ড. সাইদুর চৌধুরী সাহেদ

২৫ ফেব্রুয়ারি , ২০১৮ ০০:৩৪

অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং মরণব্যাধি ক্যান্সার

হঠাৎ করে আসা আমারই শৈশব কৈশোরের স্মৃতি বিজড়িত সিলেট শহরে। বিকেল বেলা রিকশা দিয়ে শহরের বিভিন্ন প্রান্তর ঘুরে বেড়ানোর সময় চোখে পড়ল শহরের বিভিন্ন ধরনের অপরিকল্পিত কাঠামোগত উন্নয়ন। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাতে বসতবাড়ির সাথে সাথে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের কমার্শিয়াল এলাকা, সাথে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ওয়ার্কশপ, ওয়ার হাউজ (Ware houses), ক্যামিকেল ষ্টোর সেন্টার, গ্যারেজ, পরিত্যক্ত পেট্রোল পাম্প, তৈলের ট্যাংক, প্রিন্টিং সেন্টার, কার ওয়াসিং সেন্টার এবং বিভিন্ন ধরনের মেশিন মেরামত কারখানা। আর ও রয়েছে ড্রাই ক্লিনিং অর লন্ড্রি। এসব সেন্টারে বিভিন্ন ধরনের রসায়নিক জৈব তেল, স্প্রে এবং গ্যাসলিন ব্যবহার করা হয়। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে এ ধরনের রসায়নিক পদার্থের ব্যবহার খুবই নিয়মতাত্ত্বিক উপায়ে পরিচালনা করা হয়। কারণ এদের বেশীর ভাগই কোন না কোনভাবে মানবদেহে মরণব্যাধি ক্যান্সার রোগ সৃষ্টি করে - যদি তা অনিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবহার করা হয়।

২.
বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক উপাদানের মধ্যে পেট্রোলিয়াম হাইড্রোকার্বণ (PHCs), পলিসাইক্লিক এরোমেটিক হাইড্রোকার্বণ (PAHs), ভল্যাটাইল ওরগ্যানিং কম্পাউন্ড (VOCs), পলি-ক্লোরিনেটেড বাইফিনাইল ((PCBs), ইনওরগ্যানিং এবং মেটাল, সলভেন্ট (Solvents)  এবং Pesticides মানবদেহে মরণব্যাধি ক্যান্সারের জন্যে দায়ী। এসব রাসায়নিক তরল উপাদান দিয়ে বিভিন্ন ধরনের গ্যাসলিন এবং স্প্রে তৈরী করা হয়। এগুলো পরিবেশে অনেকদিন অপরিবর্তিত অবস্থায় থাকতে পারে যা মানবদেহের সংস্পর্শে আসলে ক্যান্সার রোগের সৃষ্টি করে।

৩.
 যেসব রাসায়নিক কম্পাউন্ড/উপাদান মানবদেহে ক্যান্সার রোগ সৃষ্টি করে, ঐসব রাসায়নিক উপাদানগুলোকে কারসিনজেনিক (Carcinogenic) বলা হয়। এসব রাসায়নিক উপাদান মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে মানবদেহে প্রবেশ করলে দেহের সাধারণ কোষের কার্য বাধাগ্রস্ত হয়। অনিয়ন্ত্রিত কোষের বৃদ্ধির জন্য দেহের মধ্যে বিভিন্ন রকমের টিউমার (Tumor) সৃষ্টি হয় যা মরণব্যাধি ক্যান্সার সেল (Cell) দিয়ে তৈরী। কারসিনজেন কেমিক্যালগুলো বিভিন্ন উপায়ে মানবদেহে প্রবেশ করছে - যার মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাস, চর্ম সংস্পর্শ এবং মুখ (খাদ্যনালী) হলো সহজ মাধ্যম।

৪। উন্নতবিশ্বে কোন আবাসিক, কমার্শিয়াল, স্কুল, পার্ক কিংবা বড় বড় অট্রালিকা স্থাপন করার পূর্বে ঐ এলাকার মাটি, গ্রাউন্ড ওয়াটার (Groundwater) বা পানিকে বিশদভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়। আশেপাশের এলাকাগুলোকেও ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয় যেন কোন কারসিনজেনিক (Carcinogen) কম্পাউন্ড এর উপস্থিতি রয়েছে কিনা। উন্নতবিশ্বে সাধারণত প্রপার্টি থেকে ২৫০ মিটার দূরত্বে কোন প্রকার ক্ষতিকর উপাদান রয়েছে কিনা তা বিশেষজ্ঞ দিয়ে পরীক্ষা করা হয়। যেসব পদ্ধতিতে এ পরীক্ষা নীরিক্ষা করা হয় তাকে সাইট এসেসমেন্ট (Site Assessment) বা সাইট রিমিডিয়েসন ইঞ্জিনিয়ারিং (Site Remediation Engineering) বলা হয়। যেসব এলাকাতে এ ধরনের কারসিনজেন কেমিক্যাল ষ্টোর করা হত বা হয় কিংবা বেশী পরিমাণে ব্যবহার করা হয় সে সব এলাকাকে (বহি:বিশ্বে বিশেষ করে কানাডা, যুক্তরাজ্য বা অন্যান্য উন্নত বিশ্বে Brown Field  বলে চিহ্নিত করা হয়। Brown Field এলাকাকে কোন আবাসিক বা কমার্শিয়াল এলাকাতে রূপান্তরিত করার আগে ভালভাবে ট্রিটমেন্ট (Treatment) করা হয়। সাধারণত এসব কেমিক্যালগুলোর বৈশিষ্ট্য দু’ধরনের। এদের মধ্যে যেগুলো পানির চেয়ে ঘনত্ব কম থাকে তাদেরকে NAPLs (Non Aqueous Phase Liquid) এবং যেগুলের ঘনত্ব পানির চেয়ে বেশী পরিমান থাকে তাকে DNAPLs (Dense Non Aqueous Phase Liquid) রাসায়নিক উপাদান বলা হয়। উঘঅচখং এবং ঘঅচখং রাসায়নিক উপাদান কারসিনজেন এবং এর ব্যবহার দৈনন্দিন কাজে বেশী। ক্লোরিনযুক্ত জৈব তেলগুলো (DNAPLs এবং NAPLs) যখন বিভিন্ন কারখানা, গ্যারেজ, কার ক্লিনিং সেন্টার, প্রিন্টিং সেন্টার, কেমিক্যাল ষ্টোর সেন্টার হতে বর্জ্র হিসাবে মাটিতে, খালে এবং বিভিন্ন ছোট বড় নালাতে অপরিকল্পিত ভাবে নিক্ষেপ করা হয় তখন এ দূষিত কেমিক্যালগুলো পানির সাথে মিশে অনেকদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। DNAPLs কেমিক্যালগুলোর ঘনত্ব বেশী হওয়ার কারণে তা মাটি ভেদ করে অনেক গভীর পর্যন্ত পৌছাতে সক্ষম। ঐ কেমিক্যালগুলো মাটির নীচে পানির স্তর (যা আমরা গ্রাউন্ড ওয়াটার বলে থাকি) এর মধ্যে প্রবেশ করে এবং  শত মাইল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে। DNAPLs কেমিক্যালগুলো হতে পারে বিভিন্ন ধরনের VOCs কম্পাউন্ড কিংবা PCBs  অথবা বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক সলভেন্ট (Solvents)।

৫.
USEPA (United State Of America-Environmental Protection Agency)  ও অন্যান্য রেগুলেটরী এজেন্সি মাটি পানিতে এসব কেমিক্যাগুলোর সহনীয় মাত্রার গাইডলাইন তৈরী করেছে। উন্নত বিশ্বে যেকোন ধরনের অবকাঠামো উন্নয়নে পানি এবং মাটিতে এসব রাসায়নিক উপাদানের মাত্রা নির্ণয় করা হয়। বিশেষ করে Brown Field  এলাকাতে যেকোন ধরনের উন্নয়নের আগে গাইডলাইন অনুযায়ী পরীক্ষা আবশ্যক। তা না হলে এসব এলাকার উন্নয়নের জন্য ছাড়পত্র - পরিবেশ মন্ত্রালয় কিংবা লোকাল গভর্নমেন্ট (Local Government) হতে পাওয়া দূষ্কর।

৬.
আমাদের দেশে আনাচে কানাছে ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল ষ্টোরেজ, গাড়ী মেরামত কারখানা কিংবা গ্যারেজ।  এসব প্রতিষ্ঠান হতে অপরিত্যক্ত বর্জ্র কেমিক্যালগুলো পরিবেশে নিক্ষেপ হচ্ছে কোন পরিকল্পনা ছাড়াই। আবার এসব এলাকাতে কোন পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়া তৈরী হচ্ছে বসতবাড়ী, বড় বড় অট্রালিকা, আন্ডার গ্রাইন্ড পাকিং (Under Ground Parking), স্কুল কিংবা শপিংমল। বিভিন্ন মাধ্যমে কোন কোন উপায়ে এসব কেমিক্যালগুলো মানব সংস্পর্শে আসছে এবং আমাদের দেহে প্রবেশ করছে। দেশে এখন ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা প্রচুর। শিশুদের মধ্যে ক্যান্সার রোগের প্রাদুর্ভাবও বেশী। কারসিনজেনিক কম্পাউন্ড এর মধ্যে VOCs গুলো সহজেই নি:শ্বাসের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে এবং ক্যান্সার রোগ সৃষ্টি করছে।

৭.
পরিত্যক্ত কিংবা বর্তমান গ্যাস ষ্টেশন (পেট্রোল পাম্প) এর আশেপাশে আবাসিক এলাকাগুলো বেশি করে ঝুঁকির সম্মুখীন। এসব এলাকার মাঠি ও গ্রাউন্ড ওয়াটারে PHCs ও VOCs রাসায়নিক জৈব উপাদান দিয়ে দূষিত হওয়ার প্রবনতা বেশী। মাটির নীচে পানির স্তরে এ জাতীয় কারসিনজেনিক তেল দিয়ে দূষিত হওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ। তাই কোন ধরনের অবকাঠামোগত উন্নয়নের আগে মাটিতে কিংবা পানিতে এধরনের কেমিক্যাল রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা দরকার। তা না হলে সুদূর ভবিষ্যতে মরণব্যাধি ক্যান্সার আমাদের সমাজে মহামারী আকারে দেখা দিতে পারে।

৮.
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শহরগুলোকে পরিবেশ বান্ধব ও পরিকল্পিত ভাবে গড়ে তোলা আমাদের দায়িত্ব। এর জন্য সরকারের সাথে সাথে জনসাধারনের এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। সরকারের উচিত এগুলোর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা। যেকোন ধরণের আবাসিক, কর্মাশিয়াল কিংবা স্কুল নির্মাণের আগে মাটি এবং পানিকে ভালোভাবে পরীক্ষা করার জন্য একটি রেগুলেশন (Regulation) বা আইন তৈরী করা। পরিবেশ মন্ত্রণালয় কিংবা লোকাল গভর্নমেন্ট (Local Government) এ ধরনের  রেগুলেশন সঠিকভাবে অনুসরন করা হচ্ছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করবে। এ ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন রেগুলেশন এজেন্সি কর্তৃক তৈরী সাইট ডেভেলমেন্ট প্রসিজিয়র (ঝSite Development Procedure) কে অনুসরন করা যেতে পারে। যেকোন পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পদ্ধতি ঐসব রেগুলেশনে এ পরিষ্কার ব্যাখ্যা করা হয়েছে। দেশের দক্ষ পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, পরিবেশ এবং জউলজীক্যাল ইঞ্জিনিয়ার রা (Environment & Geological Engineer) এ ধরনের কাজে নিয়োজিত হতে পারবেন। রেগুলেশন অনুযায়ী কারসিনজেনিক কম্পাউন্ড এর উপস্থিতি আছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে পারবেন। বসতবাড়ী কিংবা আবাসিক এলাকা তৈরী করার আগে নিশ্চিত হতে হবে যেকোন ধরণের কারসিনজেনিক কম্পাউন্ড এর উপস্তিতি আছে কিনা। যদি না থাকে তাহলে পরিবেশ মন্ত্রণালয় কিংবা লোকাল গভার্ণমেন্ট এর অনুমতি পাওয়া সম্ভব। আর যদি কোন ধরণের কারসিনজেনিক উপদানের উপস্থিতি পাওয়া যায় তা বিভিন্ন ট্রিটমেন্ট মেথড এ পরিষ্কার করতে হবে।

৯.
দেশে প্রায় ১৫ লক্ষের অধিক ক্যান্সার রোগী রয়েছে। প্রতি বছর প্রায় ১০০০ শিশু এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ক্যান্সার হতে রক্ষা করার জন্য আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। কারসিনজেনিক কম্পাউন্ড ব্যবহার করতে হবে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে। তা হলে মরনব্যাধি ক্যান্সার এর প্রকট হতে উত্তরণ সম্ভব। এ জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেও পদক্ষেপ নিতে হবে।

ড. সাইদুর চৌধুরী সাহেদ: সহকারী অধ্যাপক, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, প্রিন্স মো. বিন ফাহাদ বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত