সজল চন্দ

০২ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ১৭:৩৬

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব ও অন্তর্ধান

ভগবানের জন্ম, কর্ম, লীলা সবই অপ্রাকৃত দিব্য আনন্দের। সে সম্পর্কে ভগবান গীতায় অর্জুনকে বলছেন- জন্ম কর্ম চ মে দিব্যমেবং যো বেত্তি তত্ত্বতঃ/ত্যাক্তা দেহং পুনর্জন্ম নৈতি মামেতি সোহর্জুন। ভ.গীতা ৪/৯) অর্থাৎ "হে অর্জুন যিনি আমার জন্ম কর্ম সম্পর্কে বিশুদ্ধভাবে জানেন, তাঁকে মৃত্যুর পর এই ভৌতিক জগতে আর, জন্মগ্রহণ করতে হয় না, তিনি সরাসরি আমার নিত্য ধাম প্রাপ্ত হন।

"আমরা দেখতে পাই ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য ভগবান চারিযুগে চারটি ভিন্ন ভিন্ন রূপ ও বর্ণ পরিগ্রহ করে আবির্ভুত হন। ভগবান কেন যুগে যুগে আবির্ভুত হন সে সম্পর্কে তিনি ভগবত গীতার (৪/৮) শ্লোকের মাধ্যমে বর্ণনা করে বলেছেন - পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দূষ্কৃতাম্/ ধর্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভাবামি যুগে যুগে। অর্থাৎ "সাধুদের রক্ষা করার জন্য এবং দুষ্কৃতকারীদের বিনাশ করার জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।"

কলিযুগে ভগবান কখন আবির্ভুত হবেন সে সম্পর্কে শ্রীমদ্ভাগবত এবং বৈদিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে কলিযুগে ভগবান তিনটি ভিন্ন অবতারে আবির্ভূত হবেন। তিন অবতারের একজন হচ্ছেন ভগবান বুদ্ধদেব আরেকজন ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু। এই দুই অবতারে ভগবান ইতোমধ্যে লীলা বিলাস সম্পূর্ণ করেছেন।

কলিযুগের তৃতীয় অবতার রূপে ভগবান কল্কিদেব সম্বল নামক গ্রামে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে কলিযুগের শেষাংশে আবির্ভুত হবেন। এখন এই তিন অবতারের কার্য কি হবে সেটা ও শ্রীমদ্ভাগবতে বর্ণনা করা আছে।

বুদ্ধদেব সম্পর্কে ভাগবতে বলা হয়েছে -সন্মোহায় সুর - দ্বিষাম "ভগবান বুদ্ধদেব আবির্ভুত হবেন নাস্তিকদের দণ্ড দিয়ে সমাজে অহিংসা নীতি প্রতিষ্ঠা করা।

শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কার্য সম্পর্কে বলা হয়েছে তিনি হবেন প্রেমের অবতার। তাঁর কার্য দণ্ড দেওয়া নয়, তিনি পাপী তাপি সবার মাঝে কৃষ্ণ নামের প্রেমসূধা বিতরণ করবেন। ভগবানের শুদ্ধ নাম বিতরণে তিনি সর্বদা নিয়োজিত থাকবেন নাম রূপে কৃষ্ণ অবতার। কলিযুগের সর্বশেষ অবতার কল্কি অবতারের কার্য তাহলে কি? কল্কি অবতারের আসার এখন ও ৪ লক্ষ ২৭ হাজার বছর বাকি আছে। কল্কি অবতারের কার্য সম্পর্কে ভাগবতে আছে তিনি দুষ্কৃতকারীদের বিনাশ করে পুনরায় সত্যযুগের সূচনা করবেন।

সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর কলি এই চারটি যুগকে একত্রে বলা হয় এক দিব্য যুগ এরকম একহাজার দিব্যযুগে ব্রহ্মার হয় একদিন। ব্রহ্মার একদিনে ভগবান একবার এ পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন। এমনই এক দিব্যযুগে দ্বাপরের শেষভাগে ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে কংসের কারাগারে চতুর্ভুজ বিষ্ণুরুপে জনক জননীর সামনে আবির্ভুত হন। পরে তিনি দ্বিভুজ শ্যামসুন্দর রূপে প্রকাশিত হন।

যাহোক এতক্ষণ আমরা ভগবানের আবির্ভাব ও আবির্ভাবের কারণ সম্পর্কে জানলাম। এবার দৃষ্টিপাত দেওয়া যাক ভগবানের অন্তর্ধান রহস্যর দিকে।

ভগবানের অন্তর্ধান সম্পর্কিত বিষয়ে আমাদের অনেকেরই শাস্ত্রীয় সুস্পষ্ট কোন ধারণা নেই। অনেকেই অনেক ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে মনগড়া ব্যাখ্যা প্রদান করে থাকেন। অনেকেই মনে করেন যে, জরা নামক ব্যাধের শরাঘাতে শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু ভগবান নিজেই গীতায় বলেছেন তিনি জন্ম মৃত্যুর অতীত। অর্থাৎ তিনি অজ এবং অব্যয়। তাহলে শিকারির সামান্য আঘাতে কিভাবে তাঁর মৃত্যু হয়? ভগবানের অন্তর্ধান রহস্য শ্রীমদ্ভাগবত, মহাভারত ও অন্যান্য প্রামাণিক শাস্ত্রীয় গ্রন্থের আলোকে সংক্ষেপে আলোচনা করার চেষ্টা করছি।

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ছত্রিশ বছর পর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বিভিন্ন অশুভ লক্ষণ দেখে যাদবগণকে প্রবাসে সরস্বতী নদীর তীরে স্বস্ত্যয়নাদি সম্পাদন করতে আদেশ করেন। যাদবগণ কৃষ্ণের আদেশ অনুসারে প্রবাসে গমন করেন। সেখানে তাঁরা উৎসবে মগ্ন হন এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মায়াশক্তির দ্বারা মোহিত হয়ে মৈরেয় নামক মিষ্টি পানীয় পান করে সবাই নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ফলে তাঁরা নিজেরা নিজেদের মধ্যে কলহ করে একে অপরকে হত্যা করে যার বদৌলতে যাদবগণের কেউ আর জীবিত ছিলেন না।

এদিকে শ্রীবলরাম সমুদ্রতীরে গমন করে নিজের মধ্যে নিজেকে বিলীন করে নিত্যধামে প্রবেশ করেন। বড় ভাই বলরামের অন্তর্ধান দর্শন করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শোকে মৌনভাবে ভূমিতে উপবেশন করেন। তারপর জরা নামক এক শিকারি দূর থেকে ভগবানের বাম পদতলকে হরিণ মনে করে তীর বিদ্ধ করে। শিকারি তৎক্ষণাৎ তার ভুল বুঝতে পেরে ভগবানের পদতলে পতিত হয়ে তার এহেন কার্যের জন্য দণ্ড গ্রহণের অনুরোধ করে। কিন্তু ভগবান শিকারিকে বলেন যে, সে যে কার্য করেছে তা তাঁর (ভগবানের) ইচ্ছায় সংঘটিত হয়েছে। এতে তার অনুশোচনা করার কোন কারণ নেই এবং দণ্ড গ্রহণের ও প্রয়োজন নেই।

আসলে ভগবান ত ভক্ত বৎসল। তাঁর ভক্তের দোষ ত্রুটি তিনি মার্জনা করেন। কিন্তু কেউ যদি তাঁর ভক্তের চরণে অপরাধ করে তবে সেটি তিনি মার্জনা করেন না। অতঃপর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সেই শিকারিকে ক্ষমা করে বৈকুণ্ঠ ধামে প্রেরণ করেন এবং তিনি তাঁর নিত্যধাম গোলক বৃন্দাবনে প্রবেশ করেন। এই হল ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অন্তর্ধান রহস্য।একটু মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে প্রতীয়মান হয় যে, যিনি কালীয় নাগ, অকাসুর, বকাসুর সহ বড় বড় অসুরদের বধ করলেন এমনকি পুতনার মত রাক্ষসীর বিষ মাখানো স্তন পান করেও যার মৃত্যু হয় নি,তার কিভাবে সামান্য এক শিকারির ছোঁড়া তীরে মৃত্যু হবে?কিন্তু আমরা এ ঘটনাকে বিকৃত করে নিজের মত করে প্রচার করছি কোন শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা ছাড়াই। ভগবান অজ হয়েও জন্মগ্রহণ করেন। কেন করেন? তাঁর ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করার জন্য সাধুদের রক্ষা করার জন্য। আবার অব্যয় হয়ে ও অন্তর্ধান হন। এসবই তাঁর দিব্য আনন্দের প্রকাশ। জয় শ্রীকৃষ্ণ

  • সজল চন্দ: ছড়াকার।
  • [প্রকাশিত লেখায় মতামত, মন্তব্য ও দায় লেখকের নিজস্ব]

আপনার মন্তব্য

আলোচিত