মাসকাওয়াথ আহসান

০৯ এপ্রিল, ২০১৮ ১৯:১২

কোটার ভ্রমর ও বঙ্গপাঞ্জাবির দিনগুলি

রম্য

এতোগুলো তরুণ-তরুণীর রক্তাক্ত মুখমণ্ডল, ফেটে যাওয়া মাথার পেছন দিয়ে ফিনকি দিয়ে বের হওয়া রক্ত, কিংবা টিয়ার গ্যাসে চোখের কোণায় জমাটবাধা রক্ত; এসব কিছুই চোখে পড়েনা সাংবাদিক মহোদয়ের। আইন-শৃঙ্খলার প্রশ্নে অবিচল সে। ঘরের মধ্যে পায়চারি করে আর বারবার বলে, ভিসির বাড়িতে পাকিস্তানি সেনাদের মতো হামলা কেন! তবে কী আইএস আই এর ষড়যন্ত্র! সাংবাদিক মহোদয় ফোন করে সবসময় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আর উন্নয়ন সুসংবাদের একমাত্র সংবাদসূত্র "হ্যাপি ইনসাইডারে"র সম্পাদক মহোদয়কে।

সাংবাদিক মহোদয়ের এসিডিটি পেইন বেড়েছে; বার বার গাল ফুলিয়ে কিছুটা গ্যাস বের করে দিচ্ছে আবার মুখ খুলে। গত কয়েকটা বছর রাষ্ট্রীয় ভোজসভার রিচ ফুড খেয়ে সাংবাদিক মহোদয়ের চর্বি জমেছে; কিন্তু পাকস্থলিটা গেছে। অবশ্য দেশপ্রেমের নজির হিসেবে সাংবাদিক মহোদয় বলে, পাকিপ্রেমিরা পাকস্থলি বলে, আমি বলি বঙ্গস্থলি। লোকজন ভাই ভাই দাদা দাদা বলে এতো খুশীজল খাইয়েছে যে লিভারটাও গড়বড় করছে। কিন্তু তাই বলে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের সময় অসুস্থতার অজুহাত কাজে আসে না।

সাংবাদিক মহোদয়ের ফোন পেয়েই হ্যাপি ইনসাইডারের সম্পাদক অনুসন্ধানে নেমে যায়। অভিজ্ঞ সাংবাদিক গভীর ভৌমিককে ফোন করে।

গভীরদা ক্ষেপে যায়, নাহ তোমাদের আর কোন উপকার করবো না। সোর্স ইজ মাই গড। আমার সোর্স কখনো মিথ্যে বলে না। কত পরিশ্রম করে তোমাদের নেতার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করলাম। সেই আমাকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার "র" তকমা এঁটে দিলো তোমাদের লোকেরা। আমি চার-যুগ সাংবাদিকতা করছি। ছেলে খেলা পেয়েছো!

তবুও হ্যাপি ইনসাইডারের সম্পাদক মহোদয় হাল ছাড়ে না। অনুসন্ধান চলতে থাকে। ছাত্র-ছাত্রীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে সরকার পতন আন্দোলন হিসেবে প্রমাণ করে একটা হ্যাপি নিউজ পাবলিশ করা সময়ের দাবি।

ফেসবুকে একজন তৈলচিত্রকর আক্ষেপ করে। মঙ্গল শোভা যাত্রার প্রস্তুতিলগ্নে চারুকলা ইন্সটিটিউটে ঢুকে ভাংচুরের সঙ্গে আমি কোন কোটা সংস্কারের তাগিদ দেখিনা। যা দেখি তা হচ্ছে মৌলবাদিদের আস্ফালন।

একটা ছেলে এসে মৃদু কণ্ঠে বলে, ভাই আপনি ভুল বুঝছেন; এটা কেবলই কোটা সংস্কার আন্দোলন।

অমনি প্রতিমন্তব্যে; চুপ কর ছাগু কুনহানকার; মুঙ্গলশুভাযাত্রার অর্থ তুই কী বুঝিস!

তৈলচিত্রকর রেগে গিয়ে বলে, আমার পোস্টে কোন চিংকু-বাম, বামাতি, দেশের শত্রু দেখতে চাইনা। ওভার এন্ড আউট।

একজন মুক্তিযোদ্ধার ছেলে ফেসবুকে লেখে, আমার আব্বা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আমরা ছয় ভাই; আমাদের কারো মুক্তিযোদ্ধা কোটার প্রয়োজন হয়নি। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে অযথা সরকারি চাকরির ইঁদুর দৌড়ে নামিয়ে দেবার প্রয়োজন নেই। চাইলে কতভাবেই তাদের সম্মানিত করা যায়; সহযোগিতা করা যায়। তা না করে তাদের জন্য অসম্মান ডেকে আনা ঠিক নয়। অন্যান্য কোটাগুলোও সংস্কার করা জরুরি। যুগের পর যুগ কোটা পদ্ধতি চলতে পারে না।

সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট জোগাড় করা এক পরিবারের ছেলে ঐ পোস্টে এসে মন্তব্য ঠুকে দেয়, যাদের বাপ-দাদারা একাত্তরে যুদ্ধে যাওয়ার সাহস দেখাইতে পারে নাই; তাগো এই দ্যাশে কুনো অধিকার নাই। আফনে তাদের পক্কে কতা বলতেচেন কেনু। বুজছি, একজন রাজাকার সারাজীবন রাজাকার, কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধা সারাজীবন মুক্তিযোদ্ধা না-ও হইতে পারে।

কোটার আরেক ভ্রমর এসে মন্তব্য করে, ডেম শিট! যারা এতো মেধাবি তাগো সরকারি চাকরি করনের কী দরকার! গবেষণা করুক, লেখালেখি করুক তারা।

একজন শিক্ষক এ আমলে সুযোগ-সুবিধা নিয়ে সরু কোমরে চওড়া বেল্ট বেঁধে ঘুরছে। সে অতীব উত্তেজিত হয়ে বলে, এই সাপগুলিরে পুলিশ পিটাইছে; খুব খুশী লাগতেছে।

ফেসবুকের চলন্ত ইতিহাস কোষ এসে পড়ে তার বয়ান নিয়ে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ৩০ শতাংশ লোক পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিয়েছিলো। তারা এখনও পাকিস্তানের কনফেডারেশানে যোগ দিতে চায়। এইকারণে নানাছলে তারা আসে। মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়া এতো কেন চুলকায়; আমি তাহা বুঝি।

এইসব তেলের বিনিময়ে খাদ্য (তেবিখা) প্রকল্পে ঘাড়ে-তলপেটে চর্বি বেড়ে যাওয়া ধেড়ে ইঁদুরগুলো ঠিক পাকিস্তান আমলের পাঞ্জাবের ক্ষমতা কাঠামোর তেবিখা প্রকল্পের ধেড়ে ইঁদুরদের মতো হয়ে গেছে যেন। বৈষম্যের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর তীব্র অসহযোগ আন্দোলনে পাঞ্জাবের ধেড়ে ইঁদুরদের আশংকা জাগতো; ক্ষমতা চলে গেলে মোরগা-মোসাল্লাম খেয়ে খলবল করতে ঘুরতে পারবো তো! এই দুশ্চিন্তায় তারা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে এসে ৩০ লাখ মানুষ খেয়ে যায়।

ঠিক সেইরকম নরভোজি চিন্তা এযুগের বঙ্গ-পাঞ্জাবিদের। ক্ষমতা চলে গেলে মোরগা-মোসাল্লাম খেয়ে খলবল করে ঘুরতে পারবো তো! এই দুশ্চিন্তায় নানা-রঙ্গের পাঞ্জাবি পরে ঘুরে ঘুরে কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের সন্তানদের খেয়ে বেড়ায়। খরখরে জীবন বাস্তবতা থেকে যোজন যোজন দূরে বসবাসকারী কেউ কেউ প্রশ্ন করে কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের সন্তানদের উদ্দেশ্যে, সরকারি চাকরি না পেলে এরা ভাতে মরবে; কিন্তু বিরিয়ানি খাইতে কেউ তো নিষেধ করে নাই!

  • [প্রকাশিত লেখার চরিত্র, দৃশ্যায়ন, সংলাপে কারও সাথে কারও মিল পাওয়া গেলে সেটা নেহায়েত কাকতাল। মন্তব্য, মতামত ও দায় লেখকের নিজস্ব]

আপনার মন্তব্য

আলোচিত