অরুণ কুমার দাশ

২৭ ফেব্রুয়ারি , ২০১৮ ১৪:০৪

মৌলভীবাজারে বসন্ত উৎসব এবং একটি পর্যালোচনা

আগুন রাঙা ফাগুনের এই দিনে মানুষের মনে ভালবাসার আবির ছড়িয়ে দিতে এলো বসন্ত। বসন্ত মানে পূর্ণতা, বসন্ত মানে নতুন কলরব, ফুলের বুকে প্রজাপতির উড়াউড়ি, বসন্ত মানে ফাগুন হাওয়ায় ফুলেল অনুভূতি।

কবিদের সবচেয়ে পছন্দের ঋতু হচ্ছে বসন্ত ,তাই বিভিন্নভাবে কবিদের বন্দনায় এসেছে ঋতুরাজকবিগুরু লিখেছেন, "আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে, তব অবগুন্ঠিত কুন্ঠিতজীবনে কোরো না বিড়ম্বিত তারে " কিংবা "একফাগুনের গান সে আমার আর ফাগুনের কূলে কূলে, কার খোঁজে আজ পথ হারালো নতুন কালের ফুলেফুলে ।"

আরেক জায়গায় লিখেছেন "ফুলের বনে যার পাশে যাই তারেই লাগে ভালো"। কবি সুভাষমুখোপাধ্যায় লিখেছেন "ফুল ফুটুক নাই ফুটুক আজ বসন্ত!" বসন্তে কচি পাতার সমারোহে ছেয়ে যায় চারিদিক, ফুলের সমারোহ মানুষকে আন্দোলিত করে নতুন ভালবাসায়, শিমুলবন যেন আগুনরাঙা, মানুষের মনেও তেমনি নতুন নতুন স্বপ্ন, ভালবাসা দোলা দেয়।

তেমনি বসন্ত ভাবনায় জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ, মৌলভীবাজার শাখা আয়োজন করেছিল বসন্ত উৎসবের। সংগঠনের একজন সদস্য হিসেবে ছিলাম এই আনন্দযজ্ঞে।

শুরু থেকে শেষের কিছু মুহূর্তের স্মৃতিচারণ করছি এখানে। বসন্ত বন্দনায় কবির বাণী, "বসন্তে ফুল গাঁথলআমার জয়ের মালা"। আসলেই যেন ফুলের মালা গাঁথা হলো, প্রায় ১০-১২ দিনের রিহার্সাল। আজ শিল্পকলা তো কাল শিশুএকাডেমী না হয় ক্লাব, এই তিনটি স্থান ছাড়াও শাহাদাত ভাইয়ের বাসা, আমাদের বাসা, বাসার ছাদসব মিলিয়ে ছন্দে ছন্দে যেন রিহার্সাল চলছিল। মাঝে মাঝে হারমোনিয়াম নিয়ে যাওয়া রিহার্সালে কারো ভুল হলে মজা করে হাসাহাসি। বিহুরে লগন কিংবা পিন্দারে পলাশের বন গানের মধুর স্মৃতি মনেগেঁথে আছে।

রিহার্সালের মাঝেই আমাদের বিবাহবার্ষিকী এবং মহাদেব এর জন্মদিন পালন আরো স্মরণীয় করেছে আমাদের প্রতিটি মুহূর্ত। এসব হয়তো সবাই মনে রাখবেনা কিন্তু আমরা যারা মঞ্চে ছিলাম তাদের জন্য এই ঘটনাগুলো খুবইআনন্দদায়ক তাই স্মৃতিতে রেখে দিলাম।

এসব লিখার পেছনে অন্য একটা কারণও আছে, আমরা যখন দর্শক থাকি তখন মঞ্চে যারা পরিবেশনা করেন তাদের পরিবেশনার পেছনে কি পরিমাণ শ্রম এবং সময় দিতে হয় তা হয়তো চিন্তা করিনা, এই চিন্তা নাকরাটাই দর্শকদের আনন্দ দেয় বেশি। কিন্তু মঞ্চে বসে যতক্ষণ পর্যন্ত অনুষ্ঠান শেষ না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের টেনশন কিন্তু দূর হয়না।

অনুষ্ঠান চলাকালে সমীরণদা মঞ্চের নীচে গিয়েছিলেন এসে বললেন জরিপ করে চলে এসেছি, দর্শক প্রশংসা করছে চালিয়ে যাও, রণধীর কাকু কয়েকবার মঞ্চের পেছনে এসে বললেন "খুব ভালো হচ্ছে, দর্শকরা প্রশংসা করছে, শেষ পর্যন্ত ধারাবাহিকতা রেখে যাও"।

এসব শুনে মঞ্চের সবাই আমরা অনুপ্রাণিত হলাম। এই টেনশনের জন্যই মঞ্চে আমার গান গাইতে ভাল লাগে না। আমি বন্ধুদের আড্ডায়, বাসায় একান্তে যখন গান করি এই গানই আমার প্রাণ, সাবলীল এই গানই আমার বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা। প্রথম দিনের গান নির্বাচন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত পরিষদের সবাই সমানভাবে কাজ করে গিয়েছি, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্ঠায় এই অনুষ্ঠান।

রিহার্সাল পরিচালনার দায়িত্বে ছিল পুনম, সহযোগিতায় ছিল অনিমেষ, উপমা, পিয়া, রিপন, শুভ্র, মহাদেব, অঞ্জন, বাপন, কাব্য, দিব্য, সুমিত, রীমা, সীমা, মৌসুমী, মনীষা, অরুণ। সবার সহযোগিতায় অনুষ্ঠানের স্ক্রিপ্ট করেছিলাম আমি।

অনুষ্ঠানের সবচেয়ে আনন্দের ছিল রিহার্সালের প্রথমদিন থেকেই রণধীর কাকুর (বাবু রণধীর রায়, সহ সভাপতি)অভিভাবকের মতো অংশগ্রহণ। অনুষ্ঠানের নেপথ্যের কারিগর ছিলেন জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সভাপতি এডভোকেট সমর কান্তি দাস চৌধুরী, সহসভাপতি সৈয়দ আবদুল মোত্তালেব রঞ্জু , সম্পাদক জনাব সৈয়দ সলমান আলী, কামাল ভাই (হাসনাত কামাল), রিমন ভাই ( সৈয়দ মুনিম আহমদ) এবং পরিষদের অন্যান্য সদস্যবৃন্দ এবং শাহাদাৎ ভাই (মো: শাহাদাৎ হোসাইন)। শাহাদাৎ ভাইয়ের নাম পরে লিখলাম এ জন্য যে, উনার অনুপ্রেরণা নিয়েই আমরা মঞ্চে যারা ছিলাম তারা এই অনুষ্ঠান করতে পেরেছিলাম, শুরু থেকে উনি যেভাবে সমর্থন দিয়েছেন ধন্যবাদ দিলেও কম হবে। প্রাণের সংগঠন এভাবেই উনাদের হাত ধরে এগিয়ে যাক এই কামনা করি।

অসাধারণ মঞ্চটির পরিকল্পনা ও সাজসজ্জায় ছিল মহাদেব। অনুষ্ঠান শুরুর মুহূর্তে পরিষদের সভাপতি সমরকান্তি দাস চৌধুরী, সম্পাদক সৈয়দ সলমান আলী, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী ছায়া রায়, নাট্যকার আব্দুল মতিন, মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ফজলুল আলী স্যার এবং প্রধান অতিথি শহরের অভিভাবক সৈয়দা সায়রা মহসিন, এমপি মহোদয় এর শুভেচ্ছা বক্তব্য অনুষ্ঠানের সৌন্দর্য্য অনেকগুণ বাড়িয়েছিল।

মঞ্চে পরিবেশনায় ইপা বড়ুয়ার "আমি কান পেতে রই" সুরের মূর্ছনায় হারিয়েছিলাম আমরা। রণধীর কাকু গাইলেন দুটিগান, তাঁর দরাজ কন্ঠ সবাইকে মাতিয়ে রেখেছিল। আমি আর অঞ্জন গাইলাম অল্পশ্রুত একটি গান, "পরবাসী, চলে এসো ঘরে", পিয়া গাইলো "যদি তারেনাই চিনি গো"। উপমাকে আমি রবীন্দ্রকন্যা বলি। সে রবীন্দ্র খুব ভালো গায় তাই এই নাম দেওয়া। সে তার মিষ্টি কন্ঠে গাইলো "নীল দিগন্তে"।

পুনমকে অলরাউন্ডার বললেও কম হবে, রাস যখন গাইছিল তখন অনেকেই পুনমের মাঝে অদিতি মুন্সীর ছায়া মঞ্চে দেখেছিলেন, এরপর একক গাইলো " হৃদয়ের একূল ওকূল"। শুভ্র গাইলো, "তুমিযে সুরের আগুন" আর বাপন গাইলো "ভালবেসেসখি"। শ্রদ্ধেয়া শীলা মাসীর (শীলা তালুকদার) "বসন্তভাবনা" কিছুক্ষণ দর্শকদের মাতিয়ে রেখেছিল কন্ঠের মাধুর্যে ।

রবীন্দ্র-নজরুল পছন্দ করেন আর কেয়া'দি(অপরাজিতা রায়) এবং মাধুরী'দি (মাধুরী রায়)কে চিনে না এ শহরে এরকম মানুষ নাই বললেই চলে। পরপর দুইটি গান গাইলেন কেয়াদি দর্শকদের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত "পরদেশী মেঘ" গানটিও গাইতেহলো, মাধুরীদি গাইলেন " সখি ভাবনা কাহারে বলে" এবং " আহা আজি এ বসন্তে"। রীমা এবংসীমা দ্বৈত কন্ঠে গাইলো "আহা আজি এ বসন্তে"।সুমিত গাইলো "ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে"।

এসময় দর্শকসারিতে শাহাদাৎ ভাই আর মহাদেবের উচ্ছ্বাস দেখেই আমরা বুঝে গেছিলাম সুমিত কেমন গাইছে? অনুষ্ঠানের মাঝামাঝি যখন ইপা'দি এসে বললেন"এই তোমাদের অনুষ্ঠান খুবই ভাল হচ্ছে"। এরকম প্রশংসা সবাই করতে পারে না, দিদির জন্য অফুরান ভালবাসা রইলো। রিপন গাইলো "আলো আমার আলো" ভরাট কন্ঠে মাঠ গমগম করছিল। জীবনের প্রথম মঞ্চে একক গাওয়া, টেনশন আর ভাললাগা দুটোই ছিল মৌসুমীর, সে গেয়েছে "কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া"। রিমন ভাই গাইলেন "আমি চিনি গো চিনি" এবং"পুরানো সেই দিনের কথা" দর্শকরা ও কন্ঠ মিলিয়েছিলেন। তবলায় ছিলেন সমীরণ দা। আর হাসানের কথা না বললেই নয়। আসলেই এতো ভালো কীবোর্ড বাজায়, নতুন-পুরাতন সবাই গান গেয়ে স্বাচ্ছ্যন্দ। কিভাবে যেন গানের সৌন্দর্য্য বাড়িয়ে দেয়। অনিমেষের একক ও দ্বৈত গাওয়ার কথা ছিল। গলায় সমস্যা থাকায় আর গাইতে পারেনি। মনটা খারাপ ছিল এজন্য।

ঈশিতা যখন নাচছিল, এক মুগ্ধকর পরিবেশ সৃষ্টিহলো!! ছোটবোনটির জন্য এগিয়ে যাওয়ার শুভকামনা রইলো। শিল্পকলায় রিহার্সাল এ একদিন সবাই আমরা প্রীতমকে বলছিলাম যে নাচের রিহার্সাল দাও, সে বললো আমার রিহার্সাল লাগবেনা। পাশ থেকে আমি বললাম ওর নাচ মুখস্থ মনে হয়। প্রীতম চট করে রেগে গিয়ে বললো আমি মুখস্থ নাচিনা। আমি তো অবাক!! আমি তো জানতাম নাচতুলতে হয় আগে, তারপর মঞ্চে। প্রমাণ পেলাম ঈশিতার নাচের সময়। আমি জানতাম না যে নাচের শেষদিকে প্রীতম আসবে মঞ্চে, ঈশিতা যখন নাচছিল দর্শকের ২য় সারিতে বসে প্রীতম ইশিতার দিকেগভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছিল, অঞ্জন আমাকে ইশারা দিয়ে দেখালো প্রীতমকে। তখনো আমরা বুঝতে পারিনি কীজন্য সে এরকম করছে। তারপর ওযখন উঠলো তখন ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম, সেআসলে চরিত্রের ভেতর ঢুকে গিয়েছিল। আহাঃঅসাধারণ! নাচটা যে অন্তর থেকে নাচতে হয়, উপলব্দি করলাম। রাসনৃত্যের দ্বৈত পরিবেশনার মুগ্ধতা দর্শকরাও হাততালি দিয়ে জানান দিল।

এসব গানের পাশাপাশি কোরাস ছিল ছয়টি গান, অনুষ্ঠান শেষে প্রিয় সুপ্রিয়াদি উনার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হাত চাপড়িয়ে বললেন " তোদের অনুষ্ঠান খুব সুন্দর হয়েছে, খুব ভালো হয়েছে", অনেক ভালবাসা রইলো দিদি'র জন্য।

সবশেষে মাঠভর্তি দর্শকের সাথে অহংকারের জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে সমাপ্ত হলো আমাদের "বসন্ত উৎসব" বাংলা বর্ষপঞ্জির শেষ ঋতু বসন্তে বাঙালি হৃদয়উৎসবে মেতে উঠে। উচাটন হয়ে উঠে মন । পাখিরা প্রণয়ী খোঁজে, ঘর বাঁধে। মধুর খোঁজে মৌমাছি হন্যে হয়ে উঠে। সব মিলিয়ে ঋতুরাজ বসন্ত অনন্য।

লেখকঃ অরুণ কুমার দাশ, ব্যাংক কর্মকর্তা, সদস্য, জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ, মৌলভীবাজার। 

আপনার মন্তব্য

আলোচিত