এনামুল হক এনাম

১৫ মার্চ, ২০১৮ ০২:১১

বিদায় প্রফেসর

সন্ধ্যার পর থেকেই ফেসবুকের টাইমলাইন ভরে যেতে থাকলো স্টিফেন হকিংয়ের ছবিতে। ব্যাপারটা প্রথমে ধরতে পারিনি। হঠাৎ করে ফেসবুকের সবাই কিছু নিয়ে মাতামাতি করলে সন্দেহ হয়। তাই জানতে চেষ্টা করলাম ব্যাপারখানা কি! যখন জানলাম, তখন বুকের গভীরে কোথায় জানি চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলাম। প্রিয় বিজ্ঞানী নেই!

আমি ব্যক্তিগত ভাবে স্টিফেন হকিংকে কখনো দেখিনি। তাঁর লেখার সংস্পর্শে এসেছি “সময়” নিয়ে পড়তে গিয়ে। সময় নিয়ে পড়তে গিয়েই খুঁজে বের করতে হয়েছিলো, সময়ের সৃষ্টিটা কোথায়। যতই জেনেছি, স্টিফেন হকিং সম্পর্কে ততই আগ্রহ বেড়েছে।
বছর কয়েক আগে আমি যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজের খুব কাছাকাছি এলাকায় ছিলাম। জায়গাটার নাম, ইপসুইচ। সেখানে বসে, যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলাম প্রফেসর স্টিফেন হকিং এর সাথে। এত বড় মানুষের সাক্ষাত এত সহজে পাওয়া যায় না। পাওয়ার কথাও না। আমার বড় ভাই ইপসুইচে থাকেন, বললেন, কেমব্রিজে গেলে মাঝে মধ্যে পার্কে প্রফেসরকে দেখা যায়। তিনি হুইল চেয়ারে বসে আছেন, সাথে মধ্য বয়স্কা একজন নারী। আমার ভাতিজি পরামর্শ দিলো, প্রফেসরকে সাথে দেখা করতে হলে টুইট করতে। তিনি টুইটারে আছেন। আমি তার পরামর্শ মত সাক্ষাতের অনুমতি চেয়ে টুইট করলাম। কিন্তু আত্মীয় স্বজনের বাসায় দাওয়াতের জন্য আমায় লন্ডন চলে আসতে হলো। আমার আর কেমব্রিজ যাওয়া হলো না। দুধের স্বাধ ঘোলে মিটানো মত, লন্ডনে মোমের মিউজিয়াম, ম্যাদামতুস্যোতে গিয়ে প্রফেসরের পুতুলের সাথে ছবি তুললাম।

গত দুইদিন আগেই নীল টাইসনের সাথে একটি সাক্ষাতকারে স্টিফেন হকিংকে দেখে আবার মনে হলো, আগামী জুলাইয়ে যুক্তরাজ্য যাওয়ার যেহেতু সম্ভাবনা আছে, সেহেতু তাঁর সাথে দেখা করতে হলে এখনই চিঠি চালাচালি বা টুইটারে টুইট করা শুরু করতে হবে। আজ শুনি তিনি আর আমাদের মাঝে নেই। মানুষটার কাছে আমি অনেককাংশেই ব্যক্তিগত ভাবে ঋণী। আমার ব্যক্তিগত মতাদর্শের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে তাঁর অনেক ব্যাখ্যা আমায় দারুন ভাবে আলোর পথ দেখিয়েছে।    

বিগ ব্যাং ব্যাখ্যা করার জন্য তাঁর জীবনের একটা বড় সময় ব্যয় করার পর, অবস্মরণীয় বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে একটি সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন বিগ ব্যাং এর পূর্বে কি ঘটেছিলো। যেন তিনি জানতেন, তাঁর হাতে সময় বেশি নেই।
হকিং এবং সহকর্মী পদার্থবিজ্ঞানী রজার পেনরোজ একদা, মহাশূন্য এবং সময় নিয়ে ব্যাখ্যা করার সময় বলেছিলেন, বিগ ব্যাং মাধ্যমে মহা সম্প্রসারণের শুরু এবং এর নিয়তি একটি বিশাল ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহবর।  

এই মাসের শুরুতে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল স্টার টক শোতে বিজ্ঞানী নীল ডিগ্রাস টাইসনের সাথে সাক্ষাত্কারে স্টিফেন হকিং তাঁর সীমানাবিহীন থিউরি (“no boundary” theory) নিয়ে আলাপ করেন।

একটি প্রশ্নের উত্তরে হকিং নীল টাইসনকে বলেন, মহাশূন্যের সীমানা হলো... সীমানাবিহীন, অসীম।

প্রায় ১৪ বিলিয়ন বছর পিছনে যান তবে দেখতে পাবেন সমগ্র মহাশূন্য (ইউনিভার্স) একটি পরমাণুর আকারে সংকুচিত ছিল (পয়েন্ট অব সিঙ্গুলারিটি)। বিগ ব্যাং এর পরবর্তী সময়েই “সময়” এর সৃষ্টি হয়েছে, এবং সেখান থেকেই সময় সম্প্রসারিত হয়েছে বিগ ব্যাং এর সাথেই। বলতে পারেন সময় এবং বিগ ব্যাং এর জন্ম একই মূহুর্তে একই সাথে...!

বিজ্ঞানী হকিং বলেন, “It was always reaching closer to nothing but didn’t come to nothing.”

বিগ ব্যাং শুধুমাত্র যে শূন্য থেকেই সৃষ্টি হয়েছে তা নয় এবং এর ব্যাখ্যাও মানবজাতির দৃষ্টিকোণ থেকে বোধগম্যতা যথেষ্ট দূরেই মনে হচ্ছে (“the Big Bang did not simply create something from nothing: “It just seemed that way from mankind’s perspective”.)

একই সাক্ষাতকারে টাইসন হকিং’কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ১৮শতকের অন্যতম গণিতবিদ আইজাক নিউটন জন্য তাঁর কি কোন প্রশ্ন আছে।

নিউটনের জন্য হকিং এর প্রশ্ন ছিলো, "সৌরজগত কি স্থিতিশীল?” এবং একটি তারা (star) নিজের মধ্যাকর্ষন শক্তির বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে না তখন কি হয়?

সাক্ষাতকারটি আবারও দেখলাম ইউটিউবে। স্টিফেন হকিং বেঁচে নেই। বেঁচে থাকলে হয়তো সৃষ্টি রহস্যের আরও অনেক কিছুই আমাদের জানা হত। প্রফেসরের সুরেই বলি, আমাদের সবারই সুযোগ আছে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সৃষ্টি রহস্য নিয়ে চিন্তা করার। এগিয়ে নিয়ে যাওয়া... স্টিফেন হকিং এর অসমাপ্ত কাজ। বিদায় স্টিফেন হকিং!  
লেখক: প্রভাষক, ওসমানী মেডিকেল কলেজ, সিলেট।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত