দেবাশিস সরকার, গবেষক

১৮ মার্চ, ২০১৮ ১২:৫৮

প্রভাবশালী পুতিন ও রাশিয়া

রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন বিশ্বে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপ্রধানদের একজন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তার সাফল্য যেমন আছে তেমনি সমালোচনাও আছে। রাশিয়াতে তার বিকল্প হিসেবে এখনো কোনো নেতা তৈরি হয়নি বলে তিনি মনে করেন। বাস্তবেও আমরা এমনটা দেখতে পাই।

গত বছরের শেষের দিকে প্রেসিডেন্ট পুতিন ১ হাজার ছয়শ’র বেশি সাংবাদিকের সাথে প্রায় চার ঘণ্টা ধরে চলা সংবাদ সম্মেলনে তার সরকারের সাফল্য তুলে ধরেন। তার মধ্যে অন্যান্য সফলতার পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি ছিল কর কমানোর এবং শ্রমিকদের মজুরি বাড়ার সাফল্যের কথা।

তবে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় ছিল তার প্রেসিডেন্ট পদে আবার নির্বাচন করার ঘোষণা। ১৮ মার্চ রাশিয়ার প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন হতে যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ধারাবাহিকভাবে দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য আশা প্রকাশ করেছেন।

প্রেসিডেন্ট পুতিন অনেক ক্ষমতাধর হওয়ার পরেও কিন্তু সমালোচনা তার পিছু ছাড়ে না। কিছুদিন আগে ইংল্যান্ড এ রাশিয়ার সাবেক গুপ্তচরকে রাসায়নিক বিষক্রিয়ার মাধ্যমে হত্যা চেষ্টা চালানো হয়। এজন্য ইংল্যান্ড রাশিয়াকেই দুষছে।বরাবরের মতই রাশিয়া এর দায়ভার অস্বীকার করে আসছে। ইংল্যান্ড তার দেশের মাটিতে এই ধরণের কর্মকাণ্ড করার জন্য শাস্তি হিসেবে রাশিয়ার ২২ কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে।

অনেকেই বিশ্বাস করেন সে কোনো রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরি হতে দেয় না। সব ক্ষমতা তার নিজের হাতে কুক্ষিগত করে রাখে।  তাছাড়া তার অঢেল সম্পদ নিয়েও সমালোচনা আছে। অর্থনৈতিকভাবে খারাপ অবস্থা, সংস্কার কিংবা শিক্ষা খাতে পরিবর্তন অথবা মানবাধিকার এর মতো বিষয়ে পুতিনের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে অনেক সমালোচনা আছে। ক্রিমিয়া আগ্রাসনের জন্য ব্যাপক সমালোচিত হচ্ছে পুতিন। পশ্চিমাদের রাশিয়ার উপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার জন্য রাশিয়া অনেকটা আর্থিক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।  রুবল এবং তেলের দাম কমার কারণে সেটা আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে।  ন্যাটোর সাথে রাশিয়ার বাকযুদ্ধ প্রায় লেগেই আছে।

রাশিয়ার মিডিয়াতে পুতিনের একচ্ছত্র আধিপত্য। রাষ্ট্রীয়ভাবে খবরগুলো ছাপানোর ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন সহজেই চোখে পরে। তার সরকার স্থানীয় মিডিয়াকে যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ঠিক তেমনি ভাবে বৈদেশিক মিডিয়াকেও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। বিদেশের কেউ রাশিয়ার মিডিয়া সম্পদের ২০ ভাগের বেশি মালিকানা নিতে পারবে না বলে কিছুদিন আগে পুতিন একটা নতুন আইন করেছে যা কিনা তার নিয়ন্ত্রণকেই মনে করিয়ে দেয়।

পুতিনের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে রাশিয়া তে কাজ করা অনেক কঠিন বিষয়। অন্যান্য বিরোধী নেতাদের মতো আলেক্সি নাভালঁই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন কিন্তু কিছুদিন আগে অনুমোদনবিহীন নির্বাচন বিরোধী গণজমায়েত করার জন্য তিনি সহ  প্রায় ৬০০ মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়।

তাছাড়া তিনি আইনগতভাবে দণ্ডনীয় হওয়ার জন্য নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না যদিও মামলাটাকে অনেকেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করা হয়েছে বলা হয়ে থাকে। তিনি রাশিয়ার জনগণের সাথে তার মতামত নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন এবং অনেকটাই সারা পাচ্ছিলেন।

তরুণদের মতামতের দিকে তাকালে দেখা যায় যে তারা পুরনো নেতৃত্বকে ততটা পছন্দ করছে না। এখন তরুণ জনগণ বিশ্বাস করে যে বেশিরভাগ নেতার ক্ষেত্রেই সোভিয়েত ঘরানার চিন্তা ভাবনা কাজ করে। আধুনিক যুগে তারা তরুণ নেতৃত্ব চান যাদের চিন্তা ভাবনায় তরুণ সমাজ প্রাধান্য পাবে।

অনেকেই বলছেন নির্বাচনে পুতিনের জয় লাভ করা তেমন কোনো বিষয় না কেননা যে লোক আমেরিকার নির্বাচনে কারসাজি করতে পারে বলে প্রচার আছে সেখানে নিজের দেশে তো ব্যাপারই না। এরকম অনেক ধরণের সমালোচনার শিকার হচ্ছে পুতিন।

কিন্তু এত কিছুর পরেও পুতিনের জনপ্রিয়তা কমছে না। ব্লমবার্গের এক লেখক মনে করেন যে পুতিন এর মতো এখনো হয়তো কেউ রাশিয়ার আশাপ্রদ ভবিষ্যৎ দেখাতে পারে নি বলে পুতিনের কোনো বিকল্প নেই।

পশ্চিমাদের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক কখনো ভালো যায় নি। রাশিয়া সবসময় পশ্চিমাদের বিভিন্নভাবে দোষারোপ করে থাকে বিশেষ করে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর থেকেই। এর অবশ্য যৌক্তিক কারণও আছে। ওই সময়টাতে রাশিয়া একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের পরিচয় পাচ্ছিল। সোভিয়েত সাম্রাজ্যের পতনের পর এলোমেলো রাশিয়াকে যদি কেউ আজকের অবস্থানে নিয়ে আসে তাহলে পুতিন এর অবদানের কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। তিনি যেমন চেচনিয়ার যুদ্ধ বন্ধ করতে পেরেছেন তেমনি রাশিয়ার মানুষের মনে একধরণের আত্মবিশ্বাসও তৈরি করেছেন।

পুতিন ছাড়া এমন নেতা পাওয়া অবশ্য খুবই কঠিন যে কিনা সহজেই আমেরিকাকে বিভিন্ন বিষয়ে চ্যালেঞ্জ করে থাকে। তাছাড়া সিরিয়া, ইরান এমনকি উত্তর কোরিয়ার ইস্যুতে রাশিয়া ব্যাপক সমর্থন দেওয়াতে আমেরিকা তেমন কিছু করতে পারছে না। চীনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও পুতিন বেশ জোরালো ভূমিকা পালন করেন।

যার প্রভাব আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এখন আর কোনো গোপন বিষয় নয়। অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে শেষ পর্যন্ত রাশিয়া একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে পুতিনের জন্য। ক্রিমিয়া অধিগ্রহণের জন্য সমালোচনার পাশাপাশি পুতিন অনেক জনপ্রিয়তাও পান বিশেষ করে ক্রিমিয়া পণ্য পরিবহনের জন্য রাশিয়ার জন্য একটা কৌশলগত জায়গা।

দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার দরুন সে এমন এক প্রভাব বিস্তার করেছে যে নেতা বলতে সবাই তাকেই মনে করে। পুতিন বেশ যত্ন করে তার ছবি মিডিয়াতে প্রকাশ করে যেমন ধরুন কখনো শক্তিশালী বাঘের সাথে, ঘোড়ার উপর চড়ে খালি গায়ের ছবি অথবা ধর্মীয় কারণে ভয়াবহ ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করা এইগুলোর মাধ্যমে সে একটা বিশেষ পরিচয় জনগণের সামনে তুলে ধরে।

পুতিন মানেই রাশিয়া আবার রাশিয়া মানেই পুতিন। এইরকম একটা প্রচারণা আছে রাশিয়াতেই। আজকের রাশিয়া যে পুতিনের অবদানের একটা অংশ সেটা মেনে নিতে হবে। পুতিন ক্ষমতায় আসার পরে দরিদ্রতা কমেছে, মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে, টিকে থাকার জন্য অনেক প্রতিষ্ঠানকে পুনঃ জাতীয়করণ করেছে। এসব কারণে তার প্রতি এক শ্রেণীর মানুষের সমর্থন আছে।

ব্যক্তিগত ক্যারিশমার কারণে পুতিন অনেক জনপ্রিয়। একজন শক্ত মনের মানুষ, চ্যালেঞ্জ করার মানুষ, পরিবর্তন করার মানুষ, যুদ্ধ করার মানুষ হিসেবে পুতিন এখনো রাশিয়ার জনপ্রিয় নেতা। পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো নেতা এ যুগে পাওয়া খুব দুষ্কর।

অভিজ্ঞতার আলোকে একজন দক্ষ লোক হিসেবে পুতিন এর প্রভাব এখন বিশ্ব স্বীকৃত। বিশ্বে রাশিয়ার ক্রমাগত প্রভাব বৃদ্ধির মূলে পুতিন। যদি নির্বাচনে পুতিন জয়লাভ করে তাহলে একটা শান্তিপূর্ণ পৃথিবী নিশ্চিত করার জন্য কাজ করবে বলেই আশাবাদী।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত