয়ে হলে, ক্যাম্পাসে শত শত ছাত্রলীগ । ছাত্রদলের মিছিলের অগ্রসেনানী অনেককেই দেখলাম হল থেকে কেন্দ্রীয় নেতা পর্যন্ত বনে গেল চোখের সামনে । অঞ্চল প্রভাব, উপর আশীর্বাদ- কিছুই না থাকায় বোকার মত আদর্শে বিশ্বাস রাখা আমি কাঙ্ক্ষিত কিছুই পাইনি । কতজনের কাছে গেছি, কতজনের দুয়ারে নক করেছি ছাত্র রাজনীতিতে একটা পরিচয়ের জন্যে, পাইনি ।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন, জাহাঙ্গীরনগর ও শাবিতে ইংরেজির মত নিশ্চিত ক্যারিয়ার গড়ার বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ ফেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম স্রেফ রাজনীতি, ভবিষ্যতে এ দেশ ও মানুষের জন্য কিছু করব এই ভাবনা থেকে। না, সে স্বপ্ন পুরণ হয়নি । নানা সমীকরণ, বিভাজন ও ভেদবুদ্ধিতে সীমাবদ্ধ সংগঠনে তখন কিছুই পাইনি । কাঙ্ক্ষিত কিছু পাবার সম্ভাবনা শূন্য দেখে নীরবে, নিভৃতে সরে গেছি।

১/১১ পরবর্তী দুর্দিনে নেত্রী শেখ হাসিনার জন্য বুকের ভেতর নিঃশর্ত ভালোবাসা কারোর কাছে ফেরী করিনি কোনদিন । সামজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে হঠাৎ নেত্রীর মুক্তি আন্দোলনে আমাদের পুরনো একটি ছবি বেশ আলোচনায় আসতে দেখে কিছু কথা লেখার প্রয়োজন বোধ করলাম। বিরোধী দলে থাকার সময়ে সেই সিলেট সরকারি কলেজ থেকে আমি ও পরবর্তীতে আমার সহোদরের ছাত্রলীগের সঙ্গে পরিচয় । নানা দুর্দিন দেখেছি । বিশ্বাস ও আদর্শ থেকে সরে আসিনি । প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে, নটরডেম কলেজে পড়ুয়া আরেক সহোদর জাহাঙ্গীর আলম নোমান সে সময় ছাত্রদল-শিবির অধ্যুষিত শাবি ক্যাম্পাসে ভর্তি হবার পর পরই শিবিরের দাওয়াত পত্র প্রকাশ্যে ছিড়ে ফেলে দেয়ায় শিবির ক্যাডারদের হত্যার হুমকি পেয়েছিল। যা তখন জাতীয় পত্রিকা জনকণ্ঠ, যুগান্তরসহ স্থানীয় অনেক পত্রিকায় প্রকাশ হয়।

রাজনীতি করে একটি পরিচয় না পাবার গোপন দহন, দুঃখ, ব্যথা ম্লান হয়ে গেছে যখন সহোদর আল-আমিন রহমান ছাত্রলীগের সবশেষ সোহাগ-জাকির কমিটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১নং ইউনিটখ্যাত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিল । ছাত্রলীগের বর্তমান সুযোগ্য সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন যার মেধাদীপ্ত উজ্জ্বল পরিছন্ন পরিশ্রমী ভাবমূর্তির জন্য ইতোমধ্যে নেত্রী ও সারাদেশে কর্মীদের আস্থা ও প্রিয়ভাজন হিসেবে সুপরিচিতি লাভ করেছেন সেদিন নেতা নির্বাচনে তাঁর বিচক্ষণতা, সুবিবেচনা ও নিবেদিতপ্রাণ কর্মী মূল্যায়নের কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি । তাঁর হাত ধরে ধানমণ্ডি বত্রিশে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানিয়ে ফেরার পর অভিনন্দন বার্তায় অনুজকে লিখেছিলাম, ঢাকা শহরে প্রথম ঘুরতে এসে কৈশোর উত্তীর্ণ তরুণ আমি প্রথম যে জায়গায় যাই সেটা ছিল ধানমন্ডি বত্রিশ নাম্বার । মানুষের এতো পদচারণা ছিল না সেদিন। কেমন নীরব ও নির্জন দেখেছিলাম বত্রিশ নম্বরের চারপাশ।

বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে নীরবে শ্রদ্ধা জানিয়ে দেখতে গিয়েছিলাম স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় । আজ চোখ অশ্রুসজল । আনন্দে, গর্বে । সুদূর ছাতকের প্রত্যন্ত এক গ্রাম থেকে বত্রিশ নাম্বারে এ আনুষ্ঠানিক যাত্রা বহু কষ্টের, বহু বেদনা ও আত্মত্যাগের । জাতির শ্রেষ্ঠ নেতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও আমার দুঃখভারাক্রান্ত পিতার অনেক ত্যাগ মিশে আছে তাতে। এর মূল্য দিস। মনে রাখিস। কখনো কোন হীন কাজের দ্বারা এ অর্জন ও পরিচয় যেন ম্লান না হয়। মনে রাখিস, এই দেশ, মাটি ও মানুষের জন্য আত্মোৎসর্গের রক্তস্রোতে লাল হয়ে থাকা ধানমন্ডি বত্রিশ নাম্বারে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে এই শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ রাজনৈতিক আনুষ্ঠানিক অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্তকরণ মাত্র। বিজয়ের মাসে এই অঙ্গীকার বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশের সুমহান স্বপ্ন, বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও আস্থার প্রতি আমৃত্যু অবিচল থাকার অঙ্গীকার । কোনদিন যেন এর ব্যত্যয় না ঘটে।

শুক্রবার আনুষ্ঠানিকভাবে ছাত্রলীগের কার্য নির্বাহী কমিটির এক বিশেষ বর্ধিত সভায় নেত্রীর নির্দেশে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছাত্রলীগের সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করেছেন । আগামী সম্মেলনে যে বা যারা ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আসবে তাদের অন্তরে, বিশ্বাসে যেন বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ, পৃথিবীর বুকে জঙ্গীমুক্ত প্রগতিশীল আত্মমর্যাদাসম্পন্ন উন্নত একটি রাষ্ট্র বিনির্মাণে দেশরত্ন শেখ হাসিনার স্বপ্ন ও বিশাল কর্মযজ্ঞে আপসহীন থাকে । বিনিদ্র থাকে । কোন অন্ধকার যেন শেখ হাসিনার স্বপ্ন ও কর্মযাত্রায় বাঁধা ও প্রতিবন্ধকতার প্রাচীর না তুলতে পারে। আগামী সম্মেলনের মধ্য দিয়ে যে বা যারাই নেতৃত্বে আসুক তাদের, তাঁর পরিবারের মানুষের দুর্দিনে দলের প্রতি আনুগত্য ও ভূমিকা যেন বিবেচনায় আনা হয়, মূল্যায়ন করা হয় । আমার বা আমাদের মত কেউ যেন অকালে তাঁর স্বপ্ন ও সম্ভাবনা থেকে হারিয়ে না যায়।

ভালোবেসে তবু জেনেছি শুধু নেতা নয়, কর্মী হওয়াও গৌরবের। সর্বোপরি, এদেশের বুকে ওয়ান ইলেভেনের অন্ধকার যেন আর ফিরে না আসে । জননেত্রী , বাংলাদেশের বর্তমান ও অনাগত স্বপ্ন ও সম্ভাবনার কাণ্ডারী-আপনি ভালো থাকুন । আপনার জন্য আমাদের বুকের ভেতর নিঃস্বার্থ, নিঃশর্ত ভালোবাসা থাকবে চিরকাল।

লেখক : গণতন্ত্র ও শেখ হাসিনা মুক্তি আন্দোলনের একজন কর্মী।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত