অরণ্য রণি

২৮ মার্চ, ২০১৮ ০৪:২৪

জাফর ইকবালের ‘খ্যাতির বিড়ম্বনা’

জনপ্রিয় লেখক, কথাসাহিত্যিক ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ ইকবাল মৌলবাদী, উগ্র জঙ্গিগোষ্ঠী দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। গত ৩ মার্চ নিজ ক্যাম্পাসের মুক্তমঞ্চে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইইই ডিপার্টমেন্টের আয়োজনে এক রোবোটিক কন্টেস্ট চলাকালীন জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ এক যুবক স্যারকে পেছন দিয়ে ছুরি দিয়ে আঘাত করে হত্যাচেষ্টা করে।

ওইদিন বিকাল আনুমানিক সাড়ে ৫টার দিকে স্যারের ওপর এ হামলার ঘটনাটি ঘটে। হামলার সাথে সাথেই ক্যাম্পাসে থাকা উপস্থিত শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা তাঁকে তৎক্ষণাৎ উদ্ধার করে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেই সাথে হামলাকারী যুবককে ক্যাম্পাসে থাকা শিক্ষার্থী সাথে সাথে ধরে ফেলেন।

জাফর ইকবালের নিরাপত্তায় দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা পুলিশরা তাঁর পেছনে অবস্থান করা সত্ত্বেও এ হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় একটি স্থিরচিত্রে স্যারের পেছনে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা দুজন পুলিশ সদস্যকে মুঠোফোনে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। ঐ দুজন পুলিশ সদস্যকে নিরাপত্তার দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের বরাতে আমরা জানতে পারি এ ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষক নওশাদ সজীব। তিনি জানান, ছুরিকাঘাতের পরপরই জাফর স্যার সাথেই সাথেই ওঠে দাঁড়িয়ে বলেন ' আই অ্যাম অলরাইট, তোমরা উত্তেজিত হয়ো না।' এ কথা বলার সাথে সাথে তিনি জায়গায় বসে পড়েন। এ সময় তাঁর মুখ ও শার্ট বেয়ে রক্ত পড়তে দেখা যায়।

হাসপাতালে নেয়ার পর জরুরি বিভাগের চিকিৎসকরা তাঁর চিকিৎসা শুরু করেন। এক পর্যায়ে শাবির শিক্ষক-শিক্ষার্থী, গণমাধ্যমকর্মী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্যারের শুভাকাঙ্ক্ষীদের পদচারণায় লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে হাসপাতাল। আগমন ঘটে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও মন্ত্রীরও।

সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটে জাফর স্যারকে অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হয়। সাধারণত আমরা জানি অপারেশন থিয়েটারে ডাক্তার, নার্স, রোগী, ওয়ার্ড বয় ছাড়া বাহিরের কারো প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষেধ। কিন্তু এক্ষেত্রে স্যারের ওটিতে সেই বিধিনিষেধ আমরা আর মানলাম কই! শিক্ষক-শিক্ষার্থী, গণমাধ্যমকর্মী, রাজনৈতিক নেতা, অবাধে আমরা যাতায়াত করলাম ওটিতে।

অপারেশন থিয়েটারে ব্যবহৃত সকল জিনিষ থাকে জীবাণুমুক্ত। বাইরে থেকে যখন ডাক্তাররা ওটির ভেতরে প্রবেশ করেন। তখন তারাও ভালো করে জীবাণুনাশক দিয়ে হাত ধুয়ে অপারেশনের জন্য নির্ধারিত পোশাক পড়ে গ্লাভস-মাস্ক পরে ভেতরে প্রবেশ করেন। যাতে করে বাইরের কোন জীবাণু রোগীকে স্পর্শ করতে না পারে বা বাইরের কোন জীবাণু ভেতরে প্রবেশ না করে।

আমাদের অতি উৎসাহী মনোভাব এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। জাফর ইকবাল স্যারের ওপর হামলা মুহূর্তেই সারাদেশের আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়। তাই গণমাধ্যমকর্মীরাও নিজেদের চ্যানেল বা পত্রিকার টিআরপি বাড়াতে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে ছবি তুলতেও কার্পণ্য বোধ করলেন না। ক্যামেরার ফ্লাশের আলো একজন ওটিতে শয্যাশায়ী রোগীর ক্ষতি করে তা জানা সত্ত্বেও আমরা ছবি তুললাম। যে চিত্রগ্রাহক এ চিত্র ধারণ করলেন উনি কি ওটিতে নির্ধারিত পোশাক পড়ে প্রবেশ করেছিলেন? জানতে ইচ্ছে করে।

এদিন জাফর ইকবাল স্যারের মত একজন ভিআইপি ওটিতে থাকায় ডাক্তাররা নিরুপায় হয়ে বাধ্য হয়েছেন বাইরের লোকদের (ভিআইপিদের) ওটিতে অ্যালাও করতে। স্যারের ওটিতে থাকা একজন ডাক্তারের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেয়া স্ট্যাটাসে সে অসহায়ত্ব স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।

স্ট্যাটাসের অংশবিশেষ...

'খ্যাতির বিড়ম্বনা কাকে বলে, আজ হাড়ে হাড়ে টের পেলাম... এ রকম ভিআইপি ওটিতে থাকলে আসলে ওটির কন্ট্রোল আর আমাদের হাতে থাকে না... ওটি ভর্তি মানুষ, আসছে যাচ্ছে, ভাবখানা সবাই ভিআইপি, জাফর স্যার এর জন্য দরদ উপচে পড়ছে... গা ভর্তি গহনা আর লিপিসটিক দিয়ে কিছু মোটা মোটা মহিলা দেখলাম ... উনারা নাকি ভার্সিটির টিচার... সেলফি তুলছে ইচ্ছা মতো ... রাগ করে বলেই ফেললাম...

-- সেলফি তুলছেন কেন

-- আরে ডাক্তার সাহেব, আমি অমুক হলের প্রভোস্ট... এ অবস্থার একটা স্মৃতি থাকবেনা , কি বলেন... হে হে হে

রিভার্স হবার পর জাফর স্যার বললেন, আমি একটু ঘুমাব, ঘুমের কিছু দেন...

এমন সময় কোত্থেকে এক মহিলা দৌড়িয়ে আসলেন...

-- ওমা , স্যারের হুশ আসছে ... স্যার , আমি কাওয়া... সুজার বৌ... ভদ্রমহিলার নাম বোধ হয় কেয়া ... হাওকাও এর জন্য মনে হয় আমি শুনলাম কাওয়া... এর পর আসলেন মাননীয় মন্ত্রী... তিনিও খোঁজ খবর নিলেন... এর পর আরেক ভিআইপি লিডার... আসতেই আছে, আস্তেই আছে...

আমি জাফর স্যারের মাথার কাছে দাঁড়ানো, মনে মনে ভাবছি, কেমনে ঘুমাবেন আপনি...'

অপারেশন থিয়েটারে অবাধে মানুষের যাতায়াত। তাও জাফর স্যারের ওটিতে! হ্যাঁ, এটা সম্ভব হয়েছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে আমাদের মতো মানুষের বদৌলতেই। এর জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে কোনভাবেই এককভাবে দায়ী করা যাবে না। হয়তো এ ধরণের ভিআইপিদের এর আগে তাঁরা এভাবে চিকিৎসা দেয় নি। তাই এ ধরণের পরিস্থিতি কিভাবে সামাল দিতে হয় তা না জানাও এর একটা কারণ হতে পারে। এর দায় আমাদের সবার। আমরা কোনভাবেই তা এড়াতে পারি না। রক্তাক্ত জাফর স্যার বা পোস্ট অপারেটিভ জাফর স্যার, যিনি চেতনা-অচেতনার মাঝে আছেন তাঁর সাথে সেলফি তোলতে উন্মুখ ভার্সিটির শিক্ষিকা ও অমুক হলের প্রভোস্টরা। এদের কি এতোটুকু কাণ্ডজ্ঞানও নেই?

প্রথম আলোর যুব প্রকল্পের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান রোববার (৪ মার্চ) সকালে জাফর ইকবাল স্যারকে দেখতে গেলে সিএমএইচ কর্তৃপক্ষ উনাকে বসিয়ে চা খাওয়ান কিন্তু জাফর ইকবাল স্যারকে দেখতে ভেতরে ঢুকতে দেন নি। মুনির ভাই সেখানে থাকা অবস্থায়ই সেখানে যান তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। উনাকেও বসানো হয়, চা খাওয়ানো হয় কিন্তু ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয় না। এরপরই সেখানে আসেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মো. নাসিম ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। উনাদেরও বসানো হয়, চা খাওয়ানো হয় কিন্তু স্যারের সাথে দেখা করতে দেয়া হয় নি।

এই অবস্থা দুটি পর্যবেক্ষণ করলে আমরা সহজেই বুঝতেই পারি স্যার কতখানি অরক্ষিত ছিলেন সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এর জন্যই বোধ হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাফর ইকবাল স্যারকে দ্রুত সিএমএইচে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন।

কোন সেন্সে এইরকম অবস্থায় জাফর স্যারের সাথে সেলফি তোলার কথা চিন্তা করতে পারলেন ভাবা যায় না। একজন মানুষ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে, সারভাইভ করছে আর আমরা আছি তাঁর সাথে সেলফি তোলে সেই স্মৃতিকে তরতাজা করে রাখার ব্যবস্থায়। এতো দরদ, এতো পিরীত সবার জাফর স্যারের জন্য?

আচ্ছা আমরা কি কখনো এভাবে ভেবে দেখেছি, 'ধরুন আপনার মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-স্বামী বা সন্তান ঘটনাচক্রে কোন দুর্ঘটনায় হাসপাতালে ভর্তি। জরুরী ভিত্তিতে অপারেশন দরকার। অপারেশন হয়ে গেলে দরকার অপারেশনের ধকল কাটিয়ে উঠতে পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং ঘুম। আচ্ছা আপনি কি তখন তাকে দেখতে এভাবেই ওটিতে বা পোস্ট অপারেটিভে যাবেন, তাঁর সাথে সেলফি তুলবেন কথা বলবেন? সুস্থ মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞান বলে, 'না।' আমি বা আমরা তখন চাইবো আমাদের প্রিয় মানুষ বা কাছের মানুষ চাইবো যত দ্রুত সম্ভব সুস্থ হয়ে উঠুন আর ডাক্তাররা নির্বিঘ্নে তাঁর চিকিৎসা করুন।

কিন্তু জাফর ইকবাল স্যারের বেলায় আমরা সেটি করতে পারলাম না। স্যারের এই খ্যাতিই স্যারের এই বিড়ম্বনার জন্য অনেকটা অলিখিতভাবেই দায়ী যা হয়তো খোদ স্যারেরই প্রত্যাশিত ছিল না। নতুবা স্যার যখন বলছিলেন, আমি একটু ঘুমাব, ঘুমের কিছু দেন... এমন সময় জনৈক নারী দৌড়ে এসে বলতেন না আমি অমুক সুজার বৌ, এভাবে তাঁর পরিচয় দিতেন না। এদিন যেন সবাই নিজেকে প্রদর্শনে ব্যস্ত ছিলেন। নিজেকে প্রদর্শনের এক মহাসুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল অনেকের জন্য সেদিন। সবাই আসছেন আর যাচ্ছেন আসছেন আর যাচ্ছেন।

আপনারা যারা এমনটি করলেন তাঁরা সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। আচ্ছা আপনারা একবার ঠাণ্ডামাথায় ভাবুন তো, আপনারা কি করলেন? যা করলেন ঠিক করলেন? এটা করা কি আদৌ ঠিক হলো?

এ কথা বলার অবকাশ নেই যে জাফর স্যার দেশবরেণ্য লোক নন। জাফর স্যার আমাদের সবার খুবই প্রিয় একজন মানুষ। উনাকে নিয়ে আমাদের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা আছে। উনার বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটিয়ে নিজেকে স্রেফ প্রদর্শন করা আপনাকে কতটুকু মানালো? প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষীরা কখনোই চাইবে না উনার চিকিৎসা ব্যবস্থায় কোন ধরণের ব্যাঘাত ঘটুক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত