মিখা পিরেগু

৩১ আগস্ট, ২০১৮ ১২:৫১

চা শ্রমিক নাকি শ্রমদাস?

সম্প্রতি ঢাকায় চা বাগান মালিক পক্ষের সংগঠন বাংলাদেশ চা সংসদের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে চা শ্রমিক ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দের নতুন মজুরি চুক্তি বিষয়ে দ্বি-পক্ষীয় বৈঠক হয়। এ বৈঠকে সমঝোতা চুক্তি (মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং -এম ও ইউ) অনুযায়ী চা শ্রমিকদের মজুরি দৈনিক ৮৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০২ টাকা করা হয়। একই সঙ্গে চা শ্রমিকরা বছরে দুটি উৎসব ভাতা পাবে ৪ হাজার ৫৯০ টাকা। নতুন চুক্তি কার্যকর হবে বিগত ১ জানুয়ারি ২০১৭ সাল থেকে। এখানে ১৭ টাকা মজুরি বৃদ্ধি ছাড়াও যুক্ত হয়েছে বাড়তি বোনাস সুবিধা। যা শ্রম বিধিমালা-২০১৫ তে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু এতে তৃপ্তির ঢেকুর না তোলে আমাদের এটা বোঝা উচিৎ এভাবে ক্রমাগতভাবে শ্রম আইন লঙ্ঘন করে মালিক-শ্রমিকদের দ্বি-পক্ষীয় চুক্তির ভিত্তিতে মজুরি নির্ধারণ প্রায় নজিরবিহীন। এই ধরনের চুক্তির নামে আপোষনামা উপরন্তু শ্রমিকদেরই ন্যুনতম অধিকার খর্ব করছে। এরূপ চুক্তিতে ২০১৩-১৫ সালে মজুরি ছিলো ৬৯ টাকা, ২০০৯-১১ সালে ৪৮ টাকা, ২০০৫-০৭ সালে ৩২ টাকা ও ২০০১-০৬ সালে ২৮ টাকা। বাংলাদেশে বর্তমানে চা শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ ৪০ হাজার। এর ৫২ শতাংশই নারী শ্রমিক। তাই তুলনামূলক দেশের প্রাতিষ্ঠানিক খাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত ও নিপীড়িত শ্রমিক রয়েছেন চা খাতে। চা শ্রমিকদের অধিকার এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আজন্ম ভূমি ও জন্ম পরিচয়ের অধিকার বঞ্চিত এ খাতের শ্রমিকেরা কর্মস্থলের নানান সুযোগ-সুবিধা, উন্নত আবাসন, সুচিকিৎসা প্রভৃতির অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কোনো ধরনের আন্দোলন, আলোচনা, সমালোচনা কোনোকিছুই দাগ কাটে না চা বাগান মালিক কিংবা রাষ্ট্রযন্ত্রের।

শুরু থেকেই বাংলাদেশে অন্যান্য শিল্প শ্রমিকের তুলনায় সবচেয়ে কম মজুরি পায় চা শ্রমিকেরা। মজুরী বোর্ডের উপাত্ত অনুযায়ী, ন্যুনতম মজুরীর মাসিক হিসেবে ট্যানারি (১২,৮০০ টাকা), নির্মাণ ও কাঠ (প্রায় ১০,০০০ টাকা), ফার্মাসিউটিক্যাল (৮০৫০ টাকা), ওয়েল মিলস এন্ড ভেজিটেবল প্রোডাক্টস (৭,৪২০ টাকা) এবং স মিলস (৬,৮৫০ টাকা) পায় । অন্যদিকে অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল চা এর শ্রমিকেরা পাচ্ছে ১৯৭৮ টাকা মাত্র। এদিকে গত জুলাইয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ‘জাতীয় মজুরি ও উৎপাদনশীলতা কমিশন-২০১৫’ এর সুপারিশ অনুসারে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দ্বিগুণ বাড়ানোর এই প্রস্তাব অনুসারে শ্রমিকদের ১৬টি গ্রেডে ভাগ করে গ্রেড অনুসারে সর্বোচ্চ ১১,২০০ টাকা এবং সর্বনিম্ন ৮,৩০০ বেতন নির্ধারণ করা হয়, আগের বেতন কাঠামোর প্রায় দ্বিগুণ।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার- ১৩১ নং কনভেনশনে বলা হয়েছে, “সর্বনিম্ন মজুরি অবশ্যই আইন দ্বারা নিশ্চিত করতে হবে। শ্রমিক ও তার পরিবারের প্রয়োজন, জীবন যাত্রার ব্যয়, সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধা ইত্যাদিকে বিবেচনায় নিয়ে ন্যুনতম মজুরি নির্ধারণ করতে হবে।” বিশ্ব মানবাধিকার ঘোষণায় বলা হয়েছে - ‘প্রত্যেক কর্মীর নিজের ও পরিবারের মানবিক মর্যাদা সম এমন ন্যায্য পারিশ্রমিক পাওয়ার অধিকার রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫নং অনুচ্ছেদে নাগরিকদের যুক্তিসঙ্গত মজুরির বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার বিষয়টি রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হিসেবে বলা হয়েছে। অথচ শ্রমিকদের মজুরি সংক্রান্ত এরূপ সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা কিংবা আন্তর্জাতিক ঘোষণাপত্র যার অনুস্বাক্ষরকারী হয়েও এই রাষ্ট্র প্রতিশ্রুতির ব্যত্যয় ঘটিয়ে চা শ্রমিকদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করছে।

বাংলাদেশের শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরী নির্ধারণ করা হয়। যদিও অনেক উন্নত দেশে “ন্যুনতম মজুরি আইন” নামে পৃথক আইন বিদ্যমান আছে। এই আইন প্রথম করা হয় নিউজিল্যান্ডে ১৮৯৬ সালে। এরপর অস্ট্রেলিয়ায় ১৮৯৯ সালে ও ব্রিটেনে ১৯০৯ সালে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ভেতরে শ্রীলংকায় ১৯২৭ সালে, ১৯৩৬ সালে ভারতে, ১৯৬১ সালে পাকিস্তানে প্রবর্তন করা হয়। বাংলাদেশে শ্রম আইন-২০০৬ এ বলা আছে, কিভাবে নিম্নতম মজুরী বোর্ড গঠন হবে, কিভাবে কাজ করবে, কোন বিষয়গুলো বিবেচনায় নেবে এবং কতদিনের মধ্যে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করবে, সবই সেখানে বলা হয়েছে। ন্যুনতম মজুরী বৃদ্ধি করার পেছনে জীবনযাত্রার খরচ, শ্রমিকের এবং তার পরিবারের চাহিদা, উৎপাদনের খরচ, উৎপাদনশীলতা, পণ্যের দাম, ভোক্তা মূল্য দিতে নিয়োগকারীদের ক্ষমতা, দেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থা, মুদ্রাস্ফীতির হার ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে থাকে। কিন্তু চা শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে এগুলোকে কখনোই বিবেচনায় নেওয়া হয় না। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) হিসেবে, ন্যুনতম মজুরি নির্ধারণের জন্য মূলত তিনটি মডেলকে বিবেচনায় নেওয়া হয়। এর প্রথম মডেলটি হচ্ছে, দারিদ্রসীমার ওপরে অবস্থানকারী একজন শ্রমিকের মাসিক খরচের হিসাব বিবেচনায় নিয়ে ন্যুনতম মজুরি ঠিক করা। দ্বিতীয় মডেলটি হলো, কাঙ্ক্ষিত পুষ্টি অর্জনের জন্য একজন মানুষের যে সুষম খাবার, তা বিবেচনায় নিয়ে ন্যুনতম মজুরি ঠিক করা। তৃতীয় মডেলটি হলো, শ্রমিকদের বর্তমান জীবনধারণের খরচের হিসাব বিবেচনা করে তার ওপর ভিত্তি করে ন্যুনতম মজুরি ঠিক করা। সিপিডি বলেছে, দারিদ্রসীমার ওপরের স্তরে অবস্থানকারী প্রায় পাঁচ সদস্যের একটি পরিবারে ‘জাতীয় খানা আয়-ব্যয় জরিপ অনুযায়ী খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভুত পণ্য ও সেবা কেনার ব্যয় মাসে ৯ হাজার ২৮০ টাকা। পরিবারের প্রধান উপার্জনকারীকে এক্ষেত্রে আয় করতে হবে ৬ হাজার ৪৪৫ টাকা। সিপিডির হিসেবে পরবর্তী দুটি মডেলে এই পরিমাণ আরও বাড়ে। কাঙ্ক্ষিত পুষ্টিহার অনুযায়ী খাবার গ্রহণ ও জীবনধারণের জন্য একজন শ্রমিকের প্রতিমাসে ন্যুনতম মজুরি প্রয়োজন ১৭ হাজার ৮৩৭ টাকা। অর্থাৎ বাজারমূল্য অনুযায়ী চা শ্রমিকদের মজুরি মোটেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

পুনরায় শ্রম আইনে ফিরে আসি। শ্রম আইনের ১১৫ নম্বর ধারায় উল্লেখ আছে কেবল মাত্র চা শ্রমিক ছাড়া সকল শ্রমিক ১০ দিন নৈমিত্তিক ছুটি প্রাপ্য হবে কিংবা শ্রম আইনের ১১৭ ধারায় উল্লেখ থাকে সকল শ্রমিক প্রতি ১৮ দিন কাজের জন্য এক দিন অর্জিত ছুটি প্রাপ্য হবে আর চা শ্রমিকেরা প্রতি ২২ দিনে এক দিন ছুটি প্রাপ্য হবে। শ্রম আইনের ৪৫ ধারায় উল্লিখিত প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা নারী চা শ্রমিকেরা অদ্যাবধি পায় নি। বরং মাতৃত্বকালীন ছুটির বিষয়ে সবাই উদাসীন। ৪৫ ধারায় বলা আছে তবে শর্ত থাকে যে, চা-বাগান শ্রমিকের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট চা-বাগানের চিকিৎসক কর্তৃক যতদিন পর্যন্ত সক্ষমতার সার্টিফিকেট পাওয়া যাইবে ততদিন পর্যন্ত উক্ত শ্রমিক হালকা ধরণের কাজ করিতে পারিবেন ৷ এরূপ বৈষম্য খোদ শ্রম আইনে বিদ্যমান থাকায় চা শ্রমিকদের অন্যান্য সুবিধাদি যেমন বাধ্যতামূলক গ্র্যাচুয়াটি ও গ্রুপবীমার ব্যাপারে এখনো কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। শ্রম আইনের ৯৫ ধারায় চা-বাগানে বিনোদন ও শিক্ষার সুবিধা সম্পর্কে সরকারকে বলা হয়েছে –“(ক) বিধি প্রণয়ন করিয়া উহার প্রত্যেক মালিককে সেখানে নিযুক্ত শ্রমিকগণ এবং তাহাদের শিশু সন্তানগণের জন্য বিধিতে উল্লিখিত বিনোদনমূলক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করার জন্য নির্দেশ দিতে পারিবে; (খ) যে ক্ষেত্রে কোন চা-বাগানের শ্রমিকগণের ছয় হইতে বারো বছর বয়সী শিশু সন্তানগণের সংখ্যা পঁচিশ এর উপরে হয় সে ক্ষেত্রে, বিধি প্রণয়ন করিয়া উহার মালিককে, বিধিতে উল্লিখিত প্রকারে এবং মানের শিশুদের শিক্ষার সুযোগ এর ব্যবস্থা করিবার জন্য নির্দেশ দিতে পারিবে; (গ) প্রতিটি চা বাগানে শ্রমিকদের এবং তাহাদের সন্তানদের জন্য বিধি দ্বারা নির্ধারিত পন্থায় উপযুক্ত চিকিৎসা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে”। শ্রম আইনের ৫৯ ধারা মতে প্রত্যেক কর্ম ক্ষেত্রে নারী পুরুষের জন্য পৃথক ও স্বাস্থ্য সম্মত শৌচাগার ও ল্যাট্রিনের ব্যবস্থা করা মালিকের দায়িত্ব। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে প্রতিটি চা বাগানে নামমাত্র চিকিৎসা কেন্দ্র যেখানে সকল রোগের ওষুধ প্যারাসিটামল। নেই কোনও পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা। চা বাগানের শিশুদের সুস্থ বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা যেমন নেই তেমন নেই পর্যাপ্ত শিক্ষার সুযোগ। প্রতিটি চা বাগানে একটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও। বর্তমান শিক্ষা কাঠামোর বিচারে এগুলোকে অপূর্ণাঙ্গই বলা চলে। শ্রম আইনের ৯৬ ধারায় বাগান মালিকদের বলা হয়েছে “প্রত্যেক চা বাগানের মালিক চা বাগানে বসবাসরত প্রত্যেক শ্রমিক এবং তাহার পরিবারের জন্য গৃহায়নের সুবিধার ব্যবস্থা করিবেন।” কিন্তু পরিবার প্রতি ৭৫০ বর্গফুটের একটি আধা কাঁচা বাসস্থানই ইঙ্গিত করে সরকারের মতো বাগান মালিকেরাও এক্ষেত্রে আইন লঙ্ঘন করে শোষণ জারি রেখেছে। এমনকি ১৯৬২ সালের টিপ্ল্যান্টেশন লেবার অর্ডিন্যান্স এবং ১৯৭৭ সালের প্ল্যান্টেশন রুলস-এ চা শ্রমিকদের শিক্ষা, বসবাস ও স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার জন্য বাগান মালিকদের প্রতি সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও এর ন্যুনতমও বাস্তবায়ন হয়নি।

জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে আমাদের দেশে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারি কর্মকর্তাদের বেতনও দিগুণ হয়েছে। সরকারি কারখানা শ্রমিকেরও বেতন দিগুণ বেড়েছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়লে এটা যেমনি মন্ত্রী-এমপি-আমলাদের জীবনমানকে প্রভাবিত করে তেমনি চা শ্রমিকদেরও প্রভাবিত করে। কিন্তু সরাসরি উৎপাদনশীলতার সাথে যুক্ত থেকেও চা শ্রমিকদের মজুরি শুধু হতাশাজনক নয় বরং লজ্জারও। অধিক মজুরি সরাসরি উৎপাদনশীলতাকেই ত্বরান্বিত করতে পারে। চা শ্রমিকদের মজুরি বাড়লে রাষ্ট্রেরই সুবিধা বেশি কারণ তারা দেশের টাকা দেশে খরচ করবে। বিভিন্ন সেক্টর ভিত্তিক ন্যুনতম মজুরী বোর্ড গঠিত হলেও চা সেক্টরে অদ্যাবধি ন্যুনতম মজুরি বোর্ড গঠিত হয়নি। তাই মালিক-শ্রমিকের এরূপ প্রহসনমূলক দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অনতিবিলম্বে প্রত্যাখ্যান করে চা শ্রমিকদের জন্য পৃথক ন্যুনতম মজুরি বোর্ড গঠন করে বাজারদরের সাথে সঙ্গতি রেখে জীবনধারণের মতো মজুরি নির্ধারণ সময়ের দাবি। অন্যথায় চা শ্রমিকেরা এই শ্রমদাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পাবে না।

  • মিখা পিরেগু: যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বিশ্ববিদ্যালয় চা ছাত্র সংসদ; শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।  
  • [প্রকাশিত লেখার মতামত, মন্তব্য ও দায় লেখকের নিজস্ব]

আপনার মন্তব্য

আলোচিত