মাসকাওয়াথ আহসান

০৯ মে, ২০১৮ ১৯:৩০

জাফর ইকবালের বিরুদ্ধে জনরোষ তৈরির কালোচেষ্টা

শিক্ষাবিদ জাফর ইকবালের সঙ্গে একজন তরুণ দেখা করতে গেলে তার কথা-বার্তা ও আচরণে তাকে অসংলগ্ন মনে হলে তাকে পুলিশের মাধ্যমে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেয়া হয়। এটি হঠাত ঘটা কোন ঘটনা নয়। কিছুদিন আগেই একজন ছাত্র জাফর ইকবালকে পেছন থেকে ছুরি মেরে হত্যার চেষ্টা করেছিলো। একজন শিক্ষক সবসময়ই চান বিশ্বাস করেই তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে মিশতে। কিন্তু সে বিশ্বাস তরুণদের কেউ ভঙ্গ করলে একটি হত্যা প্রচেষ্টার ক্ষত শরীরে ও মনে নিয়ে পরবর্তীতে তরুণদের সঙ্গে কিছুটা সচেতনতা নিয়ে মেশাটাই বাস্তবানুগ। যেটি জাফর ইকবালের ক্ষেত্রে দেখা করতে আসা এক তরুণকে সন্দেহ করার ক্ষেত্রে ঘটেছে।

প্রথম ঘটনায় আহত অবস্থায় জাফর ইকবাল অনুরোধ করেছেন, হামলাকারী তরুণকে যেন মারধোর না করা হয়। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সন্দেহভাজন মনে হলে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের পর তরুণটিকে মুক্ত করে দেয়ার ব্যাপারে জাফর ইকবাল মনোযোগী ছিলেন। নিজের নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলে জাফর ইকবাল তরুণদের বিশ্বাস করতে চেয়েছেন। কোথাও সংশয় উপস্থিত হলে তার সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চেয়েছেন মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ধরে রেখেই।

এই ঘটনাটিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটি গোষ্ঠী একটি কালো প্রচারণা তৈরি করতে চেয়েছে এভাবে; "একটি তরুণ স্যারকে "নামাজ পড়েন কীনা" জিজ্ঞেস করাতেই উনি তাকে পুলিশের হাতে দিয়েছেন"।

এই প্রচারণার প্যাটার্ণটি খুব পুরোনো। আমাদের গ্রামীন সমাজে সামাজিক পুলিশীর মাধ্যমে কাউকে "কাফের" বলে চিহ্নিত করার প্রবণতা বক-ধার্মিক ও তাদের সন্নিহিতদের মাঝে দেখা যায়। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ'র লালসালু উপন্যাসের ভণ্ড পীর মজিদ কিংবা গ্রামের মাতবরটির মধ্যে এই "নামাজ পড়েন মিয়া" বলে নিজের কতৃত্ব জাহিরের ছবিটি দেখা যায়।

ফেসবুকে একজন সনাতনধর্মী লেখক নিজে সনাতনধর্মী হয়েও "নামাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল" কিন্তু "জাফর ইকবাল স্যার মুসলমান ঘরের ছেলে হয়েও "নামাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল" নন; এমন একটি প্রতিতুলনা টেনেছেন।

এই বক্তব্য সুস্পষ্টভাবেই ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠীকে ইমোশনালি ব্ল্যাক মেইল করে জাফর ইকবালের প্রতি ক্ষেপিয়ে তোলার অপচেষ্টা হিসেবে দৃশ্যমান। সে কারণেই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা জরুরি মনে করছি। ২০১৮ সালের সমাজে একজন কথিত ইসলাম অন্ত সনাতনধর্মী এসে ইসলাম ধর্মের অনুভূতি রক্ষার ও নামাজের স্বপ্রণোদিত পাহারাদার হয়ে একজন ইসলাম ধর্মী মানুষ "নামাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন" বলে ফতোয়া দিলে বিস্মিত তো হতেই হয়।

প্রায় ৯২ শতাংশ মুসলমানের দেশে ইসলাম ধর্ম নতুন করে রক্ষার কিছু নেই। আর ইসলামে আল্লাহ এবং তার বান্দা এই দুজনের মাঝে তৃতীয় কোন ব্যক্তির কতৃত্ব বা পুলিশির অনুমোদন নেই। একজন মানুষ তার ধর্মীয় বিশ্বাস, নৈতিকতা, দর্শন, ধর্মের অনুশীলন এবং প্রার্থনার ক্ষেত্রে সরাসরি আল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। সেখানে সনাতনধর্মী একজন ব্যক্তির মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি নিয়ে উপস্থিত হয়ে জাফর ইকবাল "নামাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল কীনা" এরকম প্রশ্ন তুলে তাকে জনরোষের মুখোমুখি করে তোলা সীমাহীন ঔদ্ধত্য বলেই প্রতীয়মান হয়।

পবিত্র কুর-আন অনুবাদের ক্ষেত্রে একজন কৃতি সনাতন ধর্মী মানুষের অবদান রয়েছে। আবার সনাতন ধর্মীদের শ্যামা সংগীত রচনায় একজন কৃতি ইসলামধর্মী মানুষের অবদান রয়েছে। দুটি ধর্মের সত্য-সুন্দর-মঙ্গলের চর্চা সম্মিলিতভাবে সবাই করতে পারে। সনাতন ধর্ম ও এর অনুবর্তীদের ব্যক্তিগতভাবে আমার খুবই ভালো লাগে। কিন্তু তাই বলে আমি যদি এখন কোন সনাতন ধর্মী মানুষ "পূজার প্রতি শ্রদ্ধাশীল" কীনা এ প্রশ্ন তুলে তাকে জনরোষের মুখে ফেলতে চাই তা হবে সীমাহীন ঔদ্ধত্য।

জাফর ইকবালের বিরুদ্ধে মুসলমানদের ক্ষেপিয়ে তোলার জন্য লেখা ঐ সনাতনধর্মী লেখক নিজেই তার সনাতনধর্মী আত্মপরিচয় তুলে ধরে "হিন্দু হয়েও আমি নামাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ; অথচ উনি নন" এরকম ন্যারেটিভ তৈরীর চেষ্টা করার কারণেই আমি তার অনধিকার চর্চার বিষয়টি বিশদে ব্যাখ্যা করলাম।

তবে ইসলাম ধর্মের প্রতিটি অনুসারীর আত্মসমর্পণ ও বোঝাপড়া কেবল আল্লাহর সঙ্গে। এর মাঝে ইসলাম ধর্মীয় কোন ঠিকাদার অপ্রয়োজনীয়। আর সনাতন ধর্মী "ইসলাম ধর্মে"-র ঠিকাদার রীতিমত হাস্যউদ্দীপক। আজকের এই পপুলিজম বা জনমনোরঞ্জনের আবেশে বুঁদ সমাজে ধর্মীয় অনুভূতির জিকির তুলে সস্তা জনপ্রিয়তার মোহ প্রাণঘাতি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধুত্ব ও সামাজিক সুবিচারের জন্য আদর্শ বিকল্প গণমাধ্যম। তাই এখানে মানবঘাতী কর্মকাণ্ড সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করা জরুরী। কারো বিরুদ্ধে জনরোষ তৈরি করে ঐ ব্যক্তিকে হত্যা প্রচেষ্টার যে কোন প্রবণতাকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত