রত্নদীপ দাস রাজু

১৭ জুন, ২০১৮ ০৫:৪২

পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম

আজ বিশ্ব বাবা দিবস

আজ অশ্রু সজল চোখ আর ব্যথাকাতর মন নিয়ে লিখতে বসেছি একজন পিতার সম্পর্কে। যিনি পুত্রের জীবনে শুধু পিতাই ছিলেন না, ছিলেন- বাল্য কালের ছায়াসঙ্গী, কৈশোরের বন্ধু, আজীবনের শিক্ষক-পথ প্রদর্শক তথা একজন আদর্শিক ব্যক্তিত্ব। আর ব্যক্তি হিসেবেও তিনি ছিলেন উল্লেখিত প্রত্যেকটি গুণাবলীর অধিকারী। স্রষ্টার সৃষ্টির জীবদের মধ্য একমাত্র মানুষই সর্ব শ্রেষ্ঠ। আবার একমাত্র মানুষকেই জন্ম নেওয়ার পর নতুন করে মানুষ হতে হয়। আমাকে জন্মের পর থেকে মানুষের মতো মানুষ করার জন্য যে ব্যক্তি ক্লান্তিহীন প্রচেষ্টা করেছেন জীবনভর, তিনি আমার পরম পূজনীয় পিতৃদেব স্বর্গীয় রবীন্দ্র চন্দ্র দাস (১৯৪৫-২০১৭), (অবশ্য মায়ের অবদানও অনস্বীকার্য)।

ছোটবেলায় শুনেছি আমার জন্মের পর বাবা নাকি আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছিলেন। কারণ আমার আগে আমার দুই বোন এবং দুই ভাইয়ের জন্ম হলেও ভাইয়েরা বাল্যকালেই পরলোকপ্রাপ্ত হন। শৈশবেই বাবা আমাকে পরিচয় করে দেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, স্বামী বিবেকানন্দ, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, মহাত্মা গান্ধী, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ মহাত্মার জীবন ও কর্মের সাথে। আমাদের শোবার ঘরে এই মহতীদের চিত্রপট ও বাবার মুখের বর্ণনা বাল্যকালেই আমার চিন্তা-চেতনাকে প্রভাবিত করে। তাছাড়া তাঁর নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী ও মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আমার মানস গঠনে ভূমিকা রাখে।

আমার বাবা ছিলেন একজন সংস্কৃতিবান মানুষ। শুনেছি আমার পিতামহও ছিলেন তাই। ছাত্র জীবন থেকেই সংগীত চর্চার প্রতি ছিল তাঁর অপরিসীম আগ্রহ। সংগীতে পারদর্শিতা অর্জনের পাশাপাশি তিনি অভিনয়, ক্রীড়া প্রতিযোগিতায়ও সমান পারঙ্গমতা অর্জন করে ছিলেন। তাই হারমোনিয়াম, তবলা, গিটার, বেহালা, ডোল, কুল, দোতরা প্রভৃতি বাদ্য যন্ত্রে ছিলেন পারদর্শী। আর এজন্যই এই সব বাদ্যযন্ত্রের সাথে আমার পরিচয় জন্মলগ্ন থেকেই। বাবা এই সব বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গান করতেন, অবশ্য সাথে অন্যান্য বাদ্যশিল্পীও থাকতেন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় ঠাকুর ঘরে সন্ধ্যারতি হতো, যা এখনও অব্যাহত আছে। কাজেই বাবা চাইতেন আমিও এই সব যন্ত্রের ব্যবহার ও গান গাইতে যেন পারদর্শিতা অর্জন করি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে তাঁর প্রচেষ্টায় বেশ কিছু স্বরলিপি ও গান হারমোনিয়ামে বাজিয়ে গাইতেও শিখি। কয়েকটা প্রতিযোগিতায়ও অংশগ্রহণ করি। কিন্তু তাঁর চেষ্টা থাকা সত্বেও পরবর্তিতে নিজেরই কারণে আর এগুনো হয়নি।

বাবা আমাদের পার্শ্ববর্তী গ্রাম বৈলাকীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন এবং মা স্কুলের অনতিদূরে শাখোয়া বাজারের পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় সংলগ্ন ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের পরিদর্শিকা। আমি স্কুলে ভর্তি হওয়ার বছর দুয়েক আগেই বাবার সাথে হেমন্ত মৌসুমে পায়ে হেঁটে আর বর্ষায় আমাদের গোস্তী নৌকায় করে স্কুলে আসতাম। ১২ টার পরে ১ম ও ২য় শ্রেণির ছুটির পর স্কুলের ছাত্রদের সহযোগিতায় চলে আসতাম মায়ের অফিসে। বিকাল ৪.৩০ বা ৫.০০টার দিকে স্কুল ছুটির পর বাবা আমাকে মায়ের অফিস থেকে সাথে করে বাজারে কেনাকাটা করে বাড়ি ফিরতেন। এটাই ছিল আমার প্রতিদিনের রুটিন। আসা যাওয়ার পথে প্রত্যেক দিন প্রতিটি মিনিট আমাকে পড়ার উপরেই রাখতেন। তখন খুব বিরক্তি বোধ করতাম। কিন্তু এর সুফল এখন বুঝি।

বাবা আমাকে পড়াশুনায় অনুপ্রাণিত করতে প্রায়শই উদাহরণ দিতেন একসময়কার কৃতি শিক্ষার্থী তাঁর বন্ধু, অগ্রজ, অনুজদের। তার মধ্যে যতদূর মনে পড়ে সেই ব্যক্তিরা হলেন- শহীদ বুদ্ধিজীবী অনুদ্ধৈপায়ন ভট্টাচার্য, নিবারণ দেব, ডা. সুকেশ দাস, মেজর (অব.) সুরঞ্জন দাস, প্রকৌশলী চিত্তরঞ্জন দাস, বজলুর রহমান (শিক্ষক) প্রমুখের। যাঁরা মনোযোগ সহকারে পড়াশোনা করে ছাত্রজীবনে যেমন অর্জন করেছেন কৃতিত্ব, তেমনি কর্ম জীবনেও সফলতা অর্জন করেন। পরিচয় করে দিতেন গুণীজনদের সাথে। এর মধ্য উল্লেখযোগ্য নবীগঞ্জের সর্বজন শ্রদ্ধেয় নেতা জমিদার শ্যামাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত (বিধুবাবু), বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ জনাব আব্দুল আজিজ চৌধুরী প্রমুখ খ্যাতনামাদের সাথে তাঁদের আদর্শে উজ্জীবিত হতে। স্কুল ও উপজেলা পর্যায়ের প্রতিটা টুর্নামেন্টে আমাকে প্রস্তুত করতেন। উপস্থিত বক্তৃতা, উপস্থিত অভিনয়, দেশাত্মবোধক গান, দৌড় প্রতিযোগিতায়। উপস্থিত বক্তৃতায় স্কুল ও উপজেলা পর্যায়ে কৃতিত্ব অর্জন করলেও অন্যগুলোতে আশানুরূপ ফলাফল করতে পারিনি।

কোন এক বিখ্যাত মনিষী বলেছিলেন- "কোন সন্তান তার পিতার মতো হয় না। অধিকাংশ হয় পিতা থেকে কম গুণ সম্পন্ন। খুবই সীমিত সংখ্যক হয় পিতার মতো। একেবারেই স্বল্প (বিরল প্রায়) সংখ্যক হয় পিতা থেকে গুণবান"। আমার বাবা এমনি এক গুণী লোক ছিলেন, যিনি গান, অভিনয়, বক্তৃতা, ফুটবল, ভলিবল, সাঁতার, দৌড়, সহ সকল ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে ছিলেন পারদর্শী। এই রকম গুণী পিতার সন্তান হয়ে আমি তাঁর গুণগুলো ধরে রাখতে আজও প্রয়াসী।

বাবা আমাকে পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি ক্লাস টু/থ্রি থেকেই জাতীয় দৈনিক পত্রিকা, ম্যাগাজিন, বিশ্ব বিচিত্রা, আমার উপযুক্ত গল্পের বই এনে দিতেন, রেডিওতে সংবাদ ও সংসদ অধিবেশন শোনার অভ্যাস তৈরি করে দেন। পুত্রের মানসিক বিকাশের জন্য। শারীরিক গঠন শৈলী শক্তিশালী হওয়ার জন্য প্রাতঃকালে ঘুম থেকে তুলে শরীরচর্চা, স্নানের সময়ে নিয়মিত সাঁতারকাটা (প্রথম প্রথম নিজের পিঠেকরে সাঁতার কাটানোর স্মৃতি আমি কখনও ভুলব না) এবং বাস্তবিক জীবনযাপনের জন্য গৃহস্থলীর বিভিন্ন কাজও শেখাতেন। তিনি আমাকে বিভিন্ন সময়ে নিয়ে যেতেন- সবজি ক্ষেত, ধান ক্ষেত, ঐতিহাসিক স্থান, পর্যটক কেন্দ্র, চা বাগান, পুরাতন বিভিন্ন স্থাপনা, হওর, নদী, প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান দেখতে প্রভৃতি স্থানে। নিজের জীবনের কঠিন সময় ও তিক্ত অভিজ্ঞতার বাস্তবিক চিত্র তুলে ধরতেন সন্তানের চারিত্রিক দৃঢ়তার জন্য।

বাবার জীবন ঘটনাবহুল এক সংগ্রামী জীবন। বাল্যকালে মাতৃহারা, যৌবনে পিতৃহারা, বিবাহিত জীবনে স্ত্রী বিয়োগ ও পুনরায় দ্বার গ্রহণ, স্বাধীনতা সংগ্রামের পর অনেকটা ভঙুর আর্থিক অবস্থা থেকে উত্তরণের চেষ্টা। সব কিছু কঠিনতম জীবন সংগ্রামের দীর্ঘতম পথ। কিন্তু এতকিছুর মধ্যেও তিনি নীতিভ্রষ্ট হননি, আদর্শচ্যুত হননি। সত্য ও ন্যায়ের পথে ছিলেন আজীবন। এই রকম একজন পুণ্যাত্মার ঔরসজাত হয়ে আমি সত্যিই গর্বিত।

আমার বাবা সব সময় উপদেশ দিতেন- "কারো উপকারে না আসলেও কারো ক্ষতির কারণ যেন না হই। সদা সত্য কথা বল। সত্যই ধর্ম। কখনো নীতিচ্যুত হয়ো না, স্বধর্মকে কখনো ত্যাগ করো না। তুমি যে পেশায়ই থাকো, সাধারণ মানুষ যেন উপকৃত হয়।"

বাবা ছিলেন আপাদমস্তক নিরেট একজন সজ্জন ব্যক্তি। বহিরঙ্গে তাঁকে অনেক কঠোর ও রাগি মনে হলেও বাবা ছিলেন - কোমল মনের, স্নেহ ও মমত্ববোধে পরিপূর্ণ একজন মানুষ। যে কোন ব্যক্তি সে আত্মীয়ই হোক কিংবা অপরিচিতজন, তাঁর কাছে আসলে তিনি সাধ্যমতো সহযোগিতা ও সৎ পরামর্শ দিতেন।

তিনি আমাদের পরিবারের জন্য যেমন আজীবন সংগ্রাম করেছেন, তেমনি সমাজকেও কিছু দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ছাত্রজীবনে যেমন নিজের জীবনকে তুচ্ছজ্ঞানে মৃত্যুকে উপেক্ষা করে দেশের স্বাধীনতার জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তেমনি কর্মজীবনে এসেও সরকারি উচ্চবেতনের চাকুরীতে যোগদানের সুযোগ পেলেও তা গ্রহণ করেনি। সমাজকে সুশিক্ষার আলোয় আলোকিত করার প্রয়াসে শিক্ষকতাকেই জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন। মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষক এই দুই পরিচয় তাঁর ব্যক্তিত্বকে যেমন অনন্য উচ্চতায় তুলেছিল, তেমনি আমিও এই দুই পরিচয়ের গুণান্বিত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী হিসেবে গর্ববোধ করি।

বাবা দেখতে যেমন ছিলেন সুপুরুষ, তেমনি ছিলেন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। সত্তরোর্ধ বয়সেও তাঁর জীবন যাপনে ডাক্তারি কোন নিষেধাজ্ঞা ছিল না। জীবনপ্রণালী ছিল অত্যন্ত গোছানো, পরিপাটি ও মার্জিত। কিন্তু হঠাৎ ১অক্টোবর ২০১৭ ইংরেজি তারিখে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এক মাস মোটামুটি সুস্থ থাকলেও পরবর্তী সময়ে অবস্থা ক্রমাগতভাবে অবনতি হতে থাকলে প্রথমে প্রাইভেট ক্লিনিক, তারপর সিলেট ওসমানী মেডিকেল হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল হাসপাতাল ও মাদ্রাজ শহরের গ্লোবাল হসপিটালসিটিতে উন্নত চিকিৎসার পরও আর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারেন নি। অবশেষে নিজ বাড়িতে শ্রীমদ্ভাগবত শ্রবণকালীন সময়ে মায়াময় পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে মহান বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭ ইংরেজি তারিখে অনন্তের পথে যাত্রা করেন।

বিখ্যাত জার্মান কবি নোবেল বিজয়ী টমাস মান মৃত্যুকে এভাবেই দেখেছেন- "A man's dying is more the the sarvirrs affairs than his own." অর্থাৎ "মৃতের জন্য মৃত্যু কোন বিষয়ই না। কিন্তু মৃত ব্যক্তির আশেপাশে যারা থাকে, তাদের জন্য সে অনুভূতি খুবই দুর্বহ। যা তাদের হৃদয়ে দাগকাটে আজীবন।"

বাবা নেই আমি এখনো মানতে পারিনা। অথচ আমি নিজে তাঁকে মুখাগ্নি করেছি। বাবা দেহত্যাগ করলেও আমার হৃদয় জুড়ে, আমার চৈতন্য জুড়ে তিনি থাকবেন আজীবন। আমার সুখে-দুঃখে, সাফল্যে-ব্যর্থতায় আমার চিরসঙ্গী হয়ে, আমার স্বর্গ হয়ে। শাস্ত্রে আছে (পিতার প্রণাম মন্ত্র) - পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিতাহি পরমং তপ/ পিতোরি প্রিতিমা পন্নে প্রিয়ন্তে সর্ব দেবতা, অর্থাৎ "পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিতাই পরম তপস্যা। পিতাকে ভজন করলে সব দেবতা সন্তুষ্ট হন।" আমি আমার বাবার ভজন করতে পেরেছি কিনা জানিনা। তবে আজীবন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে যাব তাঁর পরমগতি কামনায়।

  • রত্নদীপ দাস রাজু : শিক্ষানবিস আইনজীবী; সদস্য সচিব, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড, নবীগঞ্জ, হবিগঞ্জ। ইমেইল: [email protected]

আপনার মন্তব্য

আলোচিত