অপূর্ব শর্মা

২০ মে, ২০১৮ ০০:২৭

রক্তেরাঙা উনিশে মে

‘দুইজনই বাঙালি ছিলাম, দেখ দেখি কাণ্ডখান, তুমি এখন বাংলাদেশি, আমারে কও ইন্ডিয়ান!.../ দুজনাই বাঙালি বন্ধু, বাংলা দুইজনারই জান/দুইয়ের মুখেই বাংলা কথা, দুইয়ের গলায় বাংলা গান ’-প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের এই গান ভৌগলিক সীমারেখায় বিভক্ত বাংলামায়ের সন্তানদের উদ্দেশ্যে লেখা।

এপারবাংলা ও ওপারবাংলায় অবস্থান থাকলেও বাংলাই আমাদের মুখের ভাষা, প্রাণের ভাষা! আর এই ভাষা রক্ষায় দুই বঙ্গের বাঙালিদেরকেই রক্ত দিতে হয়েছে। আন্দোলন করতে হয়েছে। ’৫২-তে রক্ত ঝরেছে ঢাকার রাজপথে। আর ’৬১-তে আসামের শিলচরে, বরাক উপত্যকায়। তবে, ওপার বাংলায় মায়ের ভাষাকে রক্ষায় যে এগারোটি তাজা প্রাণ উৎসর্গিত হয়েছে তাদের প্রত্যেকেরই আদি নিবাস বাংলাদেশে। প্রতিবছর ১৯ মে, আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারির মতোই উদযাপিত হয় ওপার বাংলায়। সেখানেও বিউগলে বাজে করুণ সুর। শহীদদের উদ্দেশ্যে গীত হয়-‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’, কিংবা ‘শোনো ডাকে ওই একাদশ শহীদেরা ভাই...’। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, সেই আত্মত্যাগের, সেই বলিদানের কথা এপার বাংলার অনেকেই জানেন না!

‘জান দেবো তবু জবান দেবনা।’- বাংলাভাষার দাবিতে কাছাড়ের বাঙালিদের শ্লোগান ছিল এটি- প্রত্যয়ের ব্যত্যয় ঘটেনি। জীবন দিয়েছিল তারা, জবান দেয়নি। সেই বলিদানের বদৌলতে তারা পেয়েছে মুখের ভাষা, বাংলাভাষা। একটি ভাষার জন্য, দুটি দেশের মানুষের বলিদানের নজির বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। আর সেই ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে বাঙালিরা।

বরাক নদীর উৎস ভারতে, সেই বরাক নদীই আমাদের দেশে প্রবেশ করেছে সুরমা আর কুশিয়ারা নামে। বরাকের জলধারাই প্রবহমান এই দুই নদী দিয়ে। তার গতি স্বাভাবিক নিয়মেই ভাটির দিকে। নদীর স্রোতধারা তো উজানে বয় না। কিন্তু আন্দোলনের ঢেউ যদি উজানে প্রবাহিত হয়? তাহলে কি এর তীব্রতা হবে কয়েকগুণ বেশি! সুরমার তীরসহ বাংলার ভাষা আন্দোলনের তীব্রতা কি প্রবহমান জলধারাই নিয়ে গেল উজানে, বরাক উপত্যকায়; তাও আবার ৯ বছর পর! সেই তরঙ্গই কি রূপ দিলো আরেকটি ভাষা আন্দোলনের? তার ফলশ্রুতিতেই কি বরাকবাসীর স্বীকৃতি পেলো বাঙলার? হয়ত! তবে এই স্বীকৃতি অর্জনের পথে মহান একুশে ফেব্রুয়ারির মতো আরেকটি ভাষা আন্দোলনে বাংলা মায়ের বীর সন্তানদের রক্তে রঞ্জিত হলো শিলচর।

ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় অসম রাজ্যের অন্তর্গত বাংলাভাষী ভূ-খণ্ড বরাক উপত্যকার মধ্যে রয়েছে করিমগঞ্জ হইলাকান্দি, বদরপুর, শিলচর প্রভৃতি বাঙালি অধ্যুষিত শহর। দেশ বিভাগের আগে অবিভক্ত সিলেট জেলাসহ এই বরাকের অধিবাসী বাঙালিরাই পুরো আসাম প্রদেশের নেতৃত্ব দিয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় অবশেষে তাদের পরিচয় হয় ভাষিক সংখ্যালঘু হিসেবে। তবে এরও পূর্বে লাইন প্রথার মত বিভেদকামী ব্যবস্থা ছিল আসামে। এর বিরুদ্ধে বাঙালি মুসলমানরাই অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে আন্দোলন করেছেন। শুধু তাই নয় ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় বাঙালিরা বার বার উচ্ছেদ আন্দোলনের শিকার হয়েছে। অসমীয়দের অত্যাচারে কোন জাতিই স্বস্তিতে ছিল না। প্রাচীন ভারতের এ রাজ্যটি আগে থেকেই নানা জনজাতি উপজাতি বহুভাষা ও ধর্মের সমন্বয়ে গঠিত ছিল। একসময় সেটা উগ্র অসমীয় জাতীয়তাবাদে রূপ নেয়। তাদের আগ্রাসী মনোভাবে অন্যান্য জাতি স্বত্বার অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখিন হয়ে পড়ে। ফলত অন্যান্য সম্প্রদায়কে অনেকটা বাধ্য হয়েই নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য রাজপথে নামতে হয়, গ্রহণ করতে হয় সংগ্রামের পন্থা। অবিভক্ত অসম রাজ্য ভেঙে একে এক তৈরি হয় মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মেঘালয় ও অরুণাচল রাজ্য।

সংখ্যায় বাঙালিরা অসমের এক বিশাল জনগোষ্ঠি। নিজেদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার তাগিদেই তারা অসমীয়কে সরকারি ভাষা মেনে নিয়ে বাংলা ভাষাকে পাশাপাশি প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন শুরু করে। পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলনের মতই তাদের আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। অন্য ভাষাভাষী গোষ্ঠিও বাঙালিদের এ আন্দোলনকে সমর্থন করে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এ আন্দোলনকে গণতান্ত্রিক আন্দোলন রূপে সংগঠিত করতে সহযোগিতা করে। তবে সব কিছুই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় যখন কংগ্রেস প্রদেশ সরকার ওই সর্বনাশা ভাষা বিলে সম্মতি প্রদান করে। এতে করে আন্দোলনকে চূড়ান্ত রূপ দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকেনা বাঙালিদের। বাধ্য হয়েই বাঙালিরা প্রতিরোধের ডাক দেয়। বরাক তীরের বাঙালিরা দৃপ্ত শপথ গ্রহণ করে যেকোনো মূল্যে মায়ের ভাষাকে সমুন্নত রাখার। আন্দোলনের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। অসমের খাসিয়া, গারো, বোরো, মিশামী, ডিমসা, মণিপুরি, বিষ্ণুপ্রিয়াসহ সংখ্যালঘু প্রায় জনগোষ্ঠিই এতে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন প্রদান করে। আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠে। প্রতিবাদ, ধর্মঘট, সভা সমিতির মাধ্যমে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলনের দাবানল।

আন্দোলনে নামার প্রেক্ষাপট নিয়ে অল্পবিস্তর আলোচনা করা প্রয়োজন। ‘১৯৬০ সালের ২১ এবং ২২ এপ্রিল আসাম প্রদেশ কংগ্রেস প্রস্তাব গ্রহণ করে ‘অসমীয়াকে রাজ্য ভাষা করতেই হবে।’ আসামের মুখ্যমন্ত্রী তখন বিমলাপ্রসাদ চালিহা। তিনি এই প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে বলেন, দাবীটা রাজ্যের অনসমীয়াবাসীদের নিকট থেকে আসুক। কিন্তু মাস দুয়েক যেতে না যেতেই বিধান সভায় তিনি ঘোষণা করেন 'অসমীয়াকে রাজ্যভাষা করার জন্য সরকার শিগগিরই একটি বিল আনছেন।’

উগ্র জাতীয়তাবাদীদের তাণ্ডব তখন গৌহাটি গোরেশ্বরে ছড়িয়ে পড়েছে। রাজ্যভাষা করার নামে সাম্প্রদায়িক আন্দোলন গড়ায় ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায়।

২ জুলাই, শিলচরে ডাকা হয় ‘নিখিল আসাম বাঙলা ও অন্যান্য অনসমীয়া ভাষা সম্মেলন’। প্রতিনিধিদের মধ্যে ছিলেন লুসাই-খাসিয়া-গারো-মণিপুরি, বাঙালি সবাই। সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব গৃহীত হয়- ‘ভাষা প্রশ্নে স্থিতাবস্থা বজায় থাকবে।’ কেন্দ্রের কাছে প্রার্থনা জানানো হলো- ভাষার প্রশ্নে হস্তক্ষেপ করুন।

ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় নরমেধ যজ্ঞ শুরু হলো। দাঙ্গা-বিধ্বস্ত এলাকা ছেড়ে সংখ্যালঘুরা পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরবঙ্গ ও কাছাড়ে পালাল। চালিহার বিশেষ একটা দিক ছিল বিশেষ কোন সঙ্কট মুহূর্ত এলে হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়তেন। সে সময়ও তাই হলো। পুলিশ পক্ষপাতমূলক আচরণ করলো। স্থানে স্থানে দাঙ্গাকারী আর পুলিশ এক হয়ে আক্রমণ চালালো। তাদের বর্বরতা পশুর হিংস্রতাকে ছাড়িয়ে গেল।

১৯৬০ সালের পনরো আগস্ট। কলকাতা শোক দিবস পালন করল। উগ্রজাতীয়তাবাদী বর্বরতার প্রতিবাদে সরকারি-বেসরকারি সমস্ত অনুষ্ঠান বর্জন করা হল। পরবর্তী লোকসভা অধিবেশনে আলোড়ন উঠলে, পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা উত্তেজনায় ফেটে পড়ল। প্রধানমন্ত্রী নেহেরু শান্তি দূত পাঠালেন গোবিন্দবল্লভ পন্থকে। পন্থজী ফরমুলা দিলেন। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা নির্দ্বিধায় তা নাকচ করে দিল।

কাছাড়বাসীর প্রতিনিধিরা ছুটলেন দিল্লী। দিল্লী নির্বিকার। ১৯৬০ সালের ১০ই অক্টোবর রাজ্যভাষা বিল পাশ হয়ে গেল আসাম বিধান-সভায়। নতুন আইনে সমগ্র আসামে সরকারি ভাষা হলো অসমীয়া। শুধু কাছাড়ের জন্য জেলান্তরে রইলো বাংলা ভাষা।

সমগ্র কাছাড় থেকে প্রতিবাদ সোচ্চার হয়ে উঠল- এ রাজ্য ভাষা বিল আমরা মানি না, মানবো না। বাংলাকে অন্যতম সরকারি ভাষা করতে হবে।

১৯৬১ সালের ১৫ জানুয়ারি। শীলভদ্র যাজীকে সভাপতি করে করিমগঞ্জে সম্মেলন ডাকা হল। শিলচর সম্মেলনের প্রস্তাব নতুন করে ঘোষণা করা হল। সমগ্র কাছাড় জেলায় বিক্ষোভ দানা বেঁধে উঠল। ভাষার প্রশ্নে সমগ্র কাছাড় এক মন এক প্রাণ হয়ে শপথ নিল- জান দেবো তবু জবান দেবো না। মাতৃভাষার মর্যাদা যে কোন মূল্যের বিনিময়ে রক্ষা করবোই।

কাছাড়ের যৌবন তরঙ্গ টগবগ করে উঠল। তবু আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে শেষ চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কি! আবার ডাকা হলো সম্মেলন। ৫ ফেব্রুয়ারি, করিমগঞ্জ রমণীমোহন ইন্সটিটিউটে কাছাড় জেলা জনসম্মেলন আহবান করা হল। সম্মেলনের একমাত্র দাবি ‘বাংলাকে আসামের অন্যতম রাজ্য ভাষা রূপে মানতে হবে।’ আসাম সরকারের কাছে চিঠি পাঠিয়ে ১৩ এপ্রিলের ভেতর শেষ জবাব চাওয়া হল।

১৩ এপ্রিলের মেয়াদ শেষ হলেও আসাম কংগ্রেস সরকার রইল নিরুত্তর। অতএব সমরে ঝাঁপিয়ে পড়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। ঘরে ঘরে সংগ্রাম পরিষদের স্বেচ্ছাসেবকবাহিনী তৈরি হতে লাগলো। এক নতুন মন্ত্রে দীক্ষিত হতে লাগলো গোটা কাছাড়।

একটি ঐতিহাসিক তারিখ ঘোষিত হলো ১৯ মে ১৯৬১ সাল। ১৮ই মে, নিঃসন্দেহে সেদিনটিও ছাত্র প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে স্মরণীয়। ছাত্র সমাজের ডাকে করিমগঞ্জ শহরে যে শোভাযাত্রা বের হয় তা নিঃসন্দেহে গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। সর্বস্তরের মানুষ সেদিন ভুলে গিয়েছিল এ ছিল শুধু ছাত্র সমাজের শোভাযাত্রা। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা যোগ দিয়েছিল মাতৃভাষার ডাকে সেই শোভাযাত্রায়।

শাসকগোষ্ঠীও শক্তির পরিচয় দেখাতে পিছ পা হননি। সমগ্র জেলার ব্যাটালিয়নের পর ব্যাটালিয়ন সৈন্য দিয়ে ছেয়ে ফেলা হল। জারি করা হলো সমগ্র জেলায় ১৪৪ ধারা। রাস্তায় রাস্তায় নামানো হলো মিলিটারি আর টহলদার বাহিনী। সন্ত্রাস জাগিয়ে তোলার অপচেষ্টা শুরু হল।

করিমগঞ্জের সংগ্রাম পরিষদের দুই নেতা রথীন্দ্রনাথ সেন ও নলিনীকান্ত দাসসহ ছাত্রনেতা নিশীথরঞ্জন দাসকে ১৮ মে গ্রেপ্তার করে শিলচর নিয়ে যাওয়া হলো। ভাষা আন্দোলনের ডাক গোটা কাছাড়ের চেহারা পালটে দিয়েছিল তাই এ গ্রেপ্তারে প্রত্যেকটি জনপদ গ্রাম যেন বিক্ষোভে আরও ফোঁসে উঠলো। সহস্র বলিষ্ঠ কণ্ঠে আওয়াজ উঠলোÑ মাতৃভাষা-জিন্দাবাদ। মৃত্যুর সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য গোটা কাছাড় প্রস্তুত হয়ে রইলো।

১৯ মে ভোর চারটা থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত হরতালের ডাক দেয় কাছাড় জেলা সংগ্রাম পরিষদ। যেভাবে হোক ট্রেনের চাকা চলতে দেওয়া হবে না। বিমানঘাঁটিতে বিমানের পাখা ঘুরবে না। অফিসের তালা খুলবে না।

ভোর হতেই শত শত সত্যাগ্রহী বসে পড়লো রেল লাইনের উপর। বিমানঘাঁটিতে রানওয়ের উপর শোয়ে পড়লো সত্যাগ্রহীরা। সারি সারি দাঁড়াল অফিসের গেটের সামনে। শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি, পাথারকান্দি, বদরপুর সব ক’টি জায়গায় সত্যাগ্রহীরা শান্তিপূর্ণ উপায়ে কর্তব্য পালনে প্রস্তুত।’

কতটা স্বতঃস্ফূর্ত ছিলো সেদিনের ধর্মঘট তা শোনা যাক লেখক অলক রায়ের জবানীতে। তিনি ‘ভাষা আন্দোলনে কাছাড়’ বইয়ে লিখেছেন- ‘করিমগঞ্জ রেল-স্টেশন। ভোরের ট্রেন আটকাতেই হয়। সত্যাগ্রহীরা রেল-লাইন আগলে বসলো। কয়েকজন আবার রেল-লাইনের উপর উপুড় হয়ে শোয়েও পড়লো। রেলের চাকা যদি চলে ওদের উপর দিয়ে পিষে বেরিয়ে যায় যাক ক্ষতি নেই। আচমকা পুলিশ ওদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো উদ্যত লাঠি হাতে। পেটাতে লাগলো। কিন্তু সত্যাগ্রহীদের রেল লাইন থেকে সরাতে পারলো না। সত্যাগ্রহীদের শ্লোগানে চারদিক মুখর হয়ে উঠলো- মাতৃভাষা জিন্দাবাদ। ‘জান দেবো, তবু জবান দেবো না।’ এবারে আরও নৃশংস হয়ে উঠলো কংগ্রেস সরকারের পুলিশ বাহিনী। সঙ্গিন উঁচু করে ধেয়ে এলো সত্যাগ্রহীদের দিকে। কিন্তু না, সত্যাগ্রহীরা লাইন আঁকড়ে ধরে পড়ে আছে। সঙ্গিন খোঁচায় সত্যাগ্রহীদের শরীর রক্তাক্ত হয়ে উঠলো। মুখে তাদের মাতৃভাষা-জিন্দাবাদ।

ট্রেন আটকাতে অসংখ্য মেয়েরা এসেছে। সত্যাগ্রহী ভাইদের সাথে ওরাও মাতৃভাষার যুদ্ধে সামিল। আর একটি পুলিশ বাহিনী এসে এবার মেয়েদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। মাথায় তাদের রাইফেলের আঘাত পড়তে লাগলো। জ্ঞান হারিয়ে দু’একজন লুটিয়ে পড়লো সেখানে বাকীদের রেললাইন থেকে যে কিছুতেই নড়ানো যাচ্ছে না। আঘাতে শরীর জর্জরিত তবু সরতে চায় না। কি ভয়ানক মনোবল ওদের। কংগ্রেস সরকারের পুলিশ এবার দুঃশাসনের ভূমিকায় নামলো। মেয়েদের সম্ভ্রম হরণের জন্য তাণ্ডব শুরু করলো। শাড়ী টেনে টেনে খুললো- তারপর বুটের আঘাত, রাইফেলের বাটের ঘা, টেনেহিঁচড়ে ফেলে দিল রেললাইন থেকে দূরে। জ্ঞান হারিয়ে ওরা তখন বিবস্ত্রা। সংগে সংগে আর একদল সত্যাগ্রহী সে স্থান দখল করলো।

সমস্ত দিন ওরা চেষ্টা করলো ট্রেনের চাকা চালাতে কিন্তু প্রতিবারই সত্যাগ্রহীদের অটুট মনোবলের কাছে হেরে গিয়ে বর্বরোচিত অত্যাচার চালিয়েছে। আহত হয়েছে অসংখ্য সত্যাগ্রহী আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা নির্বিশেষে। হাসপাতালের সিট ভর্তি হয়ে গেছে। আহতদের শেষ পর্যন্ত হাসপাতাল করিডোরে রাখার ব্যবস্থা করা হল।

জেলেও জায়গাভাব। কত শত সত্যাগ্রহীকে বন্দী করে রাখা হয়েছে। গাদাগাদি করে রাখা হয়েছে। শত শত সত্যাগ্রহী আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সত্যাগ্রহী। অনেক সত্যাগ্রহীদের বন্দী করে কয়েক মাইল দূরে পুলিশ ছেড়ে দিয়ে আসে। সংগ্রাম পরিষদের গাড়িও প্রস্তুত- তৎক্ষণাৎ পেছন ছুটে সত্যাগ্রহীদের নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হয়। সে এক অভূতপূর্ব গণ-সত্যাগ্রহ গণআন্দোলন। এর ইতিহাস বিরল।

শিলচর-হাইলাকান্দি-পাথারকান্দি-বদরপুরে একই পাশবিক অত্যাচার, একই পদ্ধতির উৎপীড়ন। শাসক কংগ্রেস সরকারের পুলিশবাহিনীর একই তাণ্ডবলীলা।

শিলচর। বেলা দু’টা বেজে দুপুর গড়িয়ে গেছে। নেতারা কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। মারাত্মক অঘটন বুঝি আর ঘটবে না। কংগ্রেস সরকারের সমস্ত বলপ্রয়োগ বিফলে গেছে। হরতাল সফল হতে চলেছে। পুলিশ মিলিটারি অত্যাচারের মাত্রা একটুখানি কমিয়ে দম নিচ্ছে। মাতৃভাষা জিন্দাবাদ ধ্বনিতে রেল স্টেশন মুখর। হঠাৎ গুড়–ম্-গুড়–ম্-গুড়–ম্ আওয়াজে শিলচর রেল স্টেশন সচকিত হয়ে উঠলো। ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে এলো নরপিশাচদের রাইফেল থেকে। রক্তস্নাত হলো শিলচর। নরমেধ-যজ্ঞের অনুষ্ঠানে একে একে লুটিয়ে পড়লো বীর সত্যাগ্রহীরা। রক্তের ফোয়ারায় শিলচর প্ল্যাটফর্ম লাল হয়ে উঠলো। লাল হয়ে গেল কঠিন পাষাণ রেললাইন। রক্তের আর্তনাদ থেকে সত্যাগ্রহীদের মুখ দিয়ে বেরুল ‘মাতৃভাষা জিন্দাবাদ’। মাতৃভাষার ইজ্জত বাঁচাতে অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত সত্যাগ্রহীরা শহীদের মৃত্যুবরণ করে নিল। ১৯৬১-এর মাতৃভাষার সংগ্রাম এগারো জন শহীদের জন্ম দিল।’

উল্লেখ করার মত ব্যাপার হচ্ছে সেদিন যাঁরা শহীদ হয়েছিলেন তাঁদের প্রায় প্রত্যেকের বাড়ি এপার বাংলায়। এদের মধ্যে কেঊ কেউ সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সঙ্গে।

সেদিনের শহীদ বেদিতে যাঁরা মাতৃভাষার জন্য অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন তাঁরা হলেন- কমলা ভট্টাচার্য, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, কানাই লাল নিয়োগী, হিতেশ বিশ্বাস, সুকোমল পুরকায়স্থ, তরণী দেবনাথ, চন্ডীচরণ সূত্রাধর, সুনীল সরকার, কুমুদরঞ্জন দাস, সত্যেন্দ্র দেব ও বীরেন্দ্র সুত্রধর।

হত্যা নির্যাতন চালিয়ে পুলিশ সেদিন আন্দোলনের গতিরোধ করতে পারেনি। শহীদের লাশ আন্দোলনকারীদের নতুন শক্তিতে উদীপ্ত করে। অভূতপূর্ব গণজাগরণের মুখে অবশেষে নতি স্বীকার করতে হয় সরকারকে। ১৯৬০ সালের অসম ভাষা আইনকে সংশোধন করা হয়। ১৯৬১ সালে শহীদের রক্তভেজা বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। অধিষ্ঠিত হয় মর্যাদার আসনে।

একুশ আর উনিশ একই সূত্রে গাঁথা। একই প্রত্যয়ে, একই দাবিতে গড়ে উঠেছিল দুটি আন্দোলন। মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার সমুন্নত রাখতে হাসতে হাসতে জীবন দিয়েছিল ওরা। সেই বলিদান বৃথা যায়নি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে একুশ। এটা আমাদের গৌরবের, অহংকারের। সেই গৌরবগাঁথা অর্জনে অপার বাংলার এগারো শহীদের আত্মত্যাগ কোনো অংশেই কম নয়! আমরা যেনো তাদের ভুলে না যাই। সালাম, রফিক, সফিক, বরকত, জব্বারসহ সকল ভাষা শহীদের সাথে আমরা তাদেরকেও স্মরণ করবো। জানাবো বিশ্ববাসীকে, একুশের মতো আরও একটি রক্তেরাঙা উনিশে মে আছে আমাদের।

  • অপূর্ব শর্মা: লেখক, সাংবাদিক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত