রিপন দে

২৪ জুলাই, ২০১৮ ১৭:৪৯

একটি চুমুতে ঝড় ৫৬ হাজার বর্গমাইলে

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য টিএসসির একটি শুদ্ধ নির্মল ভালবাসার চুমুর ছবিকে কেন্দ্র করে সারা বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝড় উঠেছে। খুন, ধর্ষণ, সাম্প্রদায়িক হানাহানির খবরে সরব থাকে যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তা মুহূর্তেই পরিপূর্ণ হয়ে যায় ভালবাসায়। এ এক অপূর্ব ঘটনা।

প্রয়াত হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, 'একটি প্রকাশ্য চুম্বনে আমরা খান খান করে ভেঙ্গে দিতে পারি হাজার বছর বয়স্ক বাঙলার সামরিক আইন ও বিধান'। এরই বাস্তবতা দেখা গেলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। প্রতিক্রিয়াশীলরা মরিয়া হয়ে উঠল ছবিটিকে ভুল প্রমাণ করতে। এডিট করা ছবি বলে পরিকল্পিতভাবে অপপ্রচার চালানো হল। কিন্তু কেন এই অপপ্রচার করা হল? কি লাভ এতে? সাধারণ দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে চুমুর ছবিটি যেভাবে পজেটিভভাবে ভাইরাল হয়েছিল, সাধারণ মানুষ যেভাবে শুদ্ধ ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ছবিটিকে গ্রহণ করেছে সেখানে বেলেল্লাপনা আর সামাজিকতা বা দেশীয় সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে লাভ হচ্ছিল না তাই বাধ্য হয়ে ছবিটিকে বিতর্কিত করার আপ্রাণ চেষ্টা থেকেই এই অপপ্রচার চালানো হল। যেন ছবি মিথ্যে প্রমাণ করতে পারলেই তাদের সফলতা।

বরাবরের মত একটু চুমুকে ঘিরে বিভক্ত হয়ে গেল সমাজ। কেউ পক্ষে কেউ বিপক্ষে। যারা ছবিটির গভীরতা উপলব্ধি করে শুধু পবিত্র ভালবাসা খুঁজে পেয়েছেন তাদের কাছে ছবি শুধুই একটি ভালবাসার মুহূর্ত আর সমাজের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে চপেটাঘাত। অন্যদিকে যারা এই ছবির বিপক্ষে আছেন তাদের সেই এক কথা তথাকথিত সামাজিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় কুসংস্কার, দেশীয় সংস্কৃতির দোহাই। এখানে অনেক প্রগতিশীল আবার বিরুদ্ধতা করতে গিয়ে দেশীয় সংস্কৃতির দোহাই দিয়েছেন কিন্তু সংস্কৃতি এমন একটা ব্যাপার যা সময়ে সময়ে বদলে যায়।

এক সময় কোন নারীর সাথে একা দাড়িয়ে গল্প করলেও সামাজিক মূল্যবোধে আঘাত করতো, হাত ধরা সে তো মহাপাপ। কিন্তু সেই সংস্কৃতি বদলে গেছে এখন। নর-নারী বন্ধুর সাথে আড্ডা জমছে ঘরে, বাইরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা কর্মক্ষেত্রে। সেই ছবিও আসছে সামাজিক মাধ্যমে, সংস্কৃতির ব্যাপারটা আমি বিবর্তনের চোখেই দেখছি তাই সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে কোথাও আটকে থাকা যায় না, আটকিয়ে রাখা যায়না। নিখাদ ভালবাসার এই ছবিতে যারা বেলেল্লাপনা অশ্লীলতা খুঁজে পেয়েছেন আমি বিশ্বাস করি অশ্লীলতা তাদের মনে।

সাম্প্রতিককালে ধর্ষণের অভিযোগে আটক সিলেট ওসমানী মেডিকেলের এক ইন্টার্নি ডাক্তার ও ঢাকায় রাজপথে প্রাইভেটকারের ভিতরে ধর্ষণের অভিযোগে আটক দুইজনকে ফেসবুকেই আমরা দেখেছি। নারীর প্রতি বৈষম্যের পেছনে তারা সোচ্চার। সব কিছুতে তাদের দোহাই ছিল দেশীয় সংস্কৃতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অথচ তারাই ধর্ষক।

আশার কথা হচ্ছে তরুণ প্রজন্ম এই শৃঙ্খল ভেঙে দিতে চায় যার প্রমাণ চুমুর ছবিটি, ছবিটিকে পবিত্র ভালবাসার চিহ্ন হিসেবে যারা প্রচার করেছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তরুণ-তরুণেরাই।

যে কোন অপপ্রচার করতে গিয়ে যে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয় তা আবারো প্রমাণিত হল, যে এই ছবিটি তুলেছিলেন সেই ফটোগ্রাফার জীবন আহমেদ একটি অনলাইন গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, অফিসের অ্যাসাইনমেন্ট ছিল বৃষ্টির ছবি তোলার। টিএসসি ঘুরে ঘুরে ছবি তুলছিলেন কিন্তু মনপূত হচ্ছে না।

হঠাৎ তার চোখে পড়লো আকাশী-সাদা পোশাক পরা এক জুটি বৃষ্টিতে ভিজে ভালোবাসার চুমুতে আবদ্ধ। নির্মল, বিশুদ্ধ ভালোবাসা বিনিময়ের দুর্লভ দৃশ্য দেখেই ছবি তুললেন। ছবি পাঠালেন অফিসে। পোস্ট করলেন নিজের ফেসবুক টাইমলাইনে। ক্যাপশন দিলেন, “বর্ষামঙ্গল কাব্য… ভালোবাসা হোক উন্মুক্ত।” তারপর ইতিহাস সৃষ্টি করল এই ছবি মুহূর্তেই ছড়িয়ে পরল ৫৬ হাজার বর্গমাইলে। রীতিমত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কম্পন তুলে এই ছবি।

নচিকেতা গানে গানে বলেছিলেন, 'প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া এই দেশে অপরাধ/ঘুষ খাওয়া কখনই নয়'। তাও প্রমাণ হয়েছে কিছু যৌনকাতর বিকৃত মনের মানুষের মন্তব্য দেখে। এই দেশে প্রকাশ্যে রাস্তাঘাটে মেয়েদের পেছনে, স্তনে হাত দিলে প্রতিবাদ না করেই এই বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষরাই উপভোগ করে অথচ দুইজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নিজেদের সম্মতিতে নির্মল, বিশুদ্ধ ভালবাসায় আবদ্ধ হলেই এই মানসিক বিকৃতরাই সুশীল সাজার মুখোশে ঢুকে। সারা বছর দেশীয় সংস্কৃতির বিরোধিতা করে এখন সংস্কৃতি রক্ষায় মনোনিবেশ করে।

ওপার বাংলায় কিছুদিন আগে ঘোষণা দিয়ে গণজমায়েতের মাধ্যমে চুমুতেই হয়ে গেলো ভালবাসার প্রকাশ ও সামাজিক প্রতিবাদ।

কবির সুমন লিখলেন "ঠোঁটে ঠোঁট রেখে ব্যারিকেড কর প্রেমের পদ্যটাই, বিদ্রোহ আর চুমুর দিব্যি শুধু তোমাকেই চাই"। ভালবাসার ব্যারিকেডে ৫৬ হাজার বর্গমাইল থেকে হারিয়ে যাক হিংসা বিদ্বেষ আর রেষারেষি।

খুন-ধর্ষণ রেখে প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় পাতায় শিরোনাম হোক এমন হাজারো শ্বেত শুভ্র, নির্মল পবিত্র ভালবাসার চুমু।

  • রিপন দে: লেখক ও সাংবাদিক।
  • [প্রকাশিত লেখায় মতামত, মন্তব্য ও দায় লেখকের নিজস্ব]

আপনার মন্তব্য

আলোচিত