শামসুল ইসলাম শামীম

২১ আগস্ট, ২০১৮ ২১:১৪

কোরবানি: ত্যাগের পরীক্ষা

রাত পোহালেই ঈদুল আযহা বা কোরবানির ঈদ। বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ’র জন্য মহান আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে তাঁর বান্দাদের জন্য দু’টি বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসবের অন্যতম হচ্ছে ঈদুল আযহা বা কোরবানির ঈদ। এই ধর্মীয় উৎসবকে ঈদুজ্জোহাও বলা হয়ে থাকে। ঈদুল আযহা বা ঈদুল আজহা আরবি পরিভাষার অংশ বা বাক্যাংশ। বাংলায় যার সরল অনুবাদ আনন্দ বা উৎসব। আল্লাহ্‌ রাব্বুল আল-আমীন মুসলমানদের জন্য বৃহত্তম যে দু’টি উৎসব বা আনন্দের দিন নির্ধারণ করে দিয়েছেন তার একটি ঈদুল ফিতর বা রমজানের ঈদ এবং অপরটি ঈদুল আযহা বা কোরবানির ঈদ।

ঈদুল আযহা বা কোরবানির ঈদে তামাম বিশ্বের মুসলিম কি ভাবে উৎসব বা আনন্দ উদযাপন করবে? নেচে-গেয়ে? হইহুল্লোড় করে? নাটক-সিনেমা দেখে? নিশ্চয়ই না। এই উৎসব পালনের জন্য আল্লাহপাক যুগে যুগে নবী রাসুলদের মাধ্যমে তাঁর বান্দাদের কাছে অত্যাবশ্যকীয় নিয়মনীতির শিক্ষা দিয়েছেন। আরবি ঈদুল আযহার বঙ্গানুবাদ হলো ত্যাগের উৎসব। যার মূল প্রতিপাদ্য হলো ত্যাগ করা। আরেকটু বিশদ ভাবে বলতে গেলে বলতে হবে, এই ভূমণ্ডল ও নভোমণ্ডলের স্রষ্টা মহান রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ত্যাগ স্বীকার করা। বিশেষ এই দিনটিতে সামর্থ্যবান মুসলিম নিজ নিজ সাধ্যানুযায়ী উট, গরু, মহিষ, খাসি, ছাগল বা দুম্বা শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র নামে এবং তারই সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য জবেহ করে ত্যাগের পরীক্ষা দিয়ে থাকেন। আর এই ত্যাগের মাধ্যমেই বিশ্বমুসলিম উম্মাহ আল্লাহ্‌ প্রদত্ত উৎসব বা আনন্দ উদযাপন করে থাকেন।

কোরবানির ব্যাখ্যা আমরা নানা মুনির নানা মতে নানা ভাবে পাই। কারো মতে, ত্যাগের মানসিকতা গড়ে তোলার জন্য ইসলামে কোরবানির বিষয়টিকে জোরালো করা হয়েছে। আবার কারো মতে, নিজের মনের পশু বা পশুবৃত্তির কোরবানির জন্যই ইসলামে কোরবানিকে আঁকড়ে ধরা হয়েছে। আসলে এসব নানা মুনির নানা মত, নানা মতবাদ। আসলে কোরবানির শিক্ষাটা আমরা ভালোভাবে বুঝিনা বা বুঝার চেষ্টাও করিনা।

আজকের এই ত্যাগ বা কোরবানি আমরা যতো সহজে পালন করি, তা কিন্তু অতো সহজে আসেনি। আমরা জানি এজন্য মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.) কে কতো বড়ো অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছিলো। আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে যখন হযরত ইব্রাহিম (আ.) কে বলা হলো আল্লাহ্‌র নামে তার সবচে’ প্রিয় জিনিসটি কোরবানির জন্য, হযরত ইব্রাহিম (আ.) তখন ভাবনায় পড়ে গেলেন। একই আদেশে যখন তিনি তিনবার আদিষ্ট হলেন তখন ইব্রাহিম ভেবে দেখলেন জ্যেষ্ঠপুত্র ঈসমাইলের চেয়ে অধিকতর প্রিয় কেউ তার নেই।

ইব্রাহিম (আ.) মনস্থির করলেন, আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি লাভের জন্য তিনি প্রাণাধিক পুত্র ইসমাইলকে আল্লাহ্‌র নামে কোরবানি করবেন। হযরত ইব্রাহিম (আ.) ইসমাইলের কাছে মহান আল্লাহপাকের ইচ্ছার বিষয়টি খুলে বললেন। ঈসমাইল নিঃশঙ্কচিত্তে জবাব দিলেন, ‘হে আমার সম্মানিত পিতা। আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তা নিঃসঙ্কোচে কার্যকর করুন। ইনশাআল্লাহ, আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।’

ঈসমাইলের এই জবাবটির বিশদ ব্যাখ্যা করলে আমরা কোরবানির আসল শিক্ষা লাভ করতে পারি। আল্লাহপাক কি ঈসমাইলের প্রাণ চেয়েছিলেন? না কি ঈসমাইলের রক্ত? আমরা যে কোরবানি দিই সেই কোরবানির পশুর মাংস কি আল্লাহ্‌র কাছে পৌঁছে? না কি কোরবানিকৃত পশুর রক্ত? এসবের কোনটাই আল্লাহ্‌র কাছে পৌঁছায় না। আল্লাহপাক মূলত হযরত ইব্রাহিমের আল্লাহ্‌ ভীতির অকাট্য প্রমাণ দেখতে চেয়েছিলেন। তিনি দেখতে চেয়েছিলেন পরবর্তী পয়গম্বর হযরত ঈসমাইল আল্লাহ্‌র আদেশ পালনে নিজের প্রাণ উৎসর্গ করতে পারেন কিনা।

‘হে আমার প্রতিপালক। কেবল তোমারই সন্তুষ্টির জন্য তোমার এই সৃষ্টির প্রাণ যেভাবে তোমারই জন্য কোরবানি দিলাম, ঠিক তেমনিভাবে প্রয়োজনে তোমারই জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতেও কখনও কুণ্ঠাবোধ করব না, যেমন কুণ্ঠাবোধ করেননি ঈসমাঈল (আ)’- মূলত জাগতিক এই কোরবানির মাধ্যমে আমরা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলআমীনের সাথে এমনই প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হই। আর আল্লাহপাক তার প্রিয় বান্দাদের কাছে এমনটিই চান। তার আশরাফুল মাখলুকাত কেবলই তার জন্য বাঁচবে, তাঁর জন্যই মরবে। কোরবানির পশুর মতো নিজের বুকের রক্ত প্রবাহিত করতে প্রস্তুত থাকবে। বস্তুত, কোরবানির শিক্ষাই হলো এই।

  • লেখক: সিলেট ব্যুরো প্রধান, বাংলাভিশন

আপনার মন্তব্য

আলোচিত