মাসকাওয়াথ আহসান

০২ এপ্রিল, ২০১৮ ১৭:২৩

ক্রসফায়ারে ফেইক নিউজ

বেশ কয়েকটি মূলধারার মিডিয়ায় এক বৃদ্ধা মা'কে রেলস্টেশানে ফেলে যাবার একটি খবর প্রকাশিত হয়। যেহেতু ঘটনাটি একজন মাকে নিয়ে; ফলে এখনও যেসব মানুষের মাঝে সামান্য মানবিকতা অবশিষ্ট আছে; গর্ভধারিণীর প্রতি কৃতজ্ঞতার আলোড়নটুকু আছে; তারা খবর শেয়ার করে তুমুল বিক্ষোভ করে।

পরে খবরটিতে যে মায়ের ছবি দেয়া হয়েছে; সেটি যে ভারতের বৃদ্ধাশ্রমের একজন দুখিনী মায়ের ছবি; তা ধরা পড়ে। বোঝা যায় খবরটি ফেইক।

একজন জাতির বিবেক এসে নসিহত করে, কান নিয়েছে চিলে বলে চিলের পিছে দৌড়ানোর কোন মানে হয়! এই ছাগলগুলি বোঝে না; এইরকম ঘটনা ভারতে ঘটে; বাংলাদেশে ঘটতে যাবে কেন! এই যে যারা ফেইক নিউজ শেয়ার করেছে; তাদের ক্রসফায়ারে দেয়া উচিত।

এই ফেইক নিউজ নিয়ে সংক্ষুব্ধ একজন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব হুংকার দিয়ে বলে, আসলে এই সাংবাদিকগুলি রয়্যাল বিসিএস কর্মকর্তাদের হিংসা করে। করবেই না কেন; সমাজে বিসিএস কর্মকর্তাদের যে বিপুল সম্মান এইটা সহ্য হয়না সাংবাদিকগো।

অমনি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের ভক্ত-আশেকানরা বলে, স্যার ও স্যার! এই সাংঘাতিকগুলি ছাগু। আর যারা শেয়ার করছে এই খবর তারা ছাগুর বাচ্চা। এইসবগুলিরে ক্রসফায়ারে দেয়া উচিত।

আরেক ভক্ত বলে, স্যার আফনে যেইরকম গাড়িতে চড়েন, লোকজন স্যালুট দেয়, আফনের অপিসে যে বিশাল টেবিল আর সিংহাসন, আফনে যেই রকম বিদ্যাশে সেমিনারে যান, কিংবা যেই রকম স্মার্ট আফনে; এইগুলির কোন কিছুই সাংবাদিক ফইন্নির পুতেদের নাইকা।

ভক্তদের জয়োল্লাসে আকাশ বাতাস মথিত হয়।

এক আপুমনি এসে চুকচুক করে বলে, এরা আসলে ভারতের স্টার জলসার নাটক দেইখা এইরকম আবেগি হইছে। আমি তো আমার শাশুড়ি আম্মাকে মাথায় করে রাখি। উনি বলেন, বৌমা তুমি আমার মেয়ের চেয়েও আমাকে বেশি ভালোবাসো।

অমনি আপুমনিকে এসে প্রশংসায় ভাসিয়ে দেয় ভক্তরা। আপু আপনি সাধারণে অসাধারণ। ঘরে ঘরে আপনার মতো পুত্রবধূ চাই। এক তরুণী ফেসবুক ইনবক্সে আপুমনির কাছে বলে, শ্রদ্ধেয়া আপু; কিছু টিপস দেবেন; কী করে শাশুড়ির মন পেতে পারি।

অমনি আপু ফেসবুকের পাবলিক পোস্টে মনো বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন। আজকাল মেয়েরা আমার কাছে অনেক পরামর্শ চায়; জানিনা কতটুকু করতে পারবো ওদের জন্য। আপনারা দোয়া করবেন।

আবার ভক্তরা আলোড়িত হয়। ক্যামনে পারেন আপু। আপনার মন আকাশের মতো উদার; পাহাড়ের মতো উচ্চ।

বার্তা সম্পাদক সিনিয়র সাব-এডিটরকে ডেকে জিজ্ঞেস করে, এরকম খবর সোর্স যাচাই না করে ছেড়ে দিলে কেন!

এক ব্যারিস্টার ফেসবুকে তার পোস্টে এই খবরটি জানায়। কথিত ছেলের লেখা চিঠিটি তার পোস্টে ছিলো। ছবিটি প্রতীকী হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। খুবই মর্মস্পর্শী খবর। আর যেহেতু কথিত মায়ের ছেলে-ছেলের স্ত্রীর নাম নেই; তাই খবরটা ছেড়ে দিয়েছি।

--সেই ব্যারিস্টার কোথায়!
--ব্যারিস্টারের পোস্ট ভাইরাল হবার পর লোকটা আইডি ডিএক্টিভেট করেছে।

বার্তা সম্পাদক বলে, তাহলে এখানে সম্ভাবনা দুটো; এটা ফেইক নিউজ তাই ব্যারিস্টার আইডি বন্ধ করেছে; অথবা খবরটা ঠিক; কিন্তু প্রভাবশালীদের ধমক খেয়ে আইডি ডিএক্টিভেট করতে বাধ্য হয়েছে।

সিনিয়ার সাব এডিটর জিজ্ঞেস করে, খবরে কোন নাম নেই কথিত অপরাধী সন্তান আর তার স্ত্রীর। কিন্তু এতে এতো সংক্ষুব্ধ হবার কারণ কী! প্রতীকী গল্প হিসেবেও তো এটা সমাজ বাস্তবতা।

--আসলে সমস্যা হচ্ছে "মায়েদের ট্র্যাজিক বাস্তবতা"র চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ; পেশাজীবী অনুভূতি। এই সমাজে নাপিত থেকে সুশীল সবাই পেশানুভূতিতে ভুগে। মানুষ আত্মপরিচয় থেকে কোন খবর দেখার প্রস্তুতি কারোরই নেই। ফেসবুকে যারা এ খবর শেয়ার করেছে তারাও এটাকে একজন "মায়ের ট্র্যাজেডি" হিসেবে না দেখে "শুধুই ম্যাজিস্ট্রেট ছেলে বা ছেলের বউ" এমন অপরাধ করে এভাবে খবরটাকে ট্রিট করেছে। আবার ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবেরাও কথিত ঘটনাকে "বৃদ্ধা মায়ের অসহায়ত্বের" সামগ্রিক বাস্তবতা হিসেবে না দেখে "বিসিএস-অনুভূতিতে" আঘাতটাকেই গুরুত্বপূর্ণ করে দেখেছে।

সিনিয়র এডিটর ভুল খবর প্রকাশের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে। বার্তা সম্পাদক বলে, সাংবাদিকের জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ ক্রেডিবিলিটি। আস্থা বা বিশ্বাসযোগ্যতা হারানো মানে সব হারানো। যাও ভুল খবর প্রকাশের জন্য ক্ষমা চেয়ে একটি খবর ছাড়ো।

" ভুল খবর প্রকাশের জন্য দুঃখ প্রকাশ"

প্রিয় পাঠক, রেল স্টেশানে বৃদ্ধা মাকে ফেলে যাওয়ার খবরটি ভ্রান্ত। নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমাদের এই অত্যন্ত মানবিক সমাজে এরকম ঘটনা ঘটার কোন প্রশ্নই ওঠে না। প্রত্যেকে তার বৃদ্ধা মাকে মাথায় করে রাখে। যারা এ খবর শেয়ার করেছেন বা এ খবরে ক্ষুব্ধ হয়েছেন তারা সবাই মাতৃভক্ত বায়েজিদ বোস্তামি। মা ঘুমিয়ে গেলে শিয়রে পানির গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কিংবা ঈদে-পূজায় মায়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য বিদ্যাসাগরের মতো নদী সাঁতরে নিজের জীবনকে বিপন্ন করে।

আর আমাদের সমাজের পুত্রবধুরা শাশুড়িকে নিজের মায়ের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। নিজের মাকে সুতির শাড়ি উপহার দিলে শাশুড়িকে জামদানি উপহার দেয়। তাদের মতো এতো ভালো পুত্রবধু বিরল।

এরকম একটি আদর্শ-সর্বৈব সুন্দর বাস্তবতায় এরকম ভুল খবর প্রকাশ গর্হিত অপরাধ হয়েছে।

অবশ্য খবর প্রকাশের দিনটি এপ্রিলের এক তারিখ ছিলো। এইদিন আমরা নিজেরাই নিজেদের বোকা বানিয়েছি। আমরা নিজেদেরকেই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছি বৃদ্ধাশ্রমে বা রেলস্টেশানে পরিত্যক্ত মায়েদের বেদনার চেয়েও আমাদের নিজেদের সম্মানটা অনেক বড়।

  • মাসকাওয়াথ আহসান: সাহিত্যিক, সাংবাদিক।
  • [প্রকাশিত লেখার মন্তব্য, দায় লেখকের নিজস্ব]

আপনার মন্তব্য

আলোচিত