কামাল লোহানী

২১ মে, ২০১৮ ১৯:৩৬

ধর্মনিরপেক্ষতা কোথায় গেলো?

প্রচন্ড রকমের শাসনের মধ্যেও, আমি মোটামুটিভাবে যেখানে যেতে পারি চলে যাই ছুটে। এই কদিন আগেই উত্তরবঙ্গের প্রায় শেষদিকে জয়পুরহাট বলে একটি জেলা আছে, সেই জেলায় উপস্থিত হয়েছিলাম। তার কিছুদিন আগে এই সুনামগঞ্জে ঘুরে গেছি। আর সিলেটে এলাম অনেকদিন বাদে। সিলেটের উপর দিয়েই অবশ্য গেছি সুনামগঞ্জে। কিন্তু সিলেটে এসে সবার সঙ্গে কথা বলা বা একসঙ্গে বসা এবং এই কাজটি (বইপড়া উৎসব) বাংলাদেশের অন্যকোথাও হয় কি না আমার সন্দেহ আছে। আজ আমরা যদি মুক্তিযুদ্ধকে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃতির বাইরে রেখে না জানতে পারি, তাহলে আমাদের অতীত এবং বর্তমানকে জানতে পারবো না এবং জানতে পারবো না বলেই আমাদের ভবিষ্যতকে রচনা করার যে পথ, যে উপাদান সংগ্রহ করার কথা, সেই জ্ঞান অর্জন করতে পারবো না।

বইপড়া উৎসব আসলেই একটি আনন্দের উৎসব, আনন্দের আয়োজন। এবং তারচেয়ে সবথেকে বড় কথা যেটা, বিজয়ের মাসে বইগুলো বিতরণ করা হচ্ছে, আর ভাষা আন্দোলনের মাসে আপনারা পরীক্ষা দিচ্ছেন এবং সে পরীক্ষায় যারা অবতীর্ন হয়েছিলেন তারা পুরষ্কার পাচ্ছেন আমাদের স্বাধীনতার মাসে। এই তিনটি মাস যে আমাদের জীবনে কি বিশাল একটা অধ্যায় রচনা করেছে সেটি আমরা সবাই আজ উপলব্ধি করছি। কারণ পাকিস্তানী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আমরা যখন লড়াই করতে নেমেছিলাম তখন আমাদের পূর্বপুরুষেরা  অর্থাৎ আমার বয়সী যারা এবং আমার পরবর্তী বয়সী যারা, তারা যেভাবে লড়াই করেছেন সে কথাগুলো আপনাদের সামনে বলতে গেলে অনেক সময় লাগবে। এ সময়টা আমার মনে হয় নেওয়াটা ঠিক হবে না। কিন্তু আপনারা অনেকের এরমধ্যে শুনেছেন, পড়েছেন এবং জেনেছেন নানাধরনের বইপড়ার ভেতর দিয়ে। কারণ বারোবছর ধরে আপনারা মুক্তিযুদ্ধের যে বই পড়ছেন এবং বইয়ের ভেতরগুলোতে নিশ্চয়ই রেফারেন্সে অন্ততপক্ষে পুরনো ইতিহাসের কথাগুলো উঠে এসেছে। একটা জিনিস ভেবে দেখেন, পড়াশুনার কথাই বলতে গেলে আপনাদের বলি যারা তরুণ প্রজন্মের; আমি মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আপনাদের অবহিত করতে চাই এই জন্যে যে আপনারাই হচ্ছেন সেই শিক্ষা এবং ভবিষ্যতের জন্যে সেই জ্ঞান আপনারা রেখে যাচ্ছেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে। সেখানে আমরা যেমন ছোটবেলায় মদনমোহন ধর পালন করেছি।

বইতে লেখা, ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি। আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে, আমি যেন সেই কাজ করি ভালো মনে’। একটা কথা ভেবে দেখেন, আমার বয়স চুরাশি বছর। সেই ছোটবেলায় পড়েছি। এখনো যদি সেই কথাগুলো উচ্চারণ করি তাহলে কি খুব ভুল হবে? আমার মনে হয় ভুল হবে না।  কারণ যদি গুরুজনকে আমরা মান্য না করি, গুরুজনকে আমরা অনুসরণ না করি তাহলে আমরা সৎপথে পরিচালিত হতে পারবো না। সেজন্যে বন্ধুরা একটা কথা মনে করি খুব কষ্ট করেই বলি, যে অল্প কিছদিন আগেই আমাদের পাঠ্যপুস্তক থেকে যেসমস্ত কবিতা, যেসমস্ত গল্প বাদ দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে একটি কবিতা কুসুমকুমারীর লেখা। সেটা আমি ছোটবেলায় পড়েছি, “আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে”। ইনোভেটর সে কাজ করে দেখাচ্ছে। যে কাজ করলেও বড় হওয়া যায় এবং সে কাজের মাধ্যমে অন্যদেরকেও বড় করা যায়। অর্থাৎ লেখাপড়া, জ্ঞান অর্জনে মানুষকে সত্যিকার অর্থেই মানুষ হিসাবে গড়ে তোলা যায়। ইনোভেটর ১২ বছর ধরে অধ্যাবসায়ের সাথে সে কাজটি করছেন। নানা বিঘ্ন, নানা প্রতিবন্ধকতা তাদেরকে হয়তো পথ রোধ করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু পারেনি। তারপরেও তারা প্রতি বছরই এই কাজটি করে যাচ্ছেন।

বন্ধুরা আমি আপনাদের বেশি সময় নিতে চাই না। কিন্তু যেহেতু অপরাধ করেছি সেহেতু কিছু কথা বলতে চাই। সেটা হলো যে, মুক্তিযুদ্ধের উপরে আপনারা বই পড়েন এবং সেটাতে আপনারা একটা প্রতিযোগীতার মাধ্যমে পুরষ্কৃত এবং সনদপ্রাপ্ত হন। এইটা একটা  কিন্তু আমি বলবো আপনাদের জীবনেই শুধু নয়, যারা সংগঠক এই কাজের, ইনোভেটরের যারা কাজ করছেন, যারা আবিষ্কারের কাজ করছেন তাদেরও এই একই কথা বলবো যে তারা একটা অসাধারন কাজ করে চলেছেন এবং সেই কাজটি করছেন মুক্তিযুদ্ধের উপরে। আসলে এই বাঙ্গালি জাতির মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে সবথেকে বড় অহংকার। সে অহংকার আমরা বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে শুনেচ্ছিলাম ১৯৭১ এর ৭ মার্চ, ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে। সেটাকে এখন ঢাকা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বলা হয় এবং বঙ্গবন্ধু সেদিন বলেছিলেন তার বক্তব্যের শেষদিকে, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। কি অসাধারণ এক কথা। তখন সমস্ত রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ লক্ষ মানুষ। আমরা হিসাব করে বলি ১০ লাখ। আমার কাছে ১০ লাখ কি না সেটা বড় কথা নয়, কিন্তু সেদিন জনসমুদ্র ছিলো। একসঙ্গে চিৎকার করে সবাই বলেছিলো তখন, “বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো”। কি অসাধারণ শক্তির সঙ্গে, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে, ত্যাগের মহিমায় উদ্দিপ্ত হয়েছিলো বঙ্গবন্ধুর ওই বক্তৃতার পর সমস্ত মানুষ। বলেছিলো তারা, “পদ্মা, মেঘনা, যমুনা; তোমার আমার ঠিকানা”। এই যে অসাধারণ স্লোগানের মধ্য দিয়ে সেদিনকার মানুষ আমাদেরকে উদ্দিপ্ত করেছিলো তার পেছনে ছিলো বঞ্চনা, তার পেছনে ছিলো উপেক্ষা, অবহেলা। সে উপেক্ষা, অবহেলা করেছিলো কারা? পাকিস্তানের পশ্চিমি যে রাজনৈতিক গোষ্ঠি আমাদেরকে শোষন করছিলো, আমাদেরকে শাসন করছিলো তারাই। যারা আমাদের কাছ থেকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কেড়ে নিতে চেয়েছিলো। তারা বলেছিলো রবীন্দ্রনাথ আমাদের কেউ নয়। আশ্চর্যের ব্যাপার, যে পাকিস্তান বলে তোমরা গর্ব করো, সে পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটির মাঝে আমরা বাঙালি হচ্ছি সাড়ে চার কোটি; যারা বাংলা ভাষায় কথা বলি, যারা বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিতেও দ্বিধা করিনি। মায়ের ভাষাকে বাঁচানোর জন্যে আমরা উৎসর্গ করেছি সমস্ত জীবনটাকে। সেই বাঙালীকে বলছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেউ নয়। আমার মনে আছে, ১৯৬৭ সালে জুলাই মাসে, পাকিস্তানের পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে, পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী খাজা সাহাবউদ্দীন সেলিম বলেছিলেন, Tagore is not a part and parcel of our art and culture. কবিগুরু বলেছিলেন, “বাঁধা দিলে বাঁধবে লড়াই”। আমরা সেই সঙ্গে বলেছিলাম, কবিগুরুর এই শব্দটির সঙ্গে, “এ লড়াই জিততে হবে”। আমরা জিতেছি সে লড়াই, যত বাঁধাই আসুক।

মার্শাল ল জারী হয়েছে, আইয়ুব খান শাসন করেছেন। তাদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে আমরা ১৯৬১ সালে কবিগুরুর জন্মশতবর্ষ উৎযাপন করেছি। ওই যে উৎযাপন করেছি, সেই থেকেই তাদেরর প্রতিহিংসার জন্ম হয়েছিলো এবং যে করেই হোক রবীন্দ্রনাথকে এদের কাছ থেকে সরিয়ে দিতে হবে। সে কারণেই এই কথাটা উল্লেখ করেছিলো ১৯৬৭ সালে। বন্ধুরা অবাক হয়ে যাবেন, ঢাকা শুধু নয়, সারা পূর্ব বাংলায় মানুষ একত্রিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আমাদের নিজের অর্জন হিসাবে, অভিভাবক হিসাবে, পথপ্রদর্শক হিসাবে গ্রহণ করার জন্যে সেদিন একটা দুটো নয়; অসংখ্য শতবর্ষ উৎযাপন কমিটি হয়েছিলো এবং সাহাবউদ্দিনের বক্তব্যের পর আমরা সবাই একত্রিত হয়ে সাংস্কৃতিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা পরিষদ নামে একটি সংগঠন তৈরী করে তিন দিন পরপর রবীন্দ্র গান, কবিতা, নাটক, নৃত্যনাট্য আয়োজন করেছি এবং প্রতিদিন অগণিত মানুষ মিলনায়তনে এসে জড়ো হয়েছেন এবং এগুলো দেখে তারা বিস্মিতই শুধু হয় নাই। তারা রীতিমতো আমাদের বিরুদ্ধে কিভাবে চক্রান্ত করেছিলো তার প্রতিক্রিয়া আমরা দেখতে পেলাম তৃতীয় দিনে। দুই জায়গা থেকে ট্রাক ভর্তি গুন্ডা পাঠিয়ে দেওয়া হলো ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে যাতে আমরা ওই অনুষ্ঠান ঠিকমতো না চালাতে পারি। আমাদের উপরে হামলা করতে পারে এমন অবস্থায় আমরা আমাদের অনুষ্ঠান ঠিকই চালিয়ে গেলাম এবং তৃতীয় দিনের অনুষ্ঠান শেষ করে আমরা চলে গেলাম বটে কিন্তু ওই গুন্ডাবাহিনী পরবর্তীকালে এসে আমাদের যত বাদ্যযন্ত্র ছিলো আমাদের না পেয়ে সব ভেঙে  চুরমার করে দিয়েছিলো।

বন্ধুরা, এই কথাগুলো এই জন্যে বলছি কারণ গতোকাল ছিলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৭তম জন্মদিন। একটা কথা মনে রাখবেন, এই পূর্ব বাংলায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একনাগাড়ে দশ বছর বাস করেছেন। পতিসর, সাজাদপুর, শিলাইদহ এই তিন জায়গায় ছিলো তাঁর কাচারিবাড়ি আর কুটীবাড়ি। এই যে জমিদারি তার, সেই জমিদারের মতো তিনি কখনোই কারো সাথে ব্যবহার করেননি এবং প্রজাকে উৎপীড়ন করেননি, নির্যাতন করেননি। বরং তাদেরকে অন্য জমিদারের নির্যাতন থেকে রক্ষা করার কাজটাই করেছেন সাজাদপুরের ওই বাড়িতে শুয়ে শুয়ে।

বন্ধুরা উনি কত যে সাহিত্য রচনা করেছেন তা নিয়ে আলোচনা করতে অনেক সময় লেগে যাবে। আমি সেটা করবো না। কিন্তু এই দেশের মাটিকে তিনি যখন স্পর্শ করেছিলেন, তারপর দীর্ঘদিন থাকবার কারণে তার মনে যে প্রতিক্রিয়ার সৃস্টি হয়েছিলো। তিনি বলেছিলেন এই যে অসাধারণ মাটি। যেখানে উৎপাদিত হয় সাহিত্য, কাব্য; এই মাটিকে আমরা নমস্য করে দেখেছি। এই পচিশদ, এই সাজাদপুর, এই শিলাইদহ আমাদের কাছে পবিত্র জায়গা হয়ে আছে। আর সাজাদপুরে বর্তমান সরকার রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছেন। এই যে ঋণ তা শোধ করা যাবে না। তিনি কবি তিনি শিল্পী, তিনি সাহিত্যিক, তিনি গাল্পিক, তিনি সবকিছু। তিনি সমাজ সংস্কারক। পূর্ব বাংলার তিনি তার নোবেলের টাকা দিয়ে প্রথম সমবায়ের ব্যবস্থা করেছিলেন, কৃষি ঋণের ব্যবস্থা করেছিলেন এবং কৃষিব্যবস্থা আধুনিকরণ করার জন্যে তিনি ট্রাক্টর আমদানির ব্যবস্থা করেছিলেন। এসব একজন কবি করেছিলেন। ভাবতে পারেন! এই মানুষটা সত্যিকার অর্থেই একজন সমাজ সংস্কারক হিসাবে আমাদের মধ্যে জন্ম নিয়েছিলেন। আর সেই কারণেই তো আমাদের এইভাবে উদ্দীপনা  ও অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন। যেকারণে পশ্চিমারা কখনোই তাঁকে গ্রহণ করতে পারেনি এবং তার কারণে অনেকের উপরেই নানা ধরনের নির্যাতন নেমে এসেছিলো ওই সময়েতে।

বন্ধুরা এইসব কারণেই তো এই অবহেলা, বঞ্চনা, উপেক্ষা; আমাদের সম্পদ দিয়ে পশ্চিমে বেহেশত তৈরী করা, সে সমস্ত জিনিস দেখেই তো আমাদের ক্রোধ, আমাদের যে ক্ষোভ সেটা জমে একদিন বিস্ফোরণ ঘটালো ৭১এর মুক্তিযুদ্ধে। সেই মুক্তিযুদ্ধ আমরা কারা করেছিলাম? কেউ তো সেনাবাহিনীর লোক ছিলো না। যারা লুঙি পড়া লোক ছিলো, যারা ধুতি পড়া লোক ছিলো তারা কাঁছি মেরে খালি গায়ে প্রথমে লাঠি, তারপর থানা পুলিশ থেকে কেড়ে নিয়ে এসেছিলো যে অস্ত্র সে অস্ত্র ধারণ করেছিলো শত্রুর বিরুদ্ধে। শত্রুর দিকে তাক করে শত্রুর বন্দুক দিয়েই তাকে গুলি করেছে এবং এই সমস্ত মানুষ একসঙ্গে হয়ে, ছাত্ররা যখন একত্রিত হয়েছে শ্রমিকের সঙ্গে, কৃষকের সঙ্গে, সেই সঙ্গে বাঙালি যারা ছিলো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে তারাও যখন এসে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তখন আমাদের শক্তি অনেকখানি বেড়ে গেছে এবং সেই শক্তি নিয়ে লড়াই করে আমরা দেশটাকে স্বাধীন করেছিলাম। একথাটা মনে রাখতে হবে। আর সেজন্যে আবারও রবীন্দ্রনাথকে ডেকে আনি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ”।

আমরা কি বিশ্বাস হারাই? আমরা হারাই না। ৫২-তে হারাই নাই, ৬২-তে হারাই নাই, আমরা ৬৯-এ হারাই নাই, ৭১-এ আমরা হারাই নাই বলেই আজকে এই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে আপনাদের সকলের সামনে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনতে পারছি এবং ছড়াতে পারছি।

আর বন্ধুরা, আজকে এই বাংলাদেশে যখন সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত ছোবল নানাদিক থেকে আমাদের আক্রমণের চেষ্টা করছে, তখন এই বাংলাদেশের মানুষ হিসাবে আমরা মনে করতে পারি যে সেদিন সবাই তো আমরা লড়াই করেছিলাম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। আমরা তো লড়াই করেছিলাম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীদের যারা সমর্থন জানিয়েছিলো সেই মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলাম, নেজামি ইসলাম এদের বিরুদ্ধে। আর সেই সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেই তো আমরা বিজয়ী হয়েছিলাম। আজকে যখন আবার এই অপশক্তি যখন মাথা চাড়া দিয়ে উঠে, যারা ছোবল মারার জন্য নানা কৌশলে চেষ্টা করে, সেই অপচেষ্টাকে ভেঙে দেয়ার জন্য আমার দেশের মানুষ, সবাই আমরা একত্রিত হই। বন্ধুরা একটা কথা মনে রাখবেন আজকে এই দেশে আমরা মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনার কথা বলি, সেই চেতনাকে আমরা কতটা লালন করতে পারছি, ধরে রাখতে পারছি সে কথাটা চিন্তা করা দরকার।

আমাদের স্লোগান ছিলো মুক্তিযুদ্ধের সময় গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র। ধর্মনিরপেক্ষতা কোথায় গেলো? আজকে হিন্দু জনগোষ্ঠির উপরেই শুধু নয়। বৌদ্ধ জনগোষ্ঠি, খ্রিষ্টান জনগোষ্ঠি তাদের উপরেও একের পর এক হামলা হচ্ছে এবং তাদেরকে হত্যা করা হচ্ছে। হিন্দু জনগোষ্ঠির বাড়ি ব্যবসা সবকিছুর উপর আক্রমণ চালানো হচ্ছে, লুটপাট করা হচ্ছে, স্বর্ণালঙ্কার লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। তৈজসপত্র এমনকি থালাবাসন পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছে। এসমস্ত কাহিনী আমরা রোজ শুনছি না? কেন এই দোষটি হচ্ছে? আমার একটিমাত্র প্রশ্ন। ভারত যখন বিভক্ত হলো, পূর্ব বঙ্গ আর পশ্চিম বঙ্গ হলো তখন পুর্ব বঙ্গের হিন্দু জনগোষ্ঠি ৩৪ শতাংশ ছিলো। আজ কেন তা ৮ শতাংশে নেমে এসেছে? এর জবাব কে দেবে? নিজেদের জবাব খুঁজতে হবে। দুঃখটা হচ্ছে উপরে থুতু ফেললে তা নিজের গায়ের উপরেই এসে পড়ে।

বন্ধুরা, আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, আজকে তারাই তো মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা নিয়ে সরকার গঠন করেছেন, দেশশাসন তারা করছেন, উন্নতি করছেন। কিন্তু সাথে সাথে একটা কথা বলি। যে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প আজ সমস্ত সমাজকে গ্রাস করার চেষ্টা করছে তা আমরা কেন প্রশ্রয় দিচ্ছি? হেফাজতে ইসলাম আমাদের প্রেসক্রিপশন দিলো আর আমরা পাঠ্যপুস্তক থেকে যতো রকমের কবি জসিমউদ্দীন, হুমায়ুন আজাদ, সত্যেন সেন, রমেশ দাসগুপ্ত, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম এঁদের যেসমস্ত কবিতার মাঝে ওই ধরনের শব্দ আছে বলে তারা মনে করে সেসব কবিতাগুলো বাদ দিতে হলো, লেখাগুলো বাদ দিতে হলো। রমেশ দাসগুপ্ত মুক্তিযুদ্ধের উপরে একটা গল্প লিখেছিলেন, সেটাও বাদ গেলো। হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, “ঐ বই পড়ো না যে বই তোমাকে ভয় দেখায়”। আরে ভাই এ বইটা কি তুমি জানবারও চেষ্টা করলে না? তুমি কবিতাটাই বাদ দিয়ে দিলে। ওই একটু আগে বলছিলাম কুসুমকুমারী দেবীর কথা। তার কবিতাটাও বাদ দিয়ে দিলো। কারণ, “আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে? কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।'' এখন তো কাজে বড় হওয়ার দরকার নেই, কথায় বড় হতে হবে। আজকাল আমরা বড় বেশি কথা বলি। সেই কথাটা যদি একটু কমিয়ে নিজেরা জানার জন্যে চেষ্টা করতাম, সৎপথে চলার চেষ্টা করতাম, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের চেষ্টা করতাম, সন্ত্রাসবাদকে প্রতিরোধ করতে পারতাম, জঙ্গীবাদকে প্রতিহত করে আমাদের লোকশক্তি প্রতিষ্ঠিত করতে পারতাম তাহলে সত্যিকার অর্থেই আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি বলে দাবী করতে পারতাম। কিন্তু আজকে পারছি না তা করতে।

এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আজ এই তরুণ মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু তোমাদের কাছে এই আবেদন থাকবে যে তোমরা সবাই মিলে যেমন আমার বলা বঙ্গবন্ধুর কথাগুলোর সঙ্গে তোমরা উচ্চারণ করলে পরবর্তী শব্দগুলো আজকে একটা কথা বলতে হবে এদেশ আমার গর্ব, এই মাটি আমার কাছে সোনা, আমি করে যাই তারই জন্মবৃত্তান্ত ঘোষণা। এই কথা মনে রাখতে হবে এবং মনে রেখেই আজকে মুক্তিযুদ্ধের এই সমস্ত বই পড়তে হবে এবং মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের কি দিতে চেয়েছিলেন, যে ধর্মনিরিপেক্ষতা দিতে চেয়েছিলেন, যে গণতন্ত্র দিতে চেয়েছিলেন, সে সমাজতন্ত্র দিতে চেয়েছিলেন, এই মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে মানুষকে সম্মান করার যে জ্ঞান আমাদের দিতে চেয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মাধ্যমে আমরা সেইটাকে লালন করতে চাই। আমরা এই সাম্প্রদায়িকতার কাছে আমাদের আত্মবিশ্বাসকে বিসর্জন দিতে চাই না। আমাদের যে বাঙালিত্ব, আমাদের যে বাঙালিয়ানা বলে যে গর্ব, অহংকার করে থাকি তা আমরা কারো কাছে বিক্রি করতে রাজী না।

তাই বন্ধুরা সবার কাছে এই আবেদন করবো যে আজ আমরা সবাই মিলে শপথ গ্রহণ করি যে সবাই আমরা জানি, আমরা সবাই মানুষকে ভালোবাসি। আজকে শপথ গ্রহণ করতে হবে সত্যিকার অর্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক বাংলা গড়ে তুলতে হবে, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্নকে যদি পূরণ করতে হয় আর সত্যিই যদি আমি বিশ্বাস করি যে ওই যে জাতীয় সংগীতের মধ্যে বলছি বদনা খানা মলিন হলে আমি নয়ন জুলে ভাসি, সত্যি সত্যিই কি আমরা ভাসছি এখন? মায়ের বদন তো এখন ভিষনভাবে মলিন হতে চলেছে। ওই জঙ্গি, সাম্প্রদায়িকতার কারণে, ঘুষ, লুটপাটের কারণে, আমরা কি তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পেরেছি আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি? যেমন করে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন এই কবিতা গগন হরকরার কাছ থেকে ধার নিয়ে, “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি”। একটা নয়, ছয় ছয়টা গান এবং কবিতা লিখেছিলেন বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে। আজকে আমাদের বিশাল অর্জন সেই কবিতা এখন আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। ভারতবর্ষের জাতীয় সংগীত কবিগুরুর লেখা। আর শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীতের যে সুর সেটাও কবিগুরুর লেখা। পৃথিবীর ইতিহাসে একজন কবিকে আপনারা কেউ দেখাতে পারেন এমন একটি অনন্য অসাধারণ দৃষ্টান্ত  কেউ সৃষ্টি করতে পেরেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়া? দেখাতে পারবেন না।

তাই বন্ধুরা আপনাদের এই আবেদন রেখে শেষ করবো যে আসুন আমরা যারা হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এই দেশটাতে জন্ম নিয়েছিলাম, পাকিস্তানিরা দখল করে নিয়েছিলো, আবার আমরা জানটাকে কবুল করে, লড়াই করে আবার ওদের কাছ থেকে মাতৃভূমি উদ্ধার করেছি এবং সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আজকে আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলছি। বঙ্গবন্ধুর জাতিসংঘে গিয়ে প্রথম বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে সেখানে একটি ইতিহাস তৈরী করেছিলেন। বাংলা ভাষাকে নিয়ে আমরা আজও কিন্তু সর্বস্তরে যেতে পারি নাই। আমাদের কঠিন একটি অঙ্গীকার ছিলো ভাষাশহীদদের প্রতি। তাদের দাবী ছিলো সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করা। আমরা সেটা করতে পারি নাই। আমাদের এই কাজটি করতে হবে এবং এই পথ অনুসরণ করে চলতে হবে। এই কথাগুলো যদি আমরা না মনে রাখি তাহলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাস্তবায়ন করা আমাদের পক্ষে সম্ভবপর হবে না। বন্ধুরা আজকে শিশুহত্যা, আজকে ধর্ষণ, আজকে নানাধরনের হত্যাকান্ড, নীপিড়ন এগুলো কেন দেখছি? এগুলো তো দেখার কথা নয়। সড়ক দুর্ঘটনায় অকারণে মানুষ মারা যাচ্ছে প্রত্যেকদিন ১০-১৫ জন করে। অথচ চালকের বিরুদ্ধে কোন রকমের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, একজন মন্ত্রী এসে দাঁড়িয়ে যান শক্ত হয়ে। তিনি শ্রমিকের বন্ধু হয়ে যান। আমরা শ্রমিকের বন্ধু, আমরা কৃষকের বন্ধু, আমরা ছাত্রের বন্ধু। আমরা সবাই মিলেই এই দেশটাকে স্বাধীন করেছি। সুতরাং, এই কথাগুলো মনে রেখেই আমাদেরকে এই দেশ নতুন করে গড়ে তোলা এবং বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় পরিণত করার যে শপথ সে শপথ আমাদের নিতে হবে।তাই বন্ধুরা আবারও বলি, এই দেশ আমার গর্ব, এ মাটি আমার কাছে সোনা, আমি করে যাই তারই জন্মবৃত্তান্ত ঘোষণা। সবাই আমার সঙ্গে একটি শ্লোগান দিবেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় যে শ্লোগান ছিলো- “জয় বাংলা”।

(গত ৯ মে সিলেটে ইনোভেটর আয়োজিত বইপড়া উৎসবের সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রদত্ত বক্তব্য)

কামাল লোহানী: লেখক, সাংবাদিক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত