মো. আব্দুল আজিজ

২১ ফেব্রুয়ারি , ২০১৮ ০২:১৮

সিলেটে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। কিন্তু সে রাষ্ট্রের জন্মের পূর্ব থেকেই এর রাষ্ট্রভাষা কী হবে তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। তৎকালীন মুসলিম লীগের নেতৃত্বে যারা আসীন ছিলেন তারা ছিলেন উর্দুভাষী। তাদের অভিমত ছিলো পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। অপরপক্ষে দেশের পূর্বাঞ্চলে ছিলো অধিকাংশ লোকের বাস। এ অঞ্চলের বিদ্বজ্জন, ছাত্র সমাজ এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের বৃহদাংশ ছিলেন বাংলাকে পূর্বপাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে। এ নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক পাকিস্তান সৃষ্টির সাথেসাথেই জোরদার হয়ে ওঠে।

নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত কিছু পদক্ষেপ বিতর্ককে আন্দোলনমুখী করে তোলে। ১৯৪৭ সালের অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে দেশের ডাকটিকেট, এনভেলাপ, পোস্টকার্ড, মানিঅর্ডার ফরম, রেলের টিকেট, দেশের টাকা ইত্যাদি প্রকাশ করা হয়। এ সবের উপর ইংরেজির সাথে উর্দু ব্যবহৃত হয়। পাবলিক সার্ভিস কমিশন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য বিষয় তালিকা থেকেও বাংলাকে বাদ দিয়ে দেয়। এ ধরণের সরকারি পদক্ষেপ বাঙালি জনসাধারণের এবং বিশেষ করে দেশের মধ্যবিত্ত বিস্ময়, বেদনা ও অপমানবোধ জাগ্রত করে। ৫ ডিসেম্বর তারিখে করাচীতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে সুপারিশ করে। এ সংবাদ ঢাকায় পৌঁছালে ৬ ডিসেম্বর ঢাকায় ছাত্র বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয় এবং বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সর্বপ্রথম ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষা সম্মেলনের সুপারিশের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারীগণও সভা ও মিছিলের মাধ্যমে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন।

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে পরিষদের ভাষা হিসেবে ব্যবহার করার পক্ষে পূর্ববঙ্গের পরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কর্তৃক আনিত প্রস্তাব ২৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যগণ ছাড়াও কিছু বাঙালি সদস্যের বিরোধিতার মুখে বাতিল হয়ে গেল। এর প্রতিবাদে ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সর্বস্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয় এবং ২ মার্চ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের এক সভায় সারা প্রদেশে ১১ মার্চ ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ভাষার জন্য সংগ্রাম এবার সংগঠিত রূপ নিল।

দুই
সিলেটে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবি সর্বপ্রথম উত্থাপন করে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের মুখপত্র আল ইসলাহ। ১৯৪৭ সালের আগস্ট সংখ্যা আল ইসলাহ-এর সম্পাদকীয় স্তম্ভে মন্তব্য করা হয়- ‘বাংলার পরিবর্তে অন্য কোনো ভাষা আমাদের রাষ্ট্রভাষা হউক ইহা আমরা কখনো সমর্থন করিতে পারি না।’ এরপর সাহিত্য সংসদ নভেম্বর মাসের ৯, ৩০ ও ডিসেম্বর মাসের ২৮ তারিখ এ ব্যাপারে তিনটি সভার আয়োজন করে যাতে শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী, বহুভাষাবিদ পণ্ডিত ড. সৈয়দ মুজতবা আলী এবং সংসদের সাবেক সভাপতি ও দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ প্রবন্ধ উপস্থাপনার মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবির যৌক্তিকতা প্রদর্শন করেন। তখনকার প্রধান রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের অধিকাংশ নেতা কিন্তু উর্দুর সপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন।

১৯৪৮ সালের ১ জানুয়ারি সিলেট থেকে প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক নওবেলাল। এর প্রকাশক ছিলেন সাবেক আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক মাহমুদ আলী এবং সম্পাদক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ। দেশে বাংলা সমর্থক কোনো দৈনিক পত্রিকা না থাকায় সাপ্তাহিক নওবেলাল ভাষা আন্দোলনের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

১১ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকারের যোগাযোগমন্ত্রী সরদার আব্দুর রব সিলেট সফরে আসেন। তাঁর কাছে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবিতে সিলেট জেলা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি আব্দুস সামাদের নেতৃত্বে একটি ছাত্র প্রতিনিধিদল এবং মহিলা মুসলিম লীগের সভানেত্রী বেগম জোবেদা রহিমের নেতৃত্বে এক মহিলা প্রতিনিধি দল স্মারকলিপি প্রদান করে। সে বছর ২২ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে পূর্বপাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে জানিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী (তখনও মুখ্যমন্ত্রী চালু হয়নি) খাজা নাজিমুদ্দিনের নিকট স্মারকলিপি প্রেরণ করেন সিলেটের ১২জন মহিলা নেত্রী।

ডসলেট তমদ্দুন মজলিস ও মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের উদ্যোগে ৮ মার্চ সিলেট শহরস্থ গোবিন্দচরণ পার্কে ভাষার দাবিতে জনসভা আহ্বান করা হয়। নির্দিষ্ট দিনে সভা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম লীগের উগ্রপন্থি সন্ত্রাসীরা সে সভা ভণ্ডুল করে দেয় এবং ছাত্রকর্মী মকসুদ আহমদকে বেদম মারপিট করে ও অন্যতম উদ্যোক্তা হাবিবুর রহমানকে খুঁজতে থাকে। সভার সভাপতি মাহমুদ আলী ও উপস্থিত জনসাধারণের মধ্যে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, আব্দুস সামাদ, দেওয়ান ওহিদুর রেজা ও অন্যান্য ছাত্র নেতৃবৃন্দ ইটপাটকেল নিক্ষেপের ফলে আহত হন।

সিলেট জেলা মহিলা মুসলিম লীগ এ ঘটনার প্রতিবাদে ১০ মার্চ একই স্থানে একটি জনসভা আহ্বান করে। কিন্তু সভা আরম্ভ হওয়ার প্রাক্কালে গণ্ডগোলের অজুহাত তুলে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এক আদেশ জারি করে সমগ্র সিলেট জেলা উর্দু বাংলার প্রশ্নে সকল প্রকার সভা-শোভাযাত্রা দুই মাসের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।

এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে তমদ্দুন মজলিসের সম্পাদক দেওয়ান অহিদুর রেজা ও মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি মোহাম্মদ আব্দুস সামাদ ১১ মার্চ তারিখের নওবেলালে এক বিবৃতি প্রকাশ করেন। এছাড়া অ্যাডভোকেট আবু আহমদ আব্দুল হাফিজের নেতৃত্বে ১৮ জন বিশিষ্ট নাগরিকও একটি বিবৃতি প্রদান করেন। একই দিনে উর্দু সমর্থক আজমল আলী চৌধুরীও একটি বিবৃতি প্রচার করেন। এই ডামাডোলে সিলেটে ১১ মার্চের কর্মসূচি পালন করা সম্ভব হয় নি। কিন্তু ঢাকাসহ অন্যান্য স্থানে তা পালন করা হয়। সেদিন ঢাকায় পুলিশ লাঠিচার্জ করে এবং নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে। এরফলে আন্দোলন রুদ্ররূপ পরিগ্রহ করলে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের সাথে ৮ দফা সম্বলিত এক চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। চুক্তির শর্তানুসারে এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠেয় ব্যবস্থাপক সভার অধিবেশনে প্রদেশের সরকারি ভাষা হিসেবে ইংরেজি উঠে গেলে তৎস্থলে এবং শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি প্রদানের লক্ষে প্রস্তাব উত্থাপনের স্বীকৃতি দেয়া হয়।

১৯ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা আগমন করেন। তিনি ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের সভায় এবং ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সমাবর্তন সভায় একমাত্র উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে বলে ঘোষণা দেন। বিক্ষুব্ধ ছাত্রেরা না না বলে এর প্রতিবাদ জানায়। কিন্তু এরপর কার্যত ভাষা আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে।

তিন
দ্বিতীয় দফায় আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ গ্রহণ করে ১৯৫২ সালে। ইতোমধ্যে দেশের আর্থ সামাজিক ব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। ৪৮’এর পর দেশে যেমন সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধ করা হয়েছে, অনুষ্ঠিত হয়েছে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্মেলন, গঠিত হয়েছে প্রগতিশীল ধ্যান-ধারণামূলক যুব ও ছাত্র সংগঠন সমূহ। এসব কিছুই মুসলিম লীগের প্রতি মোহভঙ্গ ঘটাতে ও বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার পক্ষে জনমত সৃষ্টির ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে। এদিকে কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক আরবি হরফে বাংলা লেখার উদ্যোগ ও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাঙালিদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার নানা অপচেষ্টাও সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয়। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার আন্দোলন ফল্গুধারার মতো বহমান থাকলেও ক্রমশ সে স্রোতে গতিবেগ সঞ্চারিত হতে থাকে।

১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে মুসলিম লীগ কর্তৃক আয়োজিত এক সভায় তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে বলে ঘোষণা দিলেন। তিনি প্রতিশ্রুতির কথা বেমালুম ভুলে গেলেন। নাজিমুদ্দিনের এ ঘোষণা ভাষা আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গেলো।

নাজিমুদ্দিনের এ ঘোষণার প্রতিবাদে ১৯৫০ সালে গঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে ছাত্র ধর্মঘট, সভা ও শোভাযাত্রা এবং ২১ ফেব্রুয়ারি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ ধর্মঘট, সভা ও বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি গ্রহণ করে। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম, পরিষদ ছাত্রদের কর্মসূচির প্রতি সমর্থন জানায়।

১২ ফেব্রুয়ারি ‘ছদ্ম ফ্যাসিজম’ শিরোনামে সম্পাদকীয় প্রকাশের অজুহাতে ভাষা আন্দোলন সমর্থক ইংরেজি পত্রিকা ‘পাকিস্তান অবজারভার’ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

২০ ফেব্রুয়ারি এক সরকারি ঘোষণায় ওই দিন থেকে এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে সভা-শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করা হয়। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এক সভায় মিলিত হয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ছাত্র প্রতিনিধিদের নিকট এ সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমতলায় গাজীউল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১০ জনের এক একটি দল করে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই স্লোগান দিয়ে বেরিয়ে যেতে শুরু করলে পুলিশ প্রথমে গ্রেফতার ও পরে লাঠিচার্জ করে। অনেকেই আহত হন। বেলা ৩টার দিকে পুলিশ মেডিকেল কলেজ ব্যারাকের ভেতর আকস্মিকভাবে গুলি বর্ষণ শুরু করে। পুলিশের গুলিতে তাৎক্ষনিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবুল বরকত নিহত হন। আরও আহত হন জব্বার, রফিক ও সালামসহ নেকেই। আহতদের মধ্যে রাতে আরও ৩ জন মারা যান বলে জানা যায়।

২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলি বর্ষণের ঘটনার পরদিন থেকে ঢাকা রূপান্তরিত হয় মিছিলের নগরীতে এবং এ সংবাদ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।

চার
ঢাকার সংবাদ সে রাতেই সিলেটে পৌঁছে। ঢাকার গুলি বর্ষণের প্রতিবাদে মুসলিম লীগ নেতা মাহমুদ আলী, এ জেড আব্দুল্লা, মতছির আলী ও আব্দুর রহিম (লাল বারী) মুসলিম লীগের সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ২২ ফেব্রুয়ারি লো ১০টায় সিলেট রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ এক জরুরী সভায় শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য বিকালে জনসভা ও শোভাযাত্রার কর্মসূচী গ্রহণ করে। সিলেট মার্চেন্ট এসোসিয়েশন সেদিন হরতাল পালন করে।

বেলা তিনটায় শহরের গোবিন্দচরণ পার্কে জনসাধারণ দলে দলে জনসভায় যোগদান করে। উকিল আব্দুল্লা বিএলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় পরদিন পূর্ণ হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত হয়। মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি দেওয়ান তৈমুর রাজার পদত্যাগের দাবি নিয়ে এক প্রতিনিধি দল তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করে। পরে রাত ৮ টা পর্যন্ত দীর্ঘ শোভাযাত্রা গোটা শহর প্রদক্ষিণ করে।

২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্রীদের অংশগ্রহণে বেলা ১১টায় বিরাট শোভাযাত্রা শহর প্রদক্ষিণ করে গোবিন্দচরণ পার্কে সভায় মিলিত হয়। সভায় বেগম হাজেরা মাহমুদ ঢাকায় নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালানোর নিন্দা ও অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবি জানিয়ে জ্বালাময়ী বক্তৃতা করেন। বিকাল ৪টায় একই স্থানে আরেকটি জনসভা এবং বিকেলে জিন্নাহ হলে (সুলেমান হল) মহিলাদের একটি প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এভাবে প্রায় প্রতিদিনই মিলি ও জনসভা চলতে থাকে। স্কুল-কলেজে চলে ধর্মঘট। এ পর্যায়ের শেষ সভাটি অনুষ্ঠিত হয় ৫ মার্চ বিকেলে গোবিন্দ চরণ পার্কে। সভাপতিত্ব করেন অ্যাডভোকেট আবু আহমদ আব্দুল হাফিজ। বক্তৃতা করেন নওবেলাল সম্পাদক মাহমুদ আলী, মওলানা সখাওতুল আম্বিয়া, মোক্তার বারের দবির উদ্দিন আহমদ চৌধুরী, প্রাক্তন ছাত্র নেতা মোয়াজ্জম আহমদ চৌধুরী, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা তেরা মিয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবুল মাল আবদুল মুহিত, রিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন নেতা মতছির আলী এবং আওয়ামী লীগ সেক্রেটারি আব্দুল বারী (ধলা বারী)। উল্লেখ্য, এই বারীই আট চল্লিশ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে অনুষ্ঠিত সভা ভণ্ডুল করে দিয়েছিলেন।

সেদিনের জনসভার মধ্যদিয়ে বাস্তবে ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ের অবসান ঘটে। ঢাকার কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের গ্রেফতার ও জাস্টিস এলিসের নেতৃত্বে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের ফলে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে।

ভাষা আন্দোলন শুধু সিলেট শহরেই সীমাবদ্ধ ছিল না। মফঃস্বল অঞ্চল ও মহকুমা পর্যায়েও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। বিভিন্ন স্থানে অনেকেই জেল জুলুমের শিকার হয়েছিলেন। তাদের এ আত্মত্যাগ বিফলে যায় নি।

১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর সাধারণ সভার ৩৯ তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

  • মো. আব্দুল আজিজ : ভাষাসৈনিক, ইমেরিটাস অধ্যাপক, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি, সিলেট।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত