হাবিব উল্লাহ মিছবাহ

২১ ফেব্রুয়ারি , ২০১৮ ১৬:১১

প্রেরণা আর অহংকারের একুশ

একটি সংগ্রামী জাতি হিসাবে আমরা বিশ্বব্যাপী খ্যাতি ও পরিচিতি লাভ করেছি ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। আমরা বাঙালিরাই একমাত্র জাতি যারা ভাষার জন্য যুদ্ধ করেছি। এই যুদ্ধ ছিল আমাদের আত্মসম্মান বাঁচানোর জন্য। একটি জাতির গৌরব ও সংস্কৃতির মান সম্পর্কে জানা যায় তার দেশের মায়ের ভাষা মাতৃভাষার মাধ্যমে। কিন্তু এই গৌরব অর্জনের পথটি এতো সহজ ছিল না। এর জন্য আমাদের অনেক প্রাণ দিতে হয়েছিল।

১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হয়ে ভারতবর্ষ থেকে পৃথক হয়ে আমরা বাঙালি পাকিস্তানিদের সাথে চলে আসি। তখন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান দুটি পৃথক নাম রাখা হয়। পূর্ব পাকিস্তান তথা (বাঙালিরা) তখন সব দিক দিয়েই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের দ্বারা নির্যাতিত হতে লাগল। পূর্ব পাকিস্তান ছিল তাদের জন্য খেলার পুতুল।

বাঙালির উপর প্রথম আঘাত আনা হয়েছিল আমাদের মায়ের ভাষার উপর। যে ভাষা দিয়ে আমরা মনে সকল কথা অন্যের নিকট বুঝিয়ে বলি, সেই ভাষার উপর আঘাত এনেছিল পশ্চিম পাকিস্তানি। আমাদের পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যার দিক থেকে বেশি থাকার পরে ও তারা (পশ্চিম পাকিস্তানি) আমাদেরকে আক্রমণ করতে ভয় করেনি। আমি মনে করি তারা ভয় না পাওয়াতেই আমরা সফল হতে পেরেছি। আমরা আমাদের নিজের মতো করে ভাষা ব্যবহার করার অধিকার অর্জন করতে পেরেছি। আমাদের এই বাংলাদেশই একমাত্র রাষ্ট্র যারা ভাষার জন্য বুকের তাজা রক্ত দিয়ে রাস্তা লাল করেছি। এটি আমাদের অহংকার,আমাদের গর্বের, আমাদের বাংলার জন্য এক বিশাল ইতিহাস।

১৯৪৮ সালের ২ মার্চ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ রেসকোর্স ময়দানে তার ভাষণে যখন উচ্চ স্বরে বলেন, উর্দু এবং উর্দুই হবে পূর্ব পাকিস্তানের মাতৃভাষা তখন সাথে সাথে তার এই ভাষণের প্রতিবাদ করে তৎকালীন সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আমাদের ছাত্র ভাইয়েরা। আবার যখন ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিম উদ্দিন উচ্চ স্বরে উচ্চারণ করেন, উর্দুই হবে পূর্ব তথা সারা পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা। এর প্রতিবাদে ঢাবি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ছাত্র ধর্মঘট আহ্বান করে। সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল ভাষার জন্য যুদ্ধ যার হাত ধরেই আমরা অর্জন করি ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি।

১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সরকারের ১৪৪ দ্বারা উপেক্ষা করে, এমন একটি সুন্দর দিনের জন্য শরীরের তাজা রক্ত রাস্তায় বিলিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের প্রিয় সালাম, রফিক, জব্বার এবং নাম না জানা আরও অনেক ভাই। তাদের এই বিশাল ত্যাগের জন্যই আমাদের এই অহংকারের ২১ তারিখ।

১৯৫২ সালের একুশের চেতনায় উজ্জীবিত হয়েই আমরা আমাদের ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে জয় লাভ করতে সক্ষমতা অর্জন করি। ২১ আমাদের চেতনায়, আমাদের মনে সব সময় লালন করেই আমাদের এই সব অর্জন।

২১ ফেব্রুয়ারি একটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। যা ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃত হয়েছে। এর ফলে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার সম্মান আগের চেয়ে আর অনেক বৃদ্ধি পায় সারা বিশ্বে। ভাষা ব্যবহারের সংখ্যার দিক দিয়ে বাংলার অবস্থান সারা বিশ্বের মধ্যে সপ্তম। ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃতির আরও অনেক আগে মাতৃভাষা বাংলার পরিচয় বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছিলেন ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার জয়ী আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার পরে ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দেন আমাদের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান।

ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! ভাষার জন্য যে জাতি বুকের রক্ত দিয়েছে আজ সে জাতি নিজের সুযোগের জন্য অন্য ভাষার পিছনে ছুটে নিজের মায়ের ভাষা ভুলে যাচ্ছি। অন্যের ভাষা শত কষ্ট করে শিখেও যে কিছু করা যায় না, সেটির বাস্তব প্রমাণ আমাদের মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ইংরেজি ভাষার কবি হওয়ার জন্য মধুসূদন নিজের ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি ব্যর্থ হয়ে এই বাংলায় চলে আসেন এবং বাংলার রূপে তিনি আনন্দিত অনুভব করেন। তখন তিনি এই বাংলাকে নিয়ে অনেক কিছু রচনা করেন।

বাংলা তখন তার নিকট হয়ে যায় একটি আদর্শের স্থান। যাকে গিরেই ছিল তার স্বপ্ন।

আমাদের সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে বলা আছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার সর্বস্তরে বাংলা ভাষা তার যে স্বীয় মর্যাদায় আসীন এ কথা বলা যাবে না। দেশের সকল উচ্চ পর্যায়ে, সকল স্তরে বাংলার সহজ ব্যবহার খুঁজে বাহির করা যাবে না। দেশের সকল প্রাইভেটে বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা নিয়ে কেউ পড়তে আগ্রহী হয় না। বাংলা ভাষা শিক্ষা এখন আর আমাদের তেমন বেশি কাছে টানে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকেই নিরুপায় হয়ে বাংলা নিয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেন।

আজ দেশের অধিকাংশ মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে মেয়েরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করে। মায়ের ভাষা মাতৃভাষার মর্যাদা তাদের নিকট নেই বললেই চলে। নিজের সুখের জন্য আজ আমরা অনেকই আমাদের গর্বের ইতিহাস থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। যে বাংলা আমাদের মহান করেছে বহির্বিশ্বের কাছে, আজ সেই বাংলার ধারে কাছে মাত্র সামান্য মানুষ। আজ যারা সেই স্মৃতি ধরে রেখেছে তারাই আমাদের জন্য অহংকার।

ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা। এই ভাষা শিখা নিয়ে আমার কোনো দ্বিমত নেই। একজন উচ্চ শিক্ষিত লোক যদি ইংরেজি না জানে তবে এটি তার সম্মানে বাধে, তবে উচ্চ শিক্ষিত হওয়ার পরেও যদি শুদ্ধ ভাবে বাংলায় কথা না বলতে পারে তবে সেটিতে কোনো বাধা পড়ে না। বর্তমান এই বিশ্বায়নের যুগে আমাদের বিশ্বের সাথে যোগাযোগ করার জন্য ইংরেজি জানতে হবে, তাই বলে নিজের মাতৃভাষাকে অবহেলা করেই কেন করতে হবে। বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা, সম্মানের ভাষা, আমাদের অহংকারের ভাষা।

আমাদের নিজেদের ভাষা নিয়ে এই যে প্রবণতা এর জন্য দায়ী আমরা সবাই। জ্ঞান, বিজ্ঞান চর্চা এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগের জন্য ইংরেজি জানা আমাদের প্রয়োজন। তাই বলে নিজের ভাষা ভুলে গিয়ে এটি হতে দেওয়া যায় না। মাতৃভাষাকে নিয়ে এই যে প্রবণতা এটি আমাদের শিক্ষিত সমাজের মধ্যেই বেশি। গ্রামের নিরন্ন সাধারণ মানুষেরা নিজের মাতৃভাষার অবমাননা না করেই জন জীবনের শক্তি হিসাবে ধরে রেখেছেন। গ্রামের সাধারণ মানুষের মনে উচ্চ শিক্ষিত মানুষের মতো উচ্চ আশা নেই, শিক্ষিত মানুষের মতো তারা নিজের সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যেতে চান না। এই না চাওয়ার মাঝেই তারা সুখি।

ভাষার এই মাসে আমাদের উচিত আমাদের মাতৃভাষার মর্যাদা আরও বৃদ্ধি করা এবং সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগ আরও নিশ্চিত করা। তবেই আমাদের ভাষা শহীদের আত্মায় শান্তি আসবে। তবেই তাদের সকল ত্যাগ সফল হবে।

  • হাবিব উল্লাহ মিছবাহ: শিক্ষার্থী, মদন মোহন কলেজ, সিলেট।
  • [প্রকাশিত লেখায় মন্তব্য, মতামত, দায় লেখকের নিজস্ব]

আপনার মন্তব্য

আলোচিত