আব্দুল করিম কিম

২৩ জুলাই, ২০১৮ ১৭:৪৮

ফ্যাসিবাদ ব্যাধির চৌদ্দটি উপসর্গ

ফ্যাসিজম বা ফ্যাসিবাদ হচ্ছে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা। একে মতাদর্শ বলার কোন মানে নেই। ফ্যাসিজম হচ্ছে ব্যক্তিতন্ত্র বা স্বৈরতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা, যেখানে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার প্রকৃত কোনো সুযোগ থাকে না। ফ্যাসিবাদে ভিন্নমতের কোন ঠাঁই নেই। ফ্যাসিবাদ ভিন্নমতকে সহ্য করে না।

ফ্যাসিবাদীরা মনে করে তাঁদের চেয়ে উত্তম ভাবনা কেউ ভাবতে পারে না। ফ্যাসিজম বা ফ্যাসিবাদ সবকিছুকেই রাষ্ট্রের নামে নিজেদের অধীন বলে মনে করে। রাষ্ট্র হচ্ছে ঢাল, সেই ঢালের নেপথ্যে থাকে একটি সর্বগ্রাসী দল বা গোষ্ঠী। ফ্যাসিবাদে রাষ্ট্রের গুরুত্বের ওপর জোর দেয়া হয়। ফ্যাসিবাদীরা রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব নিজেদের হাতে নিয়ে নিলেই নিজেদের স্বরূপ প্রদর্শন করে। ফ্যাসিবাদীরা জনগণকে ভয় দেখায় রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষা করতে হলে, যেভাবে যা চলছে সেভাবে সব চলতে দাও । এর ব্যতয় ঘটলেই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে।

রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার ভয় দেখাতে ফ্যাসিবাদে অনেক সহযোগী শক্তি তৈরি করে। এই শক্তির মধ্যে থাকে সুবিধাভোগী করপোরেট ধনিক শ্রেণী, রাষ্ট্রীয় আনুকুল্য পাওয়া বুদ্ধিজীবী, স্থাবক পেশাজীবী, বশংবদ গণমাধ্যম, সর্বোচ্চ অনুদানপ্রাপ্ত সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলাবাহিনী।

এরা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের অবকাঠামোকে একসাথে বেঁধে রাখে । ইতালিয়ান ভাষায় ‘ফ্যাসিজম’ (fascism) শব্দটির উৎপত্তি ‘ফ্যাসিও’ (fascio) থেকে। ফ্যাসিজম বা ফ্যাসিবাদ কথাটার সূত্র এখানে। লাঠিসোঁটা একসঙ্গে জড়ো করে তার সঙ্গে একটা কুঠার শক্তভাবে বেঁধে সহজে বহন করার জন্য যে শৃঙ্খলা বা বোঝা তৈরি হয় তাকে ল্যাটিন ভাষায় বলা হয় ‘ফ্যাসকেস’ (fasces)। ফ্যাসিজম বা ফ্যাসিবাদে লাঠির প্রয়োজন। হালের ফ্যাসিবাদীরা শুধু লাঠিতে আস্থা রাখতে পারে না। কুড়াল, চাপাতি, হাতুড়ি প্রদর্শনেরও প্রয়োজন হয়।

ফ্যাসিবাদের জনক বলা হয় মুসোলিনিকে। যার পুরো নাম বেনিটো অ্যামিলকেয়ার আন্দ্রে মুসোলিনি (জন্ম ১৮৮৩ সালের ২৯ জুলাই, নিহত হন ১৯৪৫ সালের ২৮ এপ্রিল)। পেশাগতভাবে তিনি ছিলেন ইতালীয় রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, ঔপন্যাসিক, শিক্ষক ও সৈনিক। নেতৃত্ব দেন ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টির। তার দ্বারা ইতালিতে ফ্যাসিবাদের সূচনা হয়েছিলো। ১৯২২ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে মুসোলিনি ইতালির ৪০তম প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯২৫ সাল থেকে ‘ইল ডুসে’ বা ‘দ্য লিডার’ উপাধি ব্যবহার করতে শুরু করেন। ডুচে হচ্ছে ইতালীয় খেতাব, যার অর্থ ‘নেতা’। যেমন হিটলার গ্রহণ করেন তার ‘ফুয়েরার’ খেতাব। ফুয়েরার শব্দের অর্থও ‘নেতা’। ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টির নেতা মুসোলিনিকে ফ্যাসিস্টরা তাদের ফ্যাসিস্ট আন্দোলনের নেতা হিসেবে ধরে নেয়। সরকারপ্রধান ও ফ্যাসিজমের নেতা হিসেবে তিনি ১৯২৫ সালে ইতালিতে যে ফ্যাসিজমের প্রতিষ্ঠা করেন, তা ধরে রাখেন ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত। ১৯৩৬ সালের পর মুসোলিনির সরকারি পদবি ছিল: ‘হিজ এক্সেলেন্সি বেনিটো মুসোলিনি, হেড অব গভর্নমেন্ট, ডুচে অব ফ্যাসিজম, অ্যান্ড ফাউন্ডার অব দ্য এম্পায়ার’। তিনি অধিকার করেছিলেন একটি বিশেষ সামরিক পদ : ‘ফার্স্ট মার্শাল অব দ্য এম্পায়ার’। রাজার পদমর্যাদার তার আরেক উপাধি ছিল : ‘ভিক্টর তৃতীয় ইমানুয়েল’। এ উপাধি সূত্রে তিনি ইতালির সামরিক বাহিনীর ওপর সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণাধিকার প্রয়োগ করতেন। তিনি ৭০০০ এর বেশি ইহুদিকে ইতালি থেকে বহিষ্কার করেছিলেন। এদের মধ্যে প্রায় ৬০০০ ইহুদিকে পরে হত্যা করা হয়েছিল।

মুসোলিনির ফ্যাসিবাদের উপাদানগুলোর মধ্যে ছিল: ন্যাশনালিজম, করপোরেটিজম, ন্যাশনাল সিন্ডিক্যালিজম, এক্সপানশন্যালিজম, সোস্যাল প্রগ্রেস, অ্যান্টিসোস্যালিজম। আর এর সাথে সম্মিলন ঘটানো হয় রাষ্ট্রীয় প্রোপাগান্ডা ও সেন্সরশিপ অব সাববারসিভ। আন্দ্রে মুসোলিনির 'ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টি' ফ্যাসিবাদের চর্চা শুরু করলেও বিশ্বের পরবর্তী ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সাথে 'ফ্যাসিস্ট' শব্দটি যুক্ত ছিলো না।

জার্মানির এডলফ হিটলার (১৮৮৯-১৯৪৫) এর ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি, স্পেনের ফানসিস্কো ফ্রাঙ্কো (১৮৯২-১৯৭৫) এর ট্রেডিশনালিস্ট স্প্যানিশ ফালানক্স এন্ড অফ টি কাউন্সিলস অফ টি ন্যাশনাল সিন্ডিক্যালিস্ট অফেন্সিভ, পর্তুগালের এন্তনিও দ্য অলিভিয়েরা সালাজার (১৮৮৯-১৯৭০) এর দ্যা ন্যাশনাল ইউনিয়ন, ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তো (১৯২১-২০০৮) এর গোলকার পার্টি, ইরাকের সাদ্দাম হোসেন (১৯৩৭-২০০৬) এর বাথ পার্টি, লিবিয়ার মোয়াম্মার  গাদ্দাফি (১৯৪২-২০১১) এর লিবিয়ান আরব সোসালিষ্ট ইউনিয়ন এর পৃথক পৃথক রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকলেও এরা নিজেদের শাসনকালে ফ্যাসিজমের চর্চাই করেছেন। ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টি দিয়ে ফ্যাসিজমের যাত্রা হলেও রাষ্ট্র নামক কাঠামো গঠনের আদিকাল থেকেই ছিল 'ফ্যাসিবাদ' ছিল।

মার্কিন ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ওয়াল্টার ল্যাকুয়ার (Walter Ze'ev Laqueur, Born 26 May 1921)  ফ্যাসিজম: পাস্ট, প্রেজেন্ট, ফিউচার বইয়ে বলেছেন, "...একটি বৈশিষ্ট্য ফ্যাসিবাদকে অতীতের সব স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থাগুলো থেকে আলাদা করেছে। ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় একটি বিশাল রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি থাকে। আর এই দলটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে ক্ষমতার একচেটিয়াকরনে সমর্থ হয়। এটা করতে গিয়ে তারা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় সহিংসতা প্রয়োগ করে থাকে। এভাবে তারা সব বিরোধী পক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। এই ধরনের দলের নেতৃত্বে এমন একজন নেতা/নেত্রী থাকেন, যিনি দৃশ্যত সীমাহীন ক্ষমতাশালী। তাকে তার অনুসারীরা দেব-দেবীর মতই পূজা-অর্চনায় সিক্ত রাখে। তাদের এই আনুগত্য প্রায় ধর্মীয়ভক্তির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। এই রাজনৈতিক দলটি শুধু তাদের নিজেদের জন্যই নয় বরং তাদের নিজস্ব মতাদর্শিক বিশ্বাসকে বাকি সব নাগরিকদের জন্যই বাধ্যতামূলক করে তোলে। একটি শক্তিশালী প্রোপাগান্ডার ব্যবস্থার মাধ্যমে এই মতাদর্শিক বিশ্বাসকে তারা প্রতিনিয়ত প্রচার করে থাকে।"

১৯৯৬ সালে প্রকাশিত 'ফ্যাসিজম: পাস্ট, প্রেজেন্ট, ফিউচার' বইটির পৃ. ১৪ তে এই কথাগুলো আছে। বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মাহতাব উদ্দিন আহমেদ।

মুসোলিনি, হিটলার নিজেদের ফ্যাসিস্ট আচরণ সগর্বে স্বীকার করতো কিন্তু বর্তমান বিশ্বে ফ্যাসিজমকে বিব্রতভাবে অস্বীকার করা হয় । আধুনিক বিশ্বে ফ্যাসিবাদ হচ্ছে রাষ্ট্রের গোপন ব্যাধি। যার উপসর্গ বোঝা যায় কিন্তু ব্যাধির কথা প্রকাশ করা যায় না। ফ্যাসিবাদের এই উপসর্গ সম্পর্কে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. লরেন্স ব্রিট একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর লিখিত প্রবন্ধে ("Fascism Anyone?," Free Inquiry, Spring 2003, page 20) ফ্যাসিবাদের চৌদ্দটি বৈশিষ্ট্য তিনি তুলে ধরেছেন, যা আদতে ফ্যাসিবাদ নামের রাষ্ট্রীয় ব্যাধির উপসর্গ। এই চৌদ্দটি উপসর্গ যখন কোন রাষ্ট্রে সম্পূর্ণরূপে সনাক্ত হয় তখন সেই রাষ্ট্রকে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র বলতে হবেই।

উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিশেষজ্ঞ একমত হয়েছেন যে, ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের সরকার অবশ্যই স্বৈরাচারী কিন্তু সকল স্বৈরাচারী সরকারের রাষ্ট্র ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র নয়। ড. লরেন্স ব্রিট হিটলার মুসোলিনিদেরকে দেখে দেখে নাকি এই উপসর্গ উদঘাটন করেছেন। তবে দুষ্ট লোকেরা বলে যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকানদেরকে চিহ্নিত করতেই নাকি তিনি এই লিস্টি তৈরি করেছেন। দেখা যাক ফ্যাসিবাদের চৌদ্দটি উপসর্গ বা লক্ষণগুলো কী- ১. উগ্র জাতীয়তাবাদ। ২. মানবাধিকারের প্রতি অবজ্ঞা। ৩. কমন শত্রু রাখা। ৪. সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্বোচ্চ সুবিধা প্রদান। ৫. প্রচণ্ড লিঙ্গ বৈষম্য। ৬. গণমাধ্যমকে কৌশলে নিয়ন্ত্রণ। ৭. জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উৎকণ্ঠা।  ৮. রাষ্ট্রে ধর্মের ব্যবহার। ৯. করপোরেট তোষণ। ১০. শ্রমিকদের ক্ষমতা হরণ। ১১. শিক্ষা ব্যবস্থা ও বুদ্ধিভিত্তিক কর্মকে অবজ্ঞা। ১২. অপরাধ নিয়ন্ত্রণে একাধারে ব্যর্থতা ও আকস্মিক কঠোরতা। ১৩. অবাধ স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণ এবং দুর্নীতি। ১৪. নির্বাচনে কারচুপি।

এই চৌদ্দটি উপসর্গ একের পর এক পাওয়া গেলে বুঝতে হবে রাষ্ট্র ফ্যাসিবাদের রোগে আক্রান্ত হতে চলেছে । আর চৌদ্দটি উপসর্গই পাওয়া গেলে নিশ্চিতভাবে বলা যাবে রাষ্ট্র ফ্যাসিবাদে মরণাপন্ন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত