চৈতী আহমেদ

০৫ মার্চ, ২০১৮ ১৭:৩৭

আমি জাফর ইকবাল স্যারের ভক্ত নই!

আমি জাফর ইকবাল স্যারের ভক্ত নই। জাফর স্যারের সাথে সেলফিতো দূরের কথা উনাকে আমি কোনোদিন সামনা সামনি দেখিওনি। শাহবাগে একবার উনাকে দেখেছি এবং শুনেছি তিনি ফেসবুকে সময় নষ্ট করা প্রজন্মের কাছে ক্ষমা চাইছেন। প্রতি বইমেলাতেই বড় বড় কিছু জটলা দেখেছি- বন্ধুদের বলতে শুনেছি ঐ জটলার ভেতর জাফর ইকবাল অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। আমি মিছিল পছন্দ করলেও জটলা পছন্দ নয় বলে আমার কাছে উনার কোনো অটোগ্রাফও নেই। রাজনৈতিক বিশ্বাসে না ঘরকা না ঘাটকা এমন মানুষে আমার আগ্রহও নেই। উনার কিছু বই অবশ্য আমি পড়েছি।

বাংলাদেশে অনেক মানুষ উনাকে পছন্দ করে, ভালোবাসে সেই মানুষগুলোকে আমি ভালোবাসি। উনি যখন বলেন-আপনি একজন ইয়াং মানুষ আপনি কি করে জামাতের হয়ে কাজ করেন তখন উনার জন্য আমার শ্রদ্ধাবোধ কাজ করে। আবার উনি যখন বলেন-ঐ বইটি তোমরা কিনবে না বা পড়বে না, বইয়ে নবীকে সমালোচনা করা হয়েছে- তখন উনার প্রতি আমার সংশয় জাগে!

সুবিধাজনক অবস্থানের মানুষদের আমি তরল মানুষ বলি। আদর্শের শত্রুর সাথে আমি পাঞ্জাতেই বিশ্বাস করি গলাগলিতে নয়। জাফর স্যারকে বাংলাদেশের অনেক মানুষ ভালোবাসেন এটা আমার ভালো লাগে।

উনি মৌলবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেন, জামাত শিবিরের বিরুদ্ধে কথা বলেন, লেখেন সে কারণেও উনাকে কখনও নিজের পক্ষও মনে করি। সে কারণেও নয়। যে কারণে অন্য সব লেখক, ব্লগার, মুক্তচিন্তক, প্রকাশকদের উপর হামলা এবং হত্যার প্রতিবাদ করেছি, বিক্ষুব্ধ হয়েছি একই কারণে আমি জাফর ইকবালের উপর হামলায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছি। উনি কোনোদিন আমাকে কোনো প্রশংসা করে কিছু বলেন নি বা লেখেন নি, সুযোগও ছিলো না, কারণ তিনি আমাকে চেনেন না। তারপরও আমি এই হামলায় ক্ষুব্ধ হয়েছি। কারণ আমি যে কোনো হামলা হত্যাকে ঘৃণা করি।

অনেকেই বলছেন- কত্ত বড় সাহস জাফর ইকবাল স্যারের উপর হামলা করে? আবার অনেকে বলছেন- হামলাকারীরা অনেক বড় ভুল করে ফেলেছে যে জাফর ইকবালের উপর হামলা করে ফেলেছে। তার মানে কি এর আগে যাদের উপর হামলা করা হয়েছে যাদের হত্যা করা হয়েছে তাদের হত্যা করা হামলা করা ঠিক ছিলো?

এতো এতো ব্লগার, লেখক, ‍মুক্তচিন্তক, প্রকাশক, এলজিবিটি, হত্যায় যারা একটা অক্ষর একটা ধ্বনি ব্যবহার করেন নি, তারাই বলছেন জাফর ইকবালের কিছু হলে আমি বাঁচতাম না, তাদের অনেককেই দেখছি আজ শাহবাগে। অভিজিৎ রায়ের হত্যার পর আমি আমার এক কবি বন্ধুকে সাথে নিয়ে কতজনার সাথে কথা বলেছি প্রস্তাব দিয়েছি চলেন লেখকদের পক্ষ থেকে আমরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানাই। সবাই এড়িয়ে গেছেন। কয়েকটা মিটিংও আমরা করেছিলাম সেই মিটিংয়ে সিনিয়র দায়িত্বশীল কয়েকজন বলেছিলেন -আমাদের এমন কিছু লেখা ঠিক হবে না যার জন্য আমাদের চাপাতির কোপ খেতে হয়। তাদের পরবর্তী মিটিঙে যাওয়ার আগ্রহ খুঁজে পাইনি নিজের মধ্যে।

শুধু জাফর ইকবাল স্যার নয় বিশ্বাসের ভাইরাসে আক্রান্ত পক্ষের দ্বারা প্রতিটি হত্যা হামলার সাথে সাথে আমারও একবার করে মৃত্যু হয়েছে। প্রতিটি হত্যা হামলার পরেই আমি হাউমাউ করে কেঁদেছি, আমার সন্তানেরা অবাক বিস্ময়ে আমার চোখের পানি মুছেছে। জাফর ইকবাল স্যারের জীবন অবশ্যই মূল্যবান, শাহবাগের মিছিলের সবচেয়ে পেছনে হাঁটা আমার সহযোদ্ধাটির জীবন কিছু কম মূল্যবান নয় আমার কাছে।

তাই পুলিশ নিরাপত্তা নিয়ে এবং সরকারের ভূমিকা নিয়ে জাফর ইকবাল স্যারের পরিবারের সন্তোষ প্রকাশেও আমি ক্ষুব্ধ হই। কারণ আমার যে সহযোদ্ধাটি জাফর স্যারের উপর হামলার প্রতিবাদে স্লোগানে দেশ কাঁপাচ্ছে তার জন্য কোনো পুলিশ প্রটেকশন নেই, মিছিল শেষে তাকে একাই ফিরতে হয় ঘাতকের ছায়া পেছনে নিয়ে। অথচ তারও অধিকার আছে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা পাওয়ার। অনন্ত বিজয় দাশ, ওয়াশিকুর বাবু, নিলয় নীল, দীপন, আহমেদুর রশীদ টুটুল এরা সবাই আমাদের কাছে একেকজন জাফর ইকবাল, তারা কেউ পুলিশ নিরাপত্তা পায় নি, পায় নি শেখ হাসিনার নুন্যতম মনোযোগ, উপরন্তু তাদের উপর হামলাকারীদের শেখ হাসিনা নিজের ধর্মানুভুতিকে সামনে নিয়ে এসে দায় মুক্তি দিয়েছেন। তারই বর্ধিত ফলাফল ভোগ করছেন আজ জাফর ইকবাল স্যার। সে কথা ভুলে গিয়ে কি করে ইয়াসমিন ম্যাডাম পুলিশের নিরাপত্তা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করতে পারেন!

এই অবস্থায় এই প্রসঙ্গে যারাই পুলিশে হয়ে সাফাই গাইবে, সরকারের-প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গুণগান গাইবে তাকেই আমি চাটুকার বলবো। কই শেখ হাসিনা কি অভিজিৎ হত্যার দুই বছর পরও সময় করতে পেরেছেন বন্যা আহমেদকে একটা কল করার? করেন নি, জাফর ইকবালকে হেলিকপ্টার দিয়ে শেখ হাসিনা বা তার সরকার কি করে অভিজিৎসহ সব লেখক, ব্লগার, এলিজিবিটি, প্রকাশক হত্যাকারীদের বিচারের দায় এড়াতে পারেন? পারেন না।

  • চৈতী আহমেদ: কবি।
  • [প্রকাশিত লেখার মতামত, মন্তব্য ও দায় লেখকের নিজস্ব]

আপনার মন্তব্য

আলোচিত