আলমগীর শাহরিয়ার

০৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ১৮:২৫

নায়ক সালমান শাহ ও বিটিভির দিনগুলি

সিলেট শহরে নায়ক সালমান শাহ বাসা ছিল দাড়িয়াপাড়ায়, আমাদের মামাদের বাসা থেকে কয়েক বাসা দূরে। শাদা দেয়াল ঘেরা ছোট্ট এক চিলতে উঠোন আর টিনশেডের একটি ছিমছাম দৃষ্টিনন্দন বাড়ি। বাসার নেমপ্লেটে লেখা শুধু-সালমান শাহ। আমি যতবার ওই বাসার পাশ দিয়ে যেতাম একটু অন্যরকম কৌতূহল নিয়ে বাসাটার দিকে তাকাতাম। তখন খুব ছোট ছিলাম। স্কুলে পড়ি মাত্র। তখন থাকি মামা বাড়ি বিশ্বনাথে। গ্রামে গঞ্জে সবেমাত্র বিদ্যুৎ আর টেলিভিশন গেছে।

গেল শতাব্দীর শেষ দশকের কথা বলছি। বিটিভির যুগ। প্রতি শুক্রবার তখন বেলা তিনটায় বিটিভিতে একটা সিনেমা দেখায়। বাকি ছয়দিন কী ব্যাকুল প্রতীক্ষায় থাকি এই শুক্রবার দিনটার জন্য। সকালের অনুষ্ঠান শেষে দুপুর বারোটায় সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে পরবর্তী অনুষ্ঠান সূচির ঘোষণা থাকত। আমাদের মূল আকর্ষণ থাকত বিকেলে তিনটায় বাংলা ছায়াছবি কি থাকছে সে ঘোষণায়।

যেদিন শুনতাম রাজ্জাক, শাবানা বা কবরীর ছবি বুঝতাম আজ শুধু কান্নাকাটি হবে। জগত সংসার কেবলই দুঃখময়। সুখ নাই। সুখ অধরা চিরকাল। নায়ক জসীম, ইলিয়াস কাঞ্চন, দিতি এরা থাকলেও কিছুটা মারামারি বা ফাইটিং দৃশ্যের আশা করা যায়। সোহেল রানা বা রুবেল থাকলে তো কোনো কথাই নাই। আর কালেভদ্রে যেদিন শুনতাম সালমান শাহ, মৌসুমী বা শাবনূর সেদিন আকাশে দিনের বেলাই উজ্জ্বল চাঁদ উঠত আমাদের। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ তখনো সোনার হরিণের মত দুর্লভ। কেবল শোনা যায়। ছবির মাঝপথে অথবা ধুকপুকুনিয়া প্লট বা দৃশ্যের অন্তিম মুহূর্তে হঠাৎ বিদ্যুৎ নাই। আমরা ছোটরা বের হয়ে দিতাম ভো দৌড়। দৌড় দিতাম যাদের বাড়িতে ব্যাটারিতে টিভি দেখানো হয় তাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।

এমনও হয়েছে যে পাশের দু’এক বাড়িতে পাইনি বলে পাশের গ্রামে পর্যন্ত দৌড়ে ছুটে গেছি ছবির শেষ মুহূর্ত দেখব বলে। ছোটদের সিনেমা দেখাকে তখনো বড়োরা অনুমোদন করেন না। বখে যাওয়ার ব্যাপার-স্যাপার বলেই গণ্য করতেন। তাদের মারপিটের বা দৌড়ানির বিড়ম্বনায় অনেকবার কুপোকাত হয়েছি। বিশেষ করে রাতের বেলা যখন ‘আলিফ লায়লা’ বা ‘সিন্দাবাদ’ সিরিয়াল দেখার যুগ ছিল। সন্ধ্যা সাতটা আটটার দিকে শুরু হত। তখন আমরা বিহান বেলা গ্রামের মসজিদ মক্তবে আরবি পড়তে যাই। ইমাম সাব বা হুজুরের কড়া নির্দেশ কেউ যেন নামাজ কামাই না করি। এশার নামাজ পড়তে এতো কড়াকড়ি না থাকলেও ‘সিন্দাবাদ’ দেখার উদ্দেশ্যে এশার নামাজকে মওকা হিসেবে নিতাম। কোনোমতে হুজুরের সঙ্গে জামাতে ফরজ নামাজ শেষ করেই দিতাম দৌড়। ‘সিন্দাবাদ’ বা ‘আলিফ লায়লা’ শুরু হবার মুহূর্তের সেইসব টাইটেল সং বা সুরগুলো এখনও কানে বাজে। আ লি ফ... লা য় লা...। বেরসিক গুরুজনেরা অভিযান চালিয়ে সিরিয়াল দেখার আসর থেকে আমাদের ধরে নিয়ে আসতেন। বলা বাহুল্য, পড়াশোনা রেখে এসব দেখার জন্য উত্তম মধ্যমের অনিন্দ্য সুন্দর অভিনব আয়োজন থাকত।

ছোটবেলা গরম চায়ের কাপে পাউরুটি ভিজিয়ে খেতে খুব পছন্দ করতাম। আর ভাবতাম বড় হলে কাপে না আস্ত একটা মগে চা ভরে সেখানে যত ইচ্ছে পাউরুটি চুবিয়ে খাবো। আর সারাদিন টেলিভিশন দেখব। সিনেমা, নাটক, খেলাধুলা তো বটেই কিছুটা রাতগভীরে প্রচারিত ছায়াছবির গানের অনুষ্ঠান ‘ছায়াছন্দ’ও দেখব।

বিটিভিতে শেষ কবে সিনেমা বা নাটক দেখেছি আমার আর মনে পড়ে না। এখন বাসায় বিভিন্ন চ্যানেলে খবর, টক শো, এইচবিওতে মাঝেমধ্যে মুভি, আন্তর্জাতিক অঙ্গনের খোঁজখবরের জন্য বিবিসি, সিএনএন আর আলজাজিরায় চোখ রাখি। অন্য কিছু দেখিনা, বা দেখতে ইচ্ছে করে না বা সময় হয় না। এই তো জীবনের নিয়মে বদলে যাওয়া জীবন। সময় এবং পরিপার্শ্বের অনেক অনুঘটকের সঙ্গে এভাবেই আমাদের রুচি ও অভ্যাস বদলে যায়।

যাকে দিয়ে লেখাটি শুরু করেছিলাম তিনি বাংলা সিনেমার অমর নায়ক সালমান শাহ। আজকের এই দিনে রহস্যময় এক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রের নতুন যুগ আর ইতিহাস সৃষ্টিকারী নায়কের জীবনাবসান ঘটে। যিনি নায়ক হিসেবে শুধু পোশাকের স্টাইলে নয়, সহজাত, সাবলীল অভিনয় প্রতিভায় বাংলা চলচ্চিত্রে নতুন এক মাত্রা সংযোজন করেছিলেন। এদেশের লাখো তরুণ-তরুণী রোমান্টিক, সিনেমাটিক প্রেমে বিভোর হতে শিখেছিল সালমান শাহের চলচ্চিত্র দেখে, চলচ্চিত্রের গানগুলো শুনে।

কেয়ামত থেকে কেয়ামত, তুমি আমার, অন্তরে অন্তরে, স্বপ্নের ঠিকানা, এই ঘর এই সংসার, তোমাকে চাই, স্বপ্নের পৃথিবী, সত্যের মৃত্যু নেই, জীবন সংসার, মায়ের অধিকার, স্বপ্নের নায়ক, শুধু তুমি, আনন্দ অশ্রু – এসব চলচ্চিত্রে সালমান শাহ জুটির কালোত্তীর্ণ জনপ্রিয় সব গান আজো মানুষের মুখে মুখে ফেরে।

সালমান শাহ অভিনয়ে তাঁর জাত চিনিয়ে একটি নতুন যুগের জন্ম দিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর এদেশের অনেক তরুণীকে অপ্রত্যাশিত শক আর শোকে আত্মহত্যা করতে শোনা গেছে। তাঁর লাশ যেদিন সিলেট শহরে আসে আমি আমার প্রয়াত নানীর (যাকে আমরা ‘নানাবু’ বলে ডাকতাম) সঙ্গে সিলেট শহরেই পীরমহল্লায় আমাদের এক আত্মীয়ের বাসায় ছিলাম। খুব ছোট ছিলাম বলে অনেক ইচ্ছে থাকার পরও একা দেখতে যেতে পারিনি। তখন গণমাধ্যমের প্রসার আজকের মত ছিল না। তবু দেশের পথে প্রান্তরে বাতাসেই যেন ভেসে বেড়াচ্ছিল একজন কিংবদন্তি নায়কের অকাল অস্বাভাবিক প্রয়াণ, হৃদয়স্পর্শী রহস্যময় মৃত্যুর হাহাকার। সারাদেশ থেকে হাজার হাজার তরুণ ছুটে এসেছিল শাহজালাল মাজার প্রাঙ্গণে তাকে একপলক দেখতে। আরেকটু বড় হয়ে যখন একাকি সিলেট শহর ঘুরতে শিখলাম একদিন চুপিসারে শাহজালালের মাজারে গিয়েছিলাম সালমান শাহের কবর দেখতে।

সালমান শাহ বাংলা চলচ্চিত্রে চিরআধুনিক কিংবদন্তির এক নায়ক। এদেশে চলচ্চিত্র অঙ্গনে মেধাবী পরিচালক থাকলে তাঁর অভিনয় প্রতিভা দিয়ে আমাদের চলচ্চিত্রকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছানো যেত। সময় সে সুযোগ দেয়নি। তবু সালমান শাহ সময় সমুদ্রে ঢেউ নয়, একটি ঝড় তুলেছিলেন। আজকের এই দিনে তাকে মনে পড়ে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত