আব্দুল করিম কিম

১১ জুন, ২০১৮ ১৯:১১

আসলেই কি সে যোগ্য ব্যাক্তি?

বিশিষ্ট সমাজসেবী, শিক্ষানুরাগী, ব্যাবসায়ী, রাজনীতিবিদ, ক্রিড়া সংগঠক, যুব সংগঠক, মানবদরদী, গরীব দুঃখী মেহনতি মানুষের বন্ধু, দানবীর, এলাকার কৃতি সন্তান ইত্যাদি বিশেষণযুক্ত মহাপুরুষদের আবির্ভাব ঘটেছে সিলেট'সহ দেশের তিনটি মহানগরীতে।

সিলেট, রাজশাহী ও বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের তফসিল ঘোষনায় পাড়া-মহল্লায় সমাজসেবীদের ঢল নেমেছে । নির্বাচন সন্নিকটে এলেই সমাজসেবীদের সেবা কার্যক্রম বেড়ে যায় বাংলা মুল্লুকে । বিগত কয়েক মাস থেকেই সিলেট মহানগরীর পাড়া-মহল্লায় শুভেচ্ছা, শুভ কামনা, ঈদ মোবারক লেখা রঙ বেরঙের ব্যানার ফেষ্টুন জানান দিচ্ছিল সামনে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন । বাংলাদেশের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে এভাবেই প্রার্থীকে জানান দিতে হয়- নির্বাচনে আমিও আছি । এসব ব্যানার ফেস্টুনে প্রার্থীদের নানান ভঙ্গিমার ছবি দেয়া থাকে । আর নামের পূর্বে থাকে অসংখ্য বিশেষণ।

নির্বাচন যত এগিয়ে আসে প্রত্যেক এলাকায় নানান বিশেষণযুক্ত মহাপুরুষদের বিজ্ঞাপনী ব্যানার ফ্যাস্টুন বাড়তে থাকে । রাস্তার মাঝ বরাবর ঝুলন্ত ব্যানার, ইলেকট্রিক পোলে ফ্যাস্টুন, সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে চিকা আর যত্রতত্র পোস্টারে এলাকা সয়লাভ হয়ে যায় । নির্বাচনী আচরণবিধি তফসিল ঘোষণার পূর্বে অকার্যকর । তাই শুরুতে রঙ্গিন, তওফসিলের পর সাদা-কালো।

বিশিষ্ট সমাজসেবীরা এলাকার নিম্ন আয়ের মানুষদের মধ্যে ইফতার বিতরণ, শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণ, কম্বল বিতরণ, শীতবস্ত্র বিতরণ করে সমাজসেবী পরিচয়কে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা মূলত নির্বাচনকে সামনে রেখেই শুরু করে । এই টাইপের সমাজসেবা শুরু হতেই এলাকায় কানাঘোষা শুরু হয়। জনগণ বুঝে নেয় নতুন প্রার্থী এসেছেন মাঠে। এ সময় এলাকার কিছু টাউট এদের সাথে দ্রুত জুটে যায়। সমাজসেবীর ভান্ডার বড় হলে টাউটের ভিড়ও বেশী হয়। এরা নানা উছিলায় সমাজসেবীকে বাহবা দেয় আর ভান্ড উজাড় করে । এসব কর্মকান্ডকে জনগন নির্বাচনকালীন বিনোদন ভেবে উৎসাহ যোগায়।

নির্বাচনে যত বেশি নব্য সমাজসেবীর আগমণ ঘটে এলাকায় ততবেশি অর্থপ্রবাহ, ততবেশী বিনোদন হয় । ব্যাতিক্রম যে নেই, তা নয় । প্রকৃত সমাজসেবী, শিক্ষানুরাগী, ব্যাবসায়ী, রাজনীতিবিদ, ক্রিড়া সংগঠক, যুব সংগঠক, মানবদরদী, গরীব দুঃখী মেহনতি মানুষের বন্ধু, দানবীরদের কেউ কেউ নির্বাচনে দাঁড়ানোর সাহস দেখান। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁদের নিরুৎসাহিত করা হয় । কারন প্রকৃত সমাজসেবীরা ঢোল বাজাতে জানে না। যারা জানে তাঁদের নিয়েই মাতামাতি হয়।

সিলেটসহ তিনটি সিটিতে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণায় সব শ্রেণীর সমাজসেবীরা এখন কোমর বেঁধে দৌড়ঝাঁপ শুরু করছেন । জনপ্রতিনিধি হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টায় আগামী দুই মাস এরা ভোটারদের ঘরে ঘরে ছুটে যাবেন । এলাকায় এই সময়ে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে এই মহামানবেরা সবার আগে ছুটে যাবেন । মানুষের সাথে হাতে হাত মেলাবেন, মুরুব্বী হলে পায়ে হাত মেলাবেন । ঘামে ভেজা রিকশাওয়ালাকে জড়িয়ে ধরে একটা ছবি তুলবেন। এলাকার মোড়ে মোড়ে ব্যানার-ফ্যাস্টুনে নিজেই নিজের চারিত্রিক সার্টিফিকেট প্রদান করে এলাকাবাসীকে জানাবেন 'তাঁর চরিত্র ফুলের মত'। মাইকিং করে নির্বাচনী প্রতিক সবাইকে মনে করিয়ে দেয়া হবে । এ সময় একটা কমন কথা আকাশে-বাতাসে ভাসে "সিল মারো ভাই, সিল মারো অমুক মার্কায় সিল মারো"।

পূর্বে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের প্রার্থী দেয়ার বিধান ছিল না । এখন মেয়র পদে রাজনৈতিক দল সরাসরী প্রার্থী ঘোষণা করে । রাজনৈতিক দলের প্রতিক নিয়েই মেয়র পদে নির্বাচন হয় । তাই কোন দল মেয়র পদে কাকে প্রার্থী ঘোষণা করছে, সে নিয়ে নানান জল্পনা কল্পনা চলে । সংবাদমাধ্যম সম্ভাব্য দলীয় প্রার্থী কে হচ্ছেন, তা জানানোর জন্য নানা শিরোনামে হটকেক সংবাদ বাজারজাত করে।
দলীয় প্রত্যেক সম্ভাব্য প্রার্থী শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত ঢোল বাজিয়ে জানিয়ে দেন তিনিই দলের মনোনয়ন পাচ্ছেন । এ অবস্থায় দলের অন্য প্রার্থী তাঁর চেয়ে যে কতটা অযোগ্য সেটা ঘরোয়া বৈঠকে জানানো চলতে থাকে । অবশ্য দল যদি সেই অযোগ্য প্রার্থীকে শেষ মুহুর্তে মনোনয়ন দিয়ে দেয় তখন তিনি ভোল পাল্টে নেন । সেই প্রার্থীকেই ফেরেশতা হিসাবে জনগনের সামনে তখন পরিচয় করিয়ে দেন। এই সবকিছু জনগণের সামনে ঘটে । জনগণ এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না।

জনগন আঙ্গুলে অমোচনীয় কালি লাগানোর সুযোগ পেলেই খুশি। এই মুল্লুকে এটাই গণতন্ত্র, এটাই নির্বাচন। এখানে প্রার্থীর নামের আগেপিছে বিশেষণ লাগালেই ভোটারের মন জয় হয়। আকাশ থেকে উড়ে এসেও এখানে নির্বাচন করা যায় । কিছু নিয়ামক থাকলে জয়ী হওয়া কোন ব্যাপার নয়, স্বাভাবিক ঘটনা ।

এখানে কোন ভোটার বিশিষ্ট সমাজসেবীকে প্রশ্ন করে না- জনাব, আপনি জীবনে কি কি সমাজসেবা করেছেন ? বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগীকে কেউ বলেনা শিক্ষার প্রতি আপনার কি অনুরাগ ? কয়টি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন? বিশিষ্ট ব্যাবসায়ী হিসাবে আপনি কি এলাকার সর্বোচ্চ করদাতা ? আপনি কোন কারনে এলাকার কৃতি সন্তান? বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ তকমাটা রাজনীতিতে কোন অবদানের জন্য আপনি অর্জন করেছেন ? মানব দরদি হিসাবে জীবনে কয়জন মূমূর্ষ রোগীকে রক্ত দিয়েছেন ? শুধু জনগণ নয়, নির্বাচন নিয়ে হটকেক সংবাদ পরিবেশনকারী বিভিন্ন মিডিয়ার সংবাদকর্মীকেও এমন প্রশ্ন করতে দেখা যায় না । সবার কাছেই নির্বাচন একটা নগদ প্রাপ্তির উৎসব।

নির্বাচন কি আসলেই উৎসব ? নির্বাচনকে আমরা বিশ্বকাপ ফুটবল বা বিশ্বকাপ ক্রিকেটের মত উৎসব কেন মনে করি ? বিশ্বকাপ ফুটবলে নিজের দেশের নাম গন্ধ নেই, অচেনা দেশ খেলে, কাপ জয় করে । আমরা তাতেই খুশি। সেই দেশের জন্য পতাকা বানিয়ে আমরা লাফাই । জিতেছে রে জিতেছে মাদাগাস্কার জিতেছে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মিছিল করে জেতাটা উদযাপন করি। এই লাফানোটাই আমদের উৎসব । তবুও বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রিয় দল নিয়ে আমরা যথেষ্ট খবরাখবর রাখি। মাদাগাস্কারের পতাকা একেবারে সঠিক ভাবে বানাতে পারি। আড্ডায় পছন্দের দল সম্পর্কে অনেক তথ্য জানাতে পারি। প্রত্যাকেই চেষ্টা করি সেরা দলকে সাপোর্ট দিতে । আন্ডার ডগদের নিয়ে শুরুতে আলোচনা করি না। কিন্তু খেলা শুরু হওয়ার পর অনেক আন্ডার ডগ যোগ্যতা বলে ফেবারিটে পরিণত হয়। কিন্তু আমাদের দেশের নির্বাচনে যোগ্যদের আমরা ফেবারিট করতে পারি না।

জাতীয় নির্বাচনে বড় দলগুলোর মনোনীত প্রার্থীকে নিয়েই আলোচনা চলে । কিন্তু স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও বড় দলের সাপোর্ট দেয়া প্রার্থীকেই মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ধরে নেয়া হয়। নতুন কেউ যোগ্যতা নিয়ে প্রার্থী হলেও জানতে চাওয়া হয় কোন দলের সাপোর্ট আছে । সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করার বিধান চালু হয়েছে কিন্তু কাউন্সিলর পদে দলীয় সাপোর্ট দেয়ার বিধান নেই। কিন্তু দলের নেতারা আকারে ইঙ্গিতে দলীয় প্রার্থী চিনিয়ে দেয়।

প্রকৃত সমাজসেবী প্রার্থীকে প্রথমে বিজ্ঞাপনী সমাজসেবী প্রার্থীর প্রচারণার পাহাড় ডিঙ্গুতে হয়। এরপর দলবাজ প্রার্থীর প্রতাপের কাছে শুরুতেই পরাজিত হতে হয় । কারন মিডিয়া দলবাজ প্রার্থীকেই মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ধরে নিয়ে নির্বাচনী প্রতিবেদন প্রকাশ করে । নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ হলে দেখা যায় সংবাদমাধ্যম জানিয়ে দেয় আওয়ামী লীগের এতো জন, বিএনপির এতোজন ও স্বতন্ত্র এতোজন কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন । স্বতন্ত্র মানে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী।

এভাবেই আমদের নির্বাচন চলছে। স্থানীয় নির্বাচন হোক আর জাতীয় নির্বাচন হোক। একই খেলা চলছে হরদম। নির্বাচন নামের এই গণতন্ত্রের চর্চা করতে পেরে আমরা ধন্য। এই গণতন্ত্রের যেন কোন সংশোধন নেই। জাতীয় নির্বাচন বড় বড় মানুষের ভাবনা। সেসব ভাবনার জন্য বড় বড় প্রতিষ্ঠান আছে। সিপিডি আছে, সুজন আছে, জানিপপ আছে, ডেমোক্রেসি ওয়াচ আছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন আছে। বিশ্বব্যাংক আছে। জাতিসংঘ আছে। কিন্তু স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে ভাবুন। আপনার এলাকার দৈনন্দিন সমস্যা সমাধানে আপনি যে ব্যাক্তিকে ভোট দেয়ার কথা ভাবছেন, আসলেই সে কি আপনার সমস্যা সমাধান করার মত যোগ্য ব্যাক্তি?

লেখক: নাগরিক আন্দোলন ও পরিবেশ কর্মী।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত