মো. এবাদুর রহমান শামীম

২৩ মার্চ, ২০১৮ ১৮:০৫

বীরাঙ্গনা কাকন বিবি: এক মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বগাঁথা উপাখ্যান

বিশ্বের সব মহৎ সৃষ্টি বা কর্ম বা অর্জনের নেপথ্যে নারীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবদান রয়েছে। আমাদের জাতিসত্তার শৌর্যবীর্য ও বীরত্বের প্রতীক মহান স্বাধীনতা সংগ্রামও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। মহান স্বাধীনতা বাঙালি জাতিসত্তার ইতিহাসে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন। মহান মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেদনাময় এবং একইসাথে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করতে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দেশের সর্বস্তরের মুক্তিকামী জনসাধারণ।

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে মহান স্বাধীনতা আন্দোলন পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে নারী সমাজের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সাহসী ও তাৎপর্যপূর্ণ। এরই ধারাবাহিকতায় মহান মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ এবং ভূমিকা ছিল বহুমুখী ও বীরত্বপূর্ণ। মহান মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান কেবল সম্ভ্রম হারানো, নির্যাতিত ও শরণার্থী নারীর অবর্ণনীয় লাঞ্ছনা-বঞ্চনার গল্পে শেষ নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা দান, মুক্তিক্যাম্পে খাবার তৈরি ও সরবরাহ, পোশাক সংগ্রহ ও সরবরাহ, মুক্তিবাহিনীর গুপ্তচরবৃত্তি ও যুদ্ধাহতদের পরম মমতায় সেবা-শুশ্রূষার পাশাপাশি সম্মুখ ও গেরিলা যুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ মহান মুক্তিযুদ্ধে ইতিহাসকে সমৃদ্ধ ও গৌরবান্বিত করেছে। কাকন বিবি, তারামন বিবি, সিতারা বেগম, শিরিন বানু মিতিল, আশালতা, নাজমা বেগম [কানন বণিক], হালিমা পারভীন, ফাতেমা খাতুন, রওশন আরা, করুণা বেগম, মিরাসি বেগম এবং কাঞ্চনমালাসহ নাম না জানা আরও অনেক নারী রণাঙ্গনে অসমসাহসিকার সাথে বীরদর্পে যুদ্ধ করেছেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নারী অবদান যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়নি। শুধু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে নয়; কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প এবং চলচ্চিত্রেও নারীর সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠেনি। এমনকি বীরাঙ্গনা ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির ক্ষেত্রেও নারীরা বৈষম্যের স্বীকার।

আর স্বাধীনতা অর্জনের ৪৬ বছরে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই না পাওয়া এমনি একজন বীরাঙ্গনা, বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিরবেটি, মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিকন্যা ও বীরমাতা নামে খ্যাত অকুতোভয় সংগ্রামী নারীর নাম কাকন বিবি [কাকাত হেনইঞ্চিতা]।

বীর মুক্তিযোদ্ধা কাকন বিবি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের এক জীবন্ত ইতিহাস বা দলিল। স্বাধীনতা অর্জনের পর ৪৬ বছর ধরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতা ও নিষ্ঠুরতার জীবন্ত প্রামাণ্যচিত্র এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত স্মৃতিসৌধ হয়ে বেঁচে ছিলেন রণাঙ্গনের এই অকুতোভয় বীর সৈনিক। মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিকন্যা কাকন বিবি খাসিয়া সম্প্রদায়ের এক সংগ্রামী নারীর প্রতিচ্ছবি। তিনি একাধারে মহান মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গনের এক দুঃসাহসিক বীরযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা, গেরিলা যোদ্ধা এবং মুক্তিবাহিনীর গুপ্তচর। এমনকি মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার, যুদ্ধাহতদের জন্য ঔষধপত্র, যুদ্ধের জন্য গোলাবারুদ ও গ্রেনেড যোগান দিয়েছেন অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে সম্ভ্রম হারিয়েছেন, একাধিকবার নির্যাতিত ও গুলিবিদ্ধ হয়েছেন এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ২০টি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে অসমসাহসিকতা ও অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য তিনি বীরযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা, বীরমাতা, মুক্তিবেটি, মুক্তি বোর্ট এবং মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিকন্যা প্রভৃতি নামে সমধিক পরিচিত।

বীরাঙ্গনা কাকন বিবি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে ৫নং সেক্টরের অধীন সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার শেলা [বাঁশতলা] সাব-সেক্টরের অধীনে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বের পরিচয় দেন। উত্তর সিলেট, সুনামগঞ্জ ও ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী অঞ্চল নিয়ে গঠিত ৫নং সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন মেজর মীর শওকত আলী এবং ৫নং সেক্টরের শেলা সাব-সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন পাকিস্তানের শিয়ালকোট থেকে পালিয়ে আসা ক্যাপ্টেন আবু সৈয়দ মো. হেলাল উদ্দিন। পরে সহযোগী কমান্ডার হিসেবে যোগ দেন লেফটেন্যান্ট মাহবুবর রহমান ও লেফটেন্যান্ট আবদুর রউফ। ৫ নং সেক্টরের হেড কোয়ার্টার ছিল বাংলাবাজার ইউনিয়নের বাঁশতলা গ্রামে। এছাড়া যুদ্ধ পরিচালনায় প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন শহীদ মো. আবদুল হক এমএনএ, বীরপ্রতীক অধ্যক্ষ ইদ্রিস আলী, এডভোকেট বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু, শহীদ চৌধুরী ও রহমত আলী প্রমুখ বীর মুক্তিযোদ্ধা।

মুক্তিবেটি কাকন বিবি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশের নক্রাই গ্রামে এক পাহাড়ি খাসিয়া পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর সঠিক জন্ম তারিখ জানা যায়নি। ছোটবেলায় তিনি মা-বাবাকে হারান। মা-বাবাকে হারানোর পর তিনি বড় বোনের বাড়িতে লালিত-পালিত হন। অল্পবয়সে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার শহীদ আলী মতান্তরে শাহেদ আলী/সাঈদ আলী সাথে তাঁর বিয়ে হয় এবং নতুন নাম রাখা হয় নূরজাহান বেগম। দাম্পত্যজীবনে তাঁদের সংসারে ফুটফুটে এক কন্যাসন্তানের আগমন ঘটে এবং নাম রাখেন সখিনা বেগম। একসময় স্বামীর সাথে তাঁর মনোমালিন্য দেখা দেয় এবং এক পর্যায়ে তাঁদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। পরবর্তীতে বোন জামাই খুশি কমান্ডারের পরিচিত ইপিআর সৈনিক পাকিস্তানি [পাঞ্জাবি] যুবক আব্দুল মজিদ খানের সাথে তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে হয়। বিয়ের পর কাকন বিবি স্বামীর সঙ্গে কর্মস্থল বর্তমান দোয়ারাবাজারের বোগলা ক্যাম্পে উঠেন। এরপর তিনি সৈনিক স্বামীর সাথে সিলেট ও সুনামগঞ্জের বিভিন্ন ক্যাম্পে কাটান।

১৯৭১ সালের জুন মাসে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের উত্তাল মুহূর্তে সিলেটের আখালিয়া ক্যাম্পে থাকা অবস্থায় হঠাৎ তাঁর স্বামী নিরুদ্দেশ হন। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন তাঁর স্বামী দোয়ারাবাজার সীমান্ত এলাকার কোনো এক ক্যাম্পে আছেন। স্বামীর জন্য পাগলের মতো পাকিস্তানি ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরতে থাকা কাকন বিবি পাক হায়েনাদের লালসার শিকার হয়ে সম্ভ্রম হারান। এসময় বোন জামাই খুশি কমান্ডারকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে হত্যা করে। স্বামী, বোন জামাই ও সম্ভ্রম হারিয়ে কাকন বিবি মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হওয়ার তাড়না অনুভব করেন।

জুলাই মাসে দোয়ারার মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী সেক্টর কমান্ডার মেজর মীর শওকত আলী ও ক্যাপ্টেন হেলালের সাথে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেন। মেজর মীর শওকত আলী ইপিআর সৈনিকের স্ত্রীর পরিচয় ব্যবহার করে মুক্তিবাহিনীর গুপ্তচর হিসেবে কাজ করতে কাকন বিবিকে উৎসাহিত করেন। সীমান্তবর্তী ঝিরাগাঁও গ্রামে জনৈক এক ব্যক্তির আশ্রয়ে আদরের শিশুকন্যা সখিনাকে রেখে যোগ দেন মুক্তিবাহিনীতে। প্রাথমিক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর একজন গুপ্তচর হিসেবে তাঁর দায়িত্ব ছিল পাকিস্তানি ক্যাম্পে ঢুকে সৈন্য সংখ্যা, অস্ত্রের ধরণ ও পরিমাণ এবং সৈন্যদলের অবস্থান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা। কখনো সৈনিক স্বামীর খুঁজে, কখনোবা ভিক্ষুক বা ভবঘুরে ছদ্মবেশে তিনি পাকিস্তানি বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করতে থাকেন। তথ্য সংগ্রহ করে শহীদ কোম্পানির কমান্ডার হরিণাপাটির শহীদ চৌধুরীকে সরবরাহ করতেন। তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকটি সফল অপারেশন পরিচালনা করতে সক্ষম হয়।

এইভাবে ছদ্মবেশে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে একদিন পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। দোয়ারাবাজারের টেংরাটিলা ক্যাম্পে তাঁর ওপর অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে থেমে যাননি অসমসাহসি কাকন বিবি। আবারো নেমে পড়েন ছদ্মবেশে তথ্য সংগ্রহের কাজে। দোয়ারাবাজার উপজেলার বাংলাবাজারে স্থানীয় রাজাকারদের যোগসাজশে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে পুনরায় ধরা পড়েন তিনি। টানা ৭ দিন অসংখ্য পাকিস্তানি হায়েনার আবারো লালসার শিকার হন কাকন বিবি। বিবস্ত্র করে গাছে বেঁধে তাঁর উপর পৈশাচিক নির্যাতন চালায় বর্বর পাকবাহিনী। লোহার রড গরম করে তাঁর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ছ্যাকা দেয়া হয়। মৃতভেবে অজ্ঞান কাকন বিবিকে পাকবাহিনী পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে ফেলে রেখে যায়। কয়েকদিন পর মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে উদ্ধার করে বালাট সাবসেক্টরে নিয়ে আসেন। এই নির্মম ও বীভৎস নির্যাতনের পরও তাঁর মুখ থেকে কোনো কথা বের করতে পারেনি পাকিস্তানি সৈন্যরা। সুস্থ হয়ে তিনি ফিরে আসেন সেক্টর কমান্ডার মীর শওকত আলী ও ক্যাপ্টেন হেলালের কাছে। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে ক্যাপ্টেন হেলালের নির্দেশে শহীদ কোম্পানি ও লক্ষ্মীপুর ক্যাম্পে খাবার, ঔষধপত্র ও অস্ত্র সরবরাহের কাজ শুরু করেন।

আগস্ট মাসের পর মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলীর সহায়তায় অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে রণাঙ্গনে পাক হায়েনাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে দোয়ারাবাজার উপজেলার টেংরাটিলায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে উরুতে গুলিবিদ্ধ হন কাকন বিবি। এরপর কাকন বিবি মুক্তিবাহিনীর সাথে একে একে অংশগ্রহণ করতে থাকেন আমবাড়ি, বাংলাবাজার, টেবলাই, বলিউরা, মহব্বতপুর, বেতুরা, দুর্বিনটিলা, কান্দাগাঁও, পূর্ববাজার, বসরাই, বেটিরগাঁও, নূরপুর, দোয়ারাবাজার, সিলাইরপাড়া, আধারটিলাসহ ২০টি যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তন্মধ্যে ১৫টি সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। আমবাড়ি বাজারের যুদ্ধে তিনি আবারো গুলিবিদ্ধ হন। নভেম্বর মাসের শেষের দিকে পাকিস্তানি বাহিনী প্রতিরোধের পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে জাউয়া বাজার ব্রিজ অপারেশনে কাকন বিবি অত্যন্ত সাহসী ও বিচক্ষণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে এবং প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধারা সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কের জাউয়া বাজার ব্রিজ অপারেশনে যান। মাইন বিস্ফোরণে উড়িয়ে দিয়েছিলেন জাউয়া বাজার ব্রিজ।

মহান মুক্তিযুদ্ধে কাকন বিবির ত্যাগ-তিতিক্ষা আর বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম বৃথা যায়নি। ৬ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জ পাক হানাদার মুক্ত হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। দীর্ঘ ৯ মাস তথা ২৬৬ দিনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ আর ৩০ লক্ষাধিক শহীদের তরতাজা প্রাণ ও ৪ লক্ষাধিক মা-বোনের ইজ্জত-সম্ভ্রম এবং ১ কোটির অধিক শরণার্থীর বর্ণনাতীত দুঃখ-দুর্দশার বিনিময়ে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়।

মুক্তিবেটি কাকন বিবির জীবনে শুরু হয় নতুন এক সংগ্রাম। স্বাধীনতার পর সহায়-সম্বলহীন কাকন বিবি একেবারে অসহায় হয়ে পড়েন। পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত করা ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের মধ্যে মাথা গোঁজার ঠাঁই পর্যন্ত কোথাও পাননি রণাঙ্গনের এই বীর সৈনিক। একসময় দোয়ারাবাজার উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের ঝিরাগাঁও গ্রামের আব্দুল করিমের বাড়িতে কাকন বিবি মেয়েসহ আশ্রয় নেন। যুদ্ধজয়ী কাকন বিবি জীবিকার তাগিদে অন্যের বাড়িতে বাড়িতে কাজ করতেন, কখনোবা বাজারে বাজারে লাকড়ি বা শুটকি বিক্রি করতেন। এক পর্যায়ে পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক নির্যাতিত ও যুদ্ধাহত কাকন বিবি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং অপ্রকৃতিস্থও হয়ে যান। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন এবং কিছুটা সুস্থ হন। কিন্তু কাজকর্ম করার শক্তি হারিয়ে ফেলেন। মুক্তি সংগ্রামে বিজয়ী হলেও জীবন নামক সংগ্রামের পরাজিত মুক্তিরবেটি জীবনধারণের জন্য বেছে নেন ভিক্ষাবৃত্তি। আর এইভাবে অগ্নিকন্যা কাকন বিবি পরাজিত জীবন সংগ্রামের গ্লানি বহন করে প্রায় ২৫ বছর অতিবাহিত করেন।

সুনামগঞ্জের সাংবাদিক এডভোকেট রনেন্দ্র তালুকদার পিংকু ঘটনাক্রমে মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু, সেক্টর কমান্ডার মীর শওকত আলী ও মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলীর কাছ থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধে কাকন বিবির বীরত্বের কথা শুনে তাঁকে খুঁজে বের করতে সচেষ্ট হন। অবশেষে দীর্ঘসময় খোঁজাখুঁজির পর ১৯৯৬ সালে তিনি বীরাঙ্গনা থেকে রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা কাকন বিবিকে ভিক্ষুক কাকন বিবি অবস্থায় খুঁজে বের করতে সমর্থ হন। এরপর তিনি কাকন বিবির সীমাহীন দুঃখ-কষ্টময় জীবন ও মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বীরত্বগাঁথা কাহিনী নিয়ে দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় একটি রিপোর্ট করেন। এই রিপোর্টের সূত্রধরে তিনি তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাতের সুযোগ লাভ করেন।

১৯৯৭ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর আত্মত্যাগ ও বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করার ঘোষণা দেন এবং বসবাসের জন্য এক একর খাসজমি প্রদান করেন। পরে বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন তাঁকে সম্মাননা প্রদান করে এবং আর্থিক সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে। বিশেষকরে, দৈনিক জনকণ্ঠ কর্তৃপক্ষ ২০০৭ পর্যন্ত মাসিক ৫ হাজার টাকা করে ভাতা প্রদান করে। ২০০৯ সালে জনতা ব্যাংক লি. এর পক্ষ থেকে ১৫ লক্ষ টাকার একটি এফডিআর করে দেওয়া হয় এবং জনতা ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. আবুল বারকাত ব্যক্তিগত তহবিল থেকে ৩ লক্ষ ৫০ টাকা দিয়ে একটি টিন শেড পাকা ঘর তৈরি করে দেন।

২০১০ সালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় তাঁকে বীর প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করে সাময়িক সনদপত্র প্রদান করে। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মৌখিক ঘোষণার ২১ বছরেও খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কাকন বিবি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৩ সালের পর খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের কোন গেজেট হয়নি। খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটেড না হওয়ায় তিনি খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের অনুরূপ কোন সুযোগ-সুবিধা পান নি।

১৯ জুলাই ২০১৭, ব্রেইন স্ট্রোক করার পর পক্ষাঘাতগ্রস্ত কাকন বিবি কথা বলতে পারছিলেন না। দু'বার স্ট্রোক করার পর তাঁকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রায় ১ মাস চিকিৎসা শেষে তাঁকে হাসপাতাল থেকে নিজ গ্রাম ঝিরাগাঁওয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সরকারি উদ্যোগে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে হয়তো আরও কিছুদিন সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারতেন তিনি।

প্রায় ৪ যুগ ধরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পৈশাচিকতা ও অসভ্যতার চিহ্ন বয়ে বেড়ানো মহান মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত দলিল এই বীরমাতার জীবনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেওয়া সরকারের অনেক আগেই উচিত ছিল। অথচ বীর প্রতীক খেতাব প্রাপ্তির রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি তাঁর ভাগ্যে জুটেনি। এমনকি মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বীরত্বকাব্য বই-পুস্তকেও ঠাঁই পায়নি কিংবা স্মৃতি ধরে রাখতে তাঁর নামে কোন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা বা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়নি। এই অপ্রাপ্তির বেদনা নিয়ে কাকন বিবি মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সমাবেশে গিয়ে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জীবদ্দশায় স্বীকৃতির জন্য আকুতির কথা জানিয়েছেন।

২৮ এপ্রিল ২০১৩, সিলেটে জনতা ব্যাংক লি. কর্তৃক প্রদত্ত এক সম্মাননা অনুষ্ঠানে অগ্নিকন্যা কাকন বিবি নিজের নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করার জন্য সরকারের নিকট দাবি জানান। তিনি বলেন, আমি মারা গেলেও এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চিরদিন বেঁচে থাকবে। সম্মাননা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রবাসে মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জনতা ব্যাংক লি. এর চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত। এর আগেও বিভিন্ন সময় তিনি নিজ গ্রামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছেন। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে অসুস্থ বীরাঙ্গনা কাকন বিবি চিকিৎসার সুবিধার্থে সরকারের পক্ষ থেকে সিলেট শহরে স্থায়িভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য মাননীয় অর্থমন্ত্রীর কাছে নিজ হস্তে একখানা আবেদনপত্র হস্তান্তর করেন।

সম্প্রতি বীর মুক্তিযোদ্ধা কাকন বিবির একমাত্র মেয়ে সখিনা বেগম একাধিক জাতীয় দৈনিক পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলকে জানান, তাঁর জনম দুঃখিনী বীরাঙ্গনা মায়ের একমাত্র স্বপ্ন অন্তত জীবিত অবস্থায় তাঁকে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া। এটা তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে দাবি জানান। এছাড়া দোয়ারাবাজার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীরপ্রতীক অধ্যক্ষ ইদ্রিস আলী, বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু, সুনামগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক প্রমুখ ব্যক্তি বীরাঙ্গনা কাকন বিবির বীরপ্রতীক খেতাব প্রাপ্তির স্বীকৃতি গেজেট আকারে প্রকাশের দাবি জানান। বীরমাতা কাকন বিবিকে দেওয়া বীরপ্রতীক খেতাবের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির পাশাপাশি আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি সম্মান প্রদর্শন পূর্বক তাঁর নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা বা নামকরণ করে কিছুটা হলেও ঋণশোধের চেষ্টা করা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য বটে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা কাকন বিবি মহান মুক্তিযুদ্ধে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক গুলিবিদ্ধ, নির্যাতিত ও ধর্ষিত লক্ষ লক্ষ সংগ্রামী নারীর এক জীবন্ত প্রতীক বা প্রামাণ্যচিত্র। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন, সম্ভ্রম হারিয়েছেন, ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করেছেন এবং শ্বাপদসঙ্কুল পরিবেশে দেশপ্রেমের দীপশিখা প্রজ্বলিত রেখেছেন; তাঁরা সর্বকালে, সর্বাবস্থায় জাতির শ্রেষ্ঠতর সন্তান। তাঁরা আমাদের অহংকার, গর্ব, চেতনা ও প্রেরণার বাতিঘর হয়ে কোটি কোটি বছর প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বেঁচে থাকবেন।

বীরমাতা কাকন বিবিসহ নারী মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিদান, জীবনের সম্পূর্ণ দায়িত্বভার গ্রহণ এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের বীরত্বগাঁথা ইতিহাস বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সচেষ্ট হবেন বলে আশাবাদ।

সহায়ক তথ্যসূত্র:

  • বাংলাদেশ ই-মুক্তিযুদ্ধ আর্কাইভ ট্রাস্ট
  • মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী [আইয়ুব হোসেন ও চারু হক], পৃষ্ঠা ২২৮-২৩০
  • বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও নারী মুক্তিযোদ্ধা: ১ম খণ্ড [মেহেরুন্নেসা মেরী], পৃষ্ঠা ১৯-২৪
  • বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন [সুনামগঞ্জ জেলা/দোয়ারাবাজার উপজেলা]
  • লিংকনের আমেরিকায় কিছু দিন [বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু]
  • কাকন বিবির খোঁজে [রনেন্দ্র তালুকদার পিংকু]
  • বাংলাপিডিয়া
  • উইকিপিডিয়া
  • কাকন বিবির খোঁজে [ডকুমেন্টারি: ইমরুজ আহমদ ও মারুফুর রহমান অপু]
  • বীরাঙ্গনা ৭১ [মুনতাসীর মামুন], পৃষ্ঠা ১১৮-১২৩
  • জীবনের গল্প: বীরাঙ্গনা কাকন বিবি [ডকুমেন্টারি: মুকুল চৌধুরী, আরিফ অর্ণব ও সুশান্ত শুভ]
  • দৈনিক জনকণ্ঠ, দৈনিক সিলেটের ডাক ও দৈনিক সুনামগঞ্জের খবর

মো. এবাদুর রহমান শামীম: শিক্ষক, কলাম লেখক ও আয়কর উপদেষ্টা।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত