বদরুল আলম

০৩ জুন, ২০১৮ ০৩:৩৭

আমরা তরুণ, আমরা পারি!

ওই বুঝি কালবৈশাখী
সন্ধ্যা-আকাশ দেয় ঢাকি।
ভয় কি রে তোর ভয় কারে, দ্বার খুলে দিস চারধারে
শোন দেখি ঘোর হুঙ্কারে নাম তোরই ওই যায় ডাকি।
                                   -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ঘটমান বর্তমান যখন আমাদের পীড়িত করে, তখন একটুখানি আশার বাণী শোনার আশায় আমরা কান পাতি ভবিষ্যতের পানে। পুরোনো আর জরাজীর্ণরা যখন নিঃশেষপ্রায়, তখন খুব শুনতে ইচ্ছে করে তরুণদের জয়গান। চারদিক যখন ঘোর অন্ধকারে ঢাকা, তখন আলোর ঝলকানি হয়ে দেখা দিতে পারেন আমাদের তরুণেরাই। এই তরুণ আর কাঁচারাই আমাদের দিতে পারেন নতুন পথের দিশা। শোনাতে পারেন শুভ দিন বদলের গান।

ডেইলি স্টারের ২৩ ফেব্রুয়ারির খবর- পারমিতা তার স্কুলে একটা শহীদ মিনার বানিয়েছে। বানিয়েছে, মানে বানানোর কাজটা সে শুরু করে দিয়ে শেষতক সফল হয়েছে। ঘটনা মৌলভীবাজারের আলী আমজাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী এই পারমিতা প্রান্টিস। সে জাতীয় আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে পুরস্কার হিসেবে পেয়েছে পাঁচ হাজার টাকা। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এই আবৃত্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। ঐ বছর মে মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এ প্রতিযোগিতায় সে এই পুরষ্কার লাভ করে। এ টাকা দিয়ে সে কী করবে? সে তার বাবা-মা'কে বলে, আমাদের স্কুলে একটা শহীদ মিনার বানানো যায় না এই টাকায়? বাবা-মা স্কুল কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ করেন। কর্তৃপক্ষও ব্যাপারটা উৎসাহ দেন। পারমিতার পাঁচ হাজার টাকার সঙ্গে তার বাবা-মার টাকা, তার বড় বোনের বৃত্তির টাকা মিলে একটা তহবিল দাঁড়িয়ে যায়। ওই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটা শহীদ মিনার নির্মিত হয়। একুশেতে সেই শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য নবাব আলী আব্বাস খান। উদ্বোধনী ভাষণে এমপি সাহেব আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। একটা ছোট্ট মেয়ে কী বড় উদাহরণই তৈরি করল! এমপি সাহেব বলেছেন, তিনি সংসদে বলবেন, দেশের সব স্কুলেই যেন শহীদ মিনার বানানো হয়। এই দায়িত্ব এখন তরুণদের ঘাড়ে। তরুণরাই পারবে।

দিন বদলের কাজটা বোধ করি কিছুটা কঠিন হয়ে পড়েছে। কিন্তু দিন যে বদলাতে হবেই। তরুণদের কাছে কঠিন বলে কিছু নেই। প্রিয় কবি হেলাল হাফিজ বলেছেন - "এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’’।

প্রথম আলোর 'তরুণেরা কী ভাবছে' শীর্ষক জরিপ জানাচ্ছে, ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন ৮২ শতাংশ তরুণ। আর ৬৩ শতাংশ জানেই না জীবনের লক্ষ্য কী! নিরুত্তাপ, হতাশার আবর্তে মনে হয় ঘুরপাক খাচ্ছে। জানতে চাইলে বলে, আমাদের কথা কেউ ভাবেনা। আমরা কোথায় যাব?

কোথায় যাব মানে কী? নিজের পথ নিজেকেই তৈরি করে নিতে হবে। বুয়েট কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়লেই তো জীবন ব্যর্থ নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে জীবন অনেক বড়। কাজে হাল ছাড়া যাবেনা। হে তরুণ, দেশের যে প্রান্তেই থাকিনা কেন, নিজেকে গড়ে নিতে হবে, আগামীর জন্য। তরুণদের (মোটা দাগে মানুষের) প্রতি আমাদের বিশ্বাসের কোন কমতি নেই।

একবার কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্যার প্যাট্রিক গেডেসকে লিখেছিলেন -"I do not have faith in any new institutions but in the people who think properly, feel nobly, and act rightly" অর্থাৎ "কোন নতুন প্রতিষ্ঠানে আমার আস্থা নেই, তবে আস্থা আছে সেই মানুষগুলোর (তরুণদের) ওপর যাদের আছে সঠিক চিন্তা, মহান অনুভব এবং যথার্থ কর্ম"।

কবিগুরুর জবানিতে যা ফুটে উঠেছে ,আজকের তরুণরা তাই করে, তাই মানে, তাই পারে।

প্রিয় লেখক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেটের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের "আমাদের দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারি" কলাম থেকে একটু বলি-আমাদের দেশে গণিত অলিম্পিয়াডের মতো আর কিছু আছে বলে আমার জানা নেই। এটাতে সহযোগিতা করে প্রথম আলো এবং ডাচ-বাংলা ব্যাংকের মতো বড় প্রতিষ্ঠান। এটি চমৎকারভাবে কাজ করে, কারণ এর সঙ্গে যারা আছে তারা সবাই স্বেচ্ছাসেবক। কেউ কিছু পাওয়ার জন্য এখানে কাজ করেনা। সবাই কাজ করে দেওয়ার জন্য! ছোট ছোট ছেলেমেয়ের উৎসাহ, মা-বাবাদের ধৈর্য, শিক্ষকদের সাহায্য এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবক, যারা সবার আড়ালে কাজ করে যাচ্ছেন! আমি আমাদের দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারি শুধু এই একটি কারণে- কিছু না পেয়ে অনেক কিছু দিতে প্রস্তুত রয়েছে আমাদের এই নতুন প্রজন্ম! আমাদের তরুণ!

একটা গানের কথা বলি- মৌসুমি ভৌমিকের ওই গানটার এই কথায় নিজের মনের কথাই যেন শুনতে পাই, রাত ভরে আমি কোনো স্বপ্ন দেখি না, আজ তোমাদের কাছে এসে দুই হাত পেতেছি, স্বপ্ন দেখব বলে দুই চোখ পেতেছি। স্বপ্ন দেখবে তরুণেরা, স্বপ্ন দেখাবে তরুণেরা। তাদের কাছেই আমাদের বার বার হাত পাততে হয়। বলতে হয়, ওরে নবীন ওরে আমার কাঁচা, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।

তরুণেরা সত্যি সব বাঁধা ডিঙিয়ে এগিয়ে চলেছে। যেমন- রাজীব। আমাদের দাবা অঙ্গন যেখানে প্রতিভা-স্বল্পতায় ভুগছে বেশ ক'বছর ধরে। রাজীব সেখানে আশার আলো হয়ে ফুটেছেন। এই তরুণ প্রতিভা দাবার বিশ্ব আসরে গিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন বাঘা বাঘা দাবাড়ুকে। কোনোরকম ঢাকঢোল পেটানো ছাড়াই হারিয়ে দিয়েছেন রাশিয়ান দাবাড়ু পাভেল ইলিয়ানভোকে। চাট্টিখানি কথা!

শেষ করবো জুনাথন সুইফটের একটা বক্তব্য দিয়ে -"we have enough religion to make us hate but not enough to make us love one another "মানুষকে ঘৃণা করে নয়, মানুষে -মানুষে হিংসা- বিদ্বেষ ও হানাহানি করে নয় বরং মানুষে প্রেম-প্রীতির সেতুবন্ধন তৈরি করে মানুষকে মানবের পর্যায়ে উন্নীত করা যেতে পারে। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন" বিবাদ নয় সহায়তা, বিনাশ নয়, পরস্পরের ভাব গ্রহণ, মতবিরোধ নয়, সমন্বয় ও শান্তি।" তাঁর আরও আহবান, তোমরা হৃদয়বান হও, তোমরা প্রেমিক হও"।

তরুণরা হৃদয়বান হও, প্রেমিক হও। তাহলেই সব হয়ে যাবে। জয় তারুণ্য!

  • বদরুল আলম: প্রভাষক, তাজপুর ডিগ্রি কলেজ, সিলেট; এমফিল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত